ধর্মতলায় প্রযোজক সংস্থার অফিসে সে দিন তুমুল হইচই।
মোদীর সিদ্ধান্ত ভাল না খারাপ, সেই আলোচনার মধ্যেই একটা ব্যাপারে সবাই একমত।
বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের মুখে।
ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বড় স্টারদেরও। সে দিন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফ্লাইট ল্যান্ড করার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ত্রিবেণীতে শো করতে যাচ্ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। নিজেই বলছিলেন, ফাঁকা হাইওয়েতেও একটাই জিনিস মাথায় ঘুরছিল তাঁর। ভাগ্যিস ফাংশন আর শোয়ের পারিশ্রমিকের সিংহভাগ তিনি চেকে নিয়ে থাকেন। না হলে বিরাট দুরবস্থা হতো।
অন্য দিকে, নিজের রেস্তোরাঁয় সন্ধের দিকে প্রায়ই ঢুঁ মারেন দেব। সে দিন দেখা গেল চোখেমুখে দুশ্চিন্তা স্পষ্ট।
‘‘আমি মনে করি পাঁচশো আর হাজার টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দারুণ। যাদের ব্ল্যাক মানি আছে তাদের প্রতি আমার কোনও সিমপ্যাথি নেই। কিন্তু এ সবের মাঝখানে ইন্ডাস্ট্রির খুব ক্ষতি হয়ে গেল। দিজ ইজ আ ভেরি টাফ টাইম,’’ প্রায় স্বগতোক্তির সুরে বলছিলেন দেব।
অন্য দিকে যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যাশ টাকায় অনেকটা লেনদেন হয় (ক্যাশ মানেই ব্ল্যাক নয়) সেখানে এখন প্রযোজকদের চিন্তা, ক্যাশ রোল না হলে আর বেশি দিন তারা শ্যুটিং চালাতে পারবেন না।
এমনিতেই হিটের সংখ্যা হাতে গোনা। এ বছর একটা দু’টো ছাড়া তেমন কোনও বড় হিট নেই। বাজেট কমতে কমতে তলানিতে। তার ওপর স্যাটেলাইট রাইটস থেকে টাকা আর আসে না বললেই চলে। হল-য়ের সংখ্যাও কমতে কমতে মাত্র আড়াইশোর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। বড় ডিরেক্টরদের অনেকেই বাড়িতে বসে। ফাংশনের (যাকে ইন্ডাস্ট্রি বলে মাচা) মরসুম এ বছর শুরুর আগেই শেষ। সেখান থেকেও আর কোনও পারিশ্রমিক নেই অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকাদের। তার ওপর ‘ডিমনিটাইজেশন’।
একজন প্রযোজক তো বলেই দিলেন ‘ডুমস্ ডে’।
ভেন্টিলেটরে আগেই ছিল টলিউড।
এ বার যেন ডাক্তার এসে জবাব দিয়ে গেল ।
প্রথমে চিট ফান্ড, এ বার পাঁচশো, হাজার
এই ক্ষতির অবশ্য দুটো দিক রয়েছে। একটা দর্শকের পারস্পেক্টিভ, অন্যটা প্রযোজকের। বেশির ভাগ দর্শকের কাছে সিনেমা দেখাটা আজকে লাক্সারি। তারা সিনেমা হলের টিকিট কাটার চেয়ে ব্যাঙ্কের সামনে ন্যায্য কারণেই ভিড় জমাচ্ছে।
‘‘এন্টারটেইনমেন্ট আমাদের লাস্ট প্রায়োরিটি। আগে আলু-পেঁয়াজ কিনি, ছেলেমেয়ের টিউশনের টাকা জোগাড় করি, তারপর তো সিনেমা,’’ বুধবার সকালে বলছিলেন রাসবিহারীর দূর্বা চৌধুরী।
অন্য দিকে প্রযোজকের অবস্থাও শোচনীয়।
‘‘আজকেও গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে শ্যুটিংয়ের জেনারেটরের টাকা, গাড়ির তেলের টাকা, লাঞ্চের টাকা কী বিকেলে টিফিনের টাকা — সব পেমেন্ট ক্যাশে হয়। সেই টাকাটা কিন্তু, সব সময় ব্ল্যাক নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই টাকাটা আর হাতে নেই আমাদের। জানি না কত দিন চালাতে পারব,’’ বলছেন এক শীর্ষস্থানীয় প্রযোজক, যাঁর প্রায় সব পেমেন্ট চেকে হয়।
এমনিতেই ভারতবর্ষে একটা প্রচলিত ধারণা, কালো টাকা সাদা করার খুব সহজ উপায় সিনেমায় বিনিয়োগ করা। টালিগঞ্জে সেটা ধারণা নয়, তা-ই হয়ে থাকে।
কিন্তু গত দশ বছর বড় প্রোডাকশন হাউসরা পেমেন্ট চেকে শুরু করলেও বেশ কিছু প্রযোজক এমনও আছেন যাঁরা অন্য ব্যবসার ‘সারপ্লাস টাকা’ সিনেমা ব্যবসায় ঢালতেন।
প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করি। কিন্তু যদি ‘ইমপ্লিমেন্টেশন’টা বেটার করতেন তা হলে সাধারণ মানুষের এতটা হয়রানি হতো না
দেব
ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় তাদের বলা হতো ‘লক্ষ্মী’ প্রোডিউসর। তারা এমন সব ছবি বানাতেন যার সম্বন্ধে ইন্ডাস্ট্রির কোনও ধারণাই থাকত না। শুধু ধর্মতলার কিছু দেওয়ালে পোস্টার দেখা যেত। সেই প্রোডিউসারদেরও কেউ চিনত না। অথচ নায়ক নায়িকারা এদের মাথায় করে রাখতেন।
ইন্ডাস্ট্রি একমত, সেই ক্যাশ টাকা যাঁরা আনতেন সেই প্রোডিউসররা আজকে ‘ফিনিশড’।
“এটা ঠিক, যারা কাঁচা টাকা আনতেন আমার মতন বহু অভিনেতার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে কাজ করার। এরা আমাদের ট্যাক্স-ফ্রি টাকা দিতেন।
টেকনিশিয়ানরাও খুশি ছিলেন। কিন্তু এক ধাক্কায় মোদী এদের শেষ করে দিলেন,’’ বলছিলেন এক নামী অভিনেতা।
কিছু অভিনেতা দুঃখ পেলেও, এই কালো টাকা যাওয়াতে খুশি কিছু নামকরা প্রযোজক।
‘‘হ্যাঁ, ইন্ডাস্ট্রি থেকে টাকা হয়তো চলে গেল কিন্তু এই কাঁচা টাকার প্রোডিউসররা ম্যাসিভ ক্ষতি করত ইন্ডাস্ট্রির। এরা স্টারদের যা নয় তাই টাকা দিত। সবার অভ্যেস খারাপ করত। আমরা মানে এসকে মুভিজ, রিলায়্যান্স, ইরোস কী অন্য কোনও প্রোডাকশন হাউস যাদের ব্ল্যাক-য়ের সিন নেই, তারা এই কাঁচা টাকার প্রোডিউসরের জন্য বেশি খরচ করতে বাধ্য হতো। আজকে সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে চিটফান্ডের পর ইন্ডাস্ট্রির যেমন হাল হয়েছিল, সেই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। বিরাট ধাক্কা খেল টালিগঞ্জ,’’ বলছেন এসকে মুভিজের অশোক ধানুকা।
ডেঙ্গি ছিল, এখন ক্যানসার
ধাক্কাটা এতটাই বড় যে ২৫ নভেম্বর দুটো ছবি রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। একটি যিশু সেনগুপ্ত-মীর অভিনীত ‘অরণ্যদেব’, অন্যটি মুম্বইয়ের ইরোস ইন্টারন্যাশনাল প্রযোজিত এবং হরনাথ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘অমর প্রেম’। দুটো ছবিরই রিলিজ পিছিয়ে গেছে।
এমনকী গত সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ‘কলকাতা কলম্বাস’য়ের প্রযোজক জয় গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, তাঁর ছবি যা ব্যবসা করতে পারত তার এক তৃতীয়াংশ ব্যবসা করেছে এক সপ্তাহে, ‘ডিমনিটাইজেশন’য়ের জন্য।
আজকে মুক্তি পাচ্ছে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়-আবীর অভিনীত ‘ঠাম্মার বয়ফ্রেন্ড’। কিন্তু ছবির প্রযোজক কান সিংহ সোধার মতে, রিলিজ থেকে প্রিমিয়ার, দু’টোর জাঁকজমকই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ বাজারে ক্যাশ নেই।
দক্ষিণ কলকাতায় নবীনা সিনেমা হল-য়ে এক দিনে গড়ে প্রায় তিরিশ হাজার টাকার ব্যবসা হয়। সেটা আজকে নেমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়।
‘‘কোনও ব্যবসাই নেই ছবির। এটা অনেকটা কী রকম জানেন, আগে ডেঙ্গি ছিল। এ বার ক্যানসারে আক্রান্ত ইন্ডাস্ট্রি,’’ বলছেন নবীনার মালিক নবীন চৌখানি।
এই যদি হয় দক্ষিণ কলকাতার সিঙ্গল স্ক্রিনের অবস্থা, তা হলে উত্তর কলকাতার মিত্রা সিনেমাতেও দেখা যাচ্ছে একই দৃশ্য।
‘‘হোটেল আর সিনেমা যাওয়া দুটোই মানুষ বর্জন করেছেন কিছু দিনের জন্য। আমার হল-য়ে দিনে দশ হাজারের বেশি সেল নেই। তার ওপর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ছবি দেখানো হচ্ছে। গত বছর যেখানে ফেস্টিভ্যালের ছবি দেড় লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছিল সেটা এ বারে মাত্র চল্লিশ হাজার,’’ বলছেন মিত্রা সিনেমা হলের দীপেন মিত্র।
অন্য দিকে সবাই একমত, এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম এবং শহরতলির সিনেমা হল-য়ের ব্যবসা প্রায় শেষের মুখে।
আর্টিস্টরা সামলে নেবে, কিন্তু যে টেকনিশিয়ানরা ডেইলি ওয়েজেসে কাজ করে, তাদের কথা ভেবে খারাপ লাগছে
কোয়েল
‘‘দাদা, এটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ইন্ডাস্ট্রির জন্য। এত খারাপ সময় আমাদের আসেনি কোনও দিন। আপনাকে গ্রামের রিপোর্ট দিচ্ছি। পূর্ণিয়ার রূপবাণী সিনেমা হলের কথা শুনলে চমকে যাবেন। গত চল্লিশ বছরে ওই সিনেমা হল-য়ে কোনও শো ক্যানসেল হয়নি। কিন্তু এই এক সপ্তাহে নুন, ম্যাটিনি সব শো ক্যানসেল হয়ে গেছে। আরে, শহরে তবু এটিএম আছে, গ্রামে দশ কিলোমিটার দূরে এটিএম বা ব্যাঙ্ক। তারা কি এখন সিনেমা দেখবে? লিখে দিন গ্রাম ও শহরতলির সিনেমা হল শেষ,’’ বলছেন টালিগঞ্জের অন্যতম বর্ষীয়ান ডিস্ট্রিবিউটর প্রীতম জালান।
প্রীতম ভুল বলেলনি, অবস্থা সত্যিই খারাপ বর্ধমান, কল্যাণী, শিলিগুড়ি, সিউড়ি, কালনা, মালদায়।
এটিএম এবং ব্যাঙ্কের সংখ্যা যদি প্রথম কারণ হয়, আরও একটি ফ্যাক্টরও রয়েছে।
শহরতলির বেশির ভাগ সিনেমা হল-য়ের মালিক, কলকাতার ‘বুকার’-দের কাছ থেকে ছবি কেনেন। ‘বুকার’রা সেই টাকা নিয়ে শহরতলির হল-য়ে ছবি দেন। এই পুরো লেনদেনটা পঞ্চাশ বছর ধরে শুধু ক্যাশে হয়। এখন সেই সব হল মালিকদের মাথায় হাত।
“এত দিন ব্যবসার বেশির ভাগটাই হতো ক্যাশ টাকায়। ওঁরা টাকা দিতেন, আমরা ছবি নিয়ে যেতাম ওঁদের হল-য়ে। এই পুরো সিস্টেমটা শেষ হয়ে গেল কারণ আরও কারও কাছে ক্যাশ নেই,’’ বলছেন টালিগঞ্জের অন্যতম ফিল্ম ব্রোকার নিমাই পাঁজা।
এ দিকে মাল্টিপ্লেক্সরাও যে খুব সুখে আছে তাও কিন্তু নয়। তবে যেহেতু তাদের টিকিট অনেকটাই দর্শক ‘বুক মাই শো’ বা ডেবিট কার্ডে কিনতেন, তাই তাদের সমস্যা আপেক্ষিকভাবে কম।
‘‘দেখুন, ‘রক অন টু’ এমনিতেও খারাপ ছবি। তাই ক্ষতিটা কত, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, মল-য়ে অনেক কম লোক আসছে, আমাদের হল-য়েও ফুট ফল কমেছে। আসল দৃশ্যটা বোঝা যাবে শাহরুখ খানের ‘ডিয়ার জিন্দেগি’র এবং বিদ্যা বালনের ‘কহানি টু’ থেকে। তবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে আমির খানের ‘দঙ্গল’য়ের রিলিজের সময় অবস্থা অনেকটা বেটার হয়ে যাবে বলেই আমাদের ধারণা,’’ বলছেন মাল্টিপ্লেক্স কর্তা পঙ্কজ লাডিয়া।
কত টাকা আর ক্যাশে হয়
ডিসেম্বর নিয়ে অবশ্য এখন ভাবতেই রাজি নন প্রযোজকরা। তাঁদের এখন দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ‘‘মোদীজি দেশের ভাল করলেন, কিন্তু আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। সিনেমায় অনেক পেমেন্ট ক্যাশে হয়। সেটা জোগাড় করাটাই এখন বিরাট সমস্যার,’’ বলছেন ফিরদৌসল হাসান। এই মুহূর্তে হাসানের দু’টো ছবি রয়েছে ফ্লোরে। একটি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের, অন্যটি অনীক দত্ত-র।
অন্য দিকে ডাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া’র রানা সরকার খুশি কালো টাকার প্রযোজকরা বাজার থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়ায়। ‘‘দেখুন, ক্যাশ ফ্লো আটকে যাওয়ায় শ্যুটিংয়ের সমস্যা তো হবেই। তার ওপর দর্শকের এখন সিনেমা দেখার মানসিকতা নেই। তবে আমরা অনেকেই খুশি এটা জেনে যে কিছু প্রযোজক, যাঁরা ব্ল্যাক মানির জোরে হম্বি-তম্বি করতেন, তাঁরা এ বার বিদায় নেবেন। এটা ভাল দিক,’’ বলছেন রানা।
গত এক বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে অনেকগুলো ছবি হয়েছে টালিগঞ্জে।
শোনা যাচ্ছে, এই যৌথ প্রযোজনাও নাকি এবার বন্ধের মুখে।
‘‘এই যৌথ প্রযোজনা নিয়ে অনেক দিন ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে প্রশ্ন রয়েছে। শোনা যেত, যৌথ প্রযোজনার নামে নাকি হাওয়ালার রুট দিয়ে টাকা পাচার হতো। আশা করি, এ বার সেটা ধরা পড়বে,’’ বলছেন এক প্রযোজক।
অধিকাংশ প্রযোজক ক্ষতিস্বীকার করলেও, দু’জন প্রযোজক, শ্যাম সুন্দর দে এবং অতনু রায়চৌধুরী মনে করছেন তেমন কোনও ক্ষতি হবে না ইন্ডাস্ট্রির।
‘‘আমরা সব সময় হোয়াইট মানিতে ফিল্ম বানাই। আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। আর ইন্ডাস্ট্রিতে যে ব্ল্যাকমানি নিয়ে ছবি হয়, সেটা অন্তত আমার জানা নেই,’’ স্পষ্ট বলছেন ‘বেলাশেষে’, ‘মুক্তধারা’-র প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরী যিনি পেশায় উকিল।
একই বক্তব্য শ্যামসুন্দর দে-র।
‘‘ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কত টাকা আর ক্যাশে পেমেন্ট হয়? খুব অল্প। আমি তো সাতশো-আটশো টাকার পেমেন্টও চেকে দিই। সুতরাং খুব ক্ষতি কিছু হবে না,’’ দাবি করছেন ‘বাস্তুশাপ’, ‘হেমন্ত’র প্রযোজক শ্যামসুন্দর।
আজ সিনেমা কাল টিভি
প্রযোজকদের মধ্যে মেরুকরণ থাকলেও অধিকাংশের মতে সময় এসে গেছে স্টারদের সঙ্গে বসে বাজেট কমানোর।
“বাজেট কমাতেই হবে। না হলে আমরা কেউ বাঁচব না। সব দিক থেকেই তো আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে,’’ স্পষ্ট কথা অশোক ধানুকার।
অন্য দিকে দেব মনে করছেন আরও দু’ সপ্তাহ পরেই বোঝা যাবে কতটা ক্ষতি হল ইন্ডাস্ট্রির।
‘‘সিচুয়েশন এখনও ফিফটি-ফিফটি। আর দু’ সপ্তাহ পরে আসল চেহারাটা বুঝতে পারব। প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করি। কিন্তু যদি ‘ইমপ্লিমেন্টেশন’টা আরেকটু বেটার করতেন তা হলে সাধারণ মানুষের এতটা হয়রানি হতো না। টাকাই নেই বাজারে। লোকে কেন
সিনেমা যাবে বলুন ? আমি একটা রেস্তোরাঁ চালাই। সেখানে শুধু কুড়ি শতাংশ লোক আসছে আগের থেকে। হলগুলো ফাঁকা। আরেকটু বেটার প্ল্যান করলে ভাল হতো,’’ স্পষ্টভাবে বললেন দেব।
এ দিকে দেবের মতো প্রসেনজিৎও সমর্থন করছেন ‘ডিমনিটাইজেশন’কে।
“যা হচ্ছে তাকে আমি সমর্থন করি। তবে মানছি এটা ইন্ডাস্ট্রির বিরাট ধাক্কা, কিন্তু দেশের ভাল-র চেয়ে তো বড় কিছু হতে পারে না’’ স্পষ্ট কথা প্রসেনজিৎ-য়ের।
যা হচ্ছে তাকে আমি সমর্থন করি। তবে মানছি এটা ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে বিরাট ধাক্কা, কিন্তু দেশের ভাল-র চেয়ে তো বড় কিছু হতে পারে না
প্রসেনজিৎ
একই কথা সুরিন্দর ফিল্মসের কর্ণধার নিসপাল সিংহ রানের স্ত্রী, অভিনেত্রী কোয়েলের।
‘‘দেখুন, আর্টিস্টরা হয়তো সামলে নেবে, কিন্তু যে টেকনিশিয়ানরা ডেইলি ওয়েজেসে কাজ করে, তাদের কথা ভেবে খারাপ লাগছে। যদিও এটা বলি, মোদীর এই সিদ্ধান্তটা আমার ভাল লেগেছে। এতে ভবিষ্যতে দেশের উন্নতি হবে। তাই একটু সাময়িক সমস্যা হলেও, এটা আমাদের মেনে নেওয়া উচিত,’’ বলছেন কোয়েল।
অন্য দিকে টালিগঞ্জের অন্যতম বড় প্রযোজক সংস্থার কর্ণধারের ভবিষ্যদ্বানী, আজকে পরিস্থিতিটা সিনেমা হল অবধি আছে, কিছু দিন পর তার প্রভাব টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতেও পড়বে।
‘‘এই সিদ্ধান্তে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতাদের থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দশ হাজারের বেশি টেকনিশিয়ান যাদের ডেইলি ওয়েজে পেমেন্ট হতো। এটা লেজিটিমেট ক্যাশ, ব্ল্যাকমানি নয়। অন্য দিকে এটাও মনে রাখবেন এই ‘ডিমনিটাইজেশন’-য়ের জেরে বি়জ্ঞাপনের বাজেট কমবে। বি়জ্ঞাপনের বাজেট কমা মানে টিভি সিরিয়ালে তার প্রভাব পড়া। সিরিয়ালের বাজেট কমলে, রেমুনারেশন কমতে বাধ্য। সব মিলিয়ে আগামী তিন মাসে আমরা বুঝতে পারব আমরা ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলাম,’’ বলছেন তিনি।
অতুনদা… বাঁচাও
৮ নভেম্বর সন্ধেবেলা হালকা ঠান্ডা পড়েছিল দুর্গাপুরে।
রাত তখন ন’টা। ফাংশনে গান গাইতে উঠেছেন জুন বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে তখন ছোট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট খাচ্ছিলেন অতনু সরকার।
কে অতনু?
অনেকেই হয়ত চেনেন না, কিন্তু আজকের টালিগঞ্জের প্রথম সারির স্টারদের লাইফস্টাইল থেকে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বদলে দেওয়ার পিছনে যে ব্যক্তির সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি কোনও প্রযোজক নন, তিনি এই লো-প্রোফাইল অতনু।
কী করে?
অতনুর দৌলতেই দুর্গাপুজো থেকে সরস্বতীপুজোর মাঝখানের সময়টায়, গোটা বাংলা জুড়ে টলিউডের প্রথম সারির স্টারদের নিয়ে একচেটিয়া শো হয়।
টলিউডের গভীর গলিঘুঁজিতে মিশলে শুনতে পাবেন, বড় স্টারদের ৮০-৯০ লাখ টাকার গাড়ি থেকে দু’কোটি টাকার ফ্ল্যাট — এই লাইফস্টাইল সম্ভব এই শোগুলোর জন্যই।
প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা, দেব, নুসরত, শ্রাবন্তী, মিমি, খরাজ, কাঞ্চন, বিশ্বনাথ থেকে টেলিভিশনের চেনা মুখ — সবাই করে থাকেন এই শো।
কাট টু দুর্গাপুর।
মোদীর ঘোষণার পর পরই সে দিন বেজে ওঠে অতনুর ফোন।
সব স্টারদের একটাই আর্তনাদ, ‘‘অতনুদা, মরে যাবো আমরা। আমাদের বাঁচাও।’’
সেই থেকে আজ অবধি শুধু ফোন বেজেই চলেছে তাঁর।
‘‘দাদা, আর্টিস্টরা করবে কী? শো এবং মাচা কোনও দিন হোয়াইট মানিতে হয়নি। ওটা কালো টাকাতেই হয়। আর্টিস্ট-এর বহু টাকা আমার কাছে পড়ে আছে, কিন্তু আমি তো ভাঙাতে পারছি না। একজন নায়কের ৫০ লাখ টাকা পড়ে আছে, একজন নায়িকার ৫৮ লাখ। কারও পাঁচ লাখ, কারও ছ’ লাখ আমার কাছে রয়েছে। আমি কী করব আর টাকাটা নিয়ে? আমার কোনও উপায়ও নেই। আমি সামনের কোনও শো ধরছি না। যে ‘পার্টি’ চেকে পেমেন্ট করবে তার শো নিতে পারি, কিন্তু সেটা আর কত জন করে বলুন? আমি আগামী তিরিশটি শো ক্যানসেল করে দিয়েছি। এ বড় দুঃসময়,’’ বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা বলছিলেন অতনু।
একই কথা কলকাতার বড় শো-য়ের আয়োজক বনি ঘোষের।
“বিয়েবাড়ির শো আর মাচার শো-য়ের দিন শেষ। আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না কারণ আমি বেশির ভাগ কর্পোরেট শো করি। তবে এই শীতকালে তো শুনছি প্রায়ই সব শো-ই শুনছি ক্যানসেলড,’’ বলছেন বনি।
এক দিকে স্টারদের ব্যক্তিগত ক্ষতি, অন্যদিকে প্রায় শিরদাঁড়া ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সব মিলিয়ে জর্জরিত টালিগঞ্জ।
এটাই তো সবচেয়ে বড় সিনেমা
সব দেখেশুনে চিন্তিত পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর ‘ধুমকেতু’ ডিসেম্বরে রিলিজ হওয়ার কথা, সদ্য টাকি থেকে তিনি ‘বির্সজন’ ছবির শ্যুটিং শেষ করে ফিরেছেন।
কৌশিক কিন্তু আশা ছাড়তে তিনি রাজি নন।
“এ রকম নানা ঝড়় ইন্ডাস্ট্রির ওপর দিয়ে গেছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি বাউন্স ব্যাকও করেছে। আর যে পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতাদের শেকড় আছে ইন্ডাস্ট্রিতে, তারা ঠিক এই ঝড়় সামলে দেবে। তবে এটাও বলি, এত দিন আমাদের অনেকেরই দুঃখ ছিল আমরা মুম্বইয়ের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পাই বলে। এই প্রথম টাকা নেই ভেবে কী শান্তিই না পাচ্ছি। আর জীবদ্দশায় এটাও দেখে গেলাম, পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট রাস্তায় পুড়ছে। এর থেকে ব়়ড় ‘সিনেমা’ আর কী হতে পারে,’’ নিজের মেজাজে বলছেন কৌশিক।
সত্যি ‘সিনেমা’ আজ বড় মর্মান্তিক।
একদিকে ‘‘অতনুদা, মরে যাব’’। অন্যদিকে ‘‘শিরদাঁড়া ভেঙে গেল আমাদের’’।
এর মধ্যেই ভেন্টিলেটরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে টালিগঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy