রহস্যময়ী... ডিভা... অভিজাত ব্যান্ডস্ট্যান্ড এলাকার অন্তরালবাসিনী।
এ রকম কত নামেই না তাঁকে ডাকা হয়।
বহু বছর ধরে রেখাকে চিনি। আর তাতেই বুঝেছি গোপনীয়তা রেখার স্বভাবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খুব কম মানুষই পারেন রেখার এই নিভৃত স্বভাবের বর্মভেদ করতে। তবে আমি সেই রেখার কথাও বলতে চাই যিনি পরিপূর্ণ এক মানবী। এক অসাধারণ কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
আমি তখন সাংবাদিকতায় একেবারে নতুন। স্টারদের দেখলে একটু ভয়ভয়ই করত। অন্য তারকাদের সঙ্গে দেখা হত অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে, স্টুডিয়োয়। আর রেখা ডাকতেন বাড়িতে। প্রাতরাশে খাওয়াতেন গরম ইডলি, সঙ্গে চাটনি। দরজায় তাঁর হাসিমুখ দেখে বোঝা যেত তারকারাও কী অসম্ভব বিনয়ী এবং সজ্জন মানুষ হতে পারেন। তখন কস্টিউম জুয়েলারি নিয়ে রেখার উন্মাদনা সাঙ্ঘাতিক। কেউ বাড়িতে গেলে আগে তাঁর গয়নার কালেকশন দেখাতে বসতেন। কোনও গয়নার কেউ প্রশংসা করলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ‘‘তোমার যখন এটা এত পছন্দ, তখন তুমিই এটা রাখো।’’ বেশির ভাগ সময়েই রেখা যাতে না দেখতে পান, সে রকম ভাবে সেই গয়না ফেলে রেখে পালিয়ে আসতে হত। রেখা ছিলেন এতটাই উদার মনের। আর যদি ওঁর চোখে পড়ত সেই গয়না না নিয়েই আপনি চলে গেছেন, পরে তা নিয়ে অভিমান করতেও ছাড়তেন না।
নীতু সিংহ থেকে জারিনা ওয়াহাব, বা আশা সচদেব— তখনকার বলিউডের নায়িকাদের মধ্যে কে না আসতেন রেখার বাড়িতে! নিপুণ মেক আপ-এর কলাকৌশল শিখতেন তাঁরা রেখার কাছে। মনে পড়ে শ্রীদেবীও ছিলেন সেই তালিকায়। আর রেখার কৌশল অনুসরণ করে শ্রীদেবীর নিজের মেক আপ-এর স্টাইলেও দারুণ পরিবর্তন এসেছিল। রেখা যদিও স্বীকার করেননি কখনও, তবু আমার দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীদেবী-মিঠুনের সম্পর্কের ব্যাপারটা রেখার পুরোপুরি জানা ছিল। এমনকী শ্রীদেবী-মিঠুন একসঙ্গে এলে ওঁদের ছবি তোলার অধিকারটাও নাকি ছিল একমাত্র রেখারই। কিন্তু মিঠুনের সঙ্গে শ্রীদেবীর সম্পর্ক টেকেনি। এমনকী সেখানেই রেখার সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্বের সমাপ্তি। আমি এ সব নিয়ে রেখাকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে মিলত রহস্যময় এক হাসি। একদিন অবশ্য বলে ফেললেন, ‘‘খারাপ লাগে ওর (শ্রীদেবী) কথা ভাবলে। ওকে বন্ধু ভাবতাম...।’’
ঘরোয়া রেখার কথায় ফিরি। যখন ওঁর মা পুষ্পাবলী মারা গেলেন, রেখা মারাত্মক ভেঙে পড়েছিলেন।
মা-ই ছিলেন রেখার ভরসা, আদর্শ। দীর্ঘ সময় নিজেকে বাড়ির চৌহদ্দিতে বন্দি রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু আমি সমব্যথা জানিয়ে যখনই ফোন করতাম, সে ফোনের উত্তর পেতাম সঙ্গে সঙ্গে।
এই শোক খানিকটা কাটিয়ে ওঠার পর রেখা তাঁর জীবনের সবচেয়ে দৃঢ় আবেগের এই জায়গাটি নিয়ে কথা বলতে পেরেছিলেন। একদিন স্মৃতিমেদুর হয়ে বলছিলেন, ‘‘আমার ড্রেস-সেন্স, লাল লিপস্টিকের ওপর এই টান— সবটাই মায়ের থেকে পেয়েছি। ছোট থেকেই মাকে দেখতাম দিনের যে কোনও সময়েই তিনি অসম্ভব পরিপাটি। মা’র পরনে থাকত পাটভাঙা শাড়ি, লাল লিপস্টিক। মা-কে হারানোটা যে আমার কাছে কী, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’’
রেখার টিপস
সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠা। রাতে ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়া।
ফ্যান্সি ডায়েট না। মা-কাকিমাদের দেওয়া নিরামিষ ডায়েটেই স্টেপল ফুড
যদিও রেখার শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একাকীত্ব। নানা কথার ফাঁকে রেখা বলতেন, ‘‘আমি একটু একা একা থাকতাম। কোনও দিনই আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল না। কিছুটা টমবয়িশ ছিলাম। গাছে চড়তাম। আর স্কুলের ব্রেক টাইমে সময় কাটাতাম চ্যাপেলে। বাড়ির বিভিন্ন পুজোও আমাকে টানত খুব। আমার সব সময়ই মনে হত ঈশ্বরই তো আমাকে এত বিশেষ ভাবে তৈরি করেছেন। দিনের অনেকটা সময় ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দিতাম। তিনিই ছিলেন আমার বন্ধু...’’
সাধারণ মানুষ রেখাকে ‘স্টার’ তকমা দেন। আমার এটা না-পসন্দ। আপনার যদি বড় বেশি নাকগলানো স্বভাব হয়, তা হলে আপনার মনে হতেই পারে রেখা স্টার ছাড়া কিছু নন। আমার নেওয়া বহু সাক্ষাৎকারেই রেখা বলতেন, ‘‘তুমি লেখো, তুমি আমাকে ভাল ভাবে চেনো। তোমার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় তুমি আমার আসল ‘আমি’টাকে বের করতে আনতে পারবে।’’ রেখার আমাকে ঘিরে এই প্রশস্তি মুগ্ধ করেছিল আমাকে। তিনি যে আমাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতেন, সেটা বোঝা যায়।
আমি আরও একটা বিষয় শিখেছি রেখার কাছে। ধারাবাহিকতা। আমাকে সব সময় বলতেন, ‘‘একনিষ্ঠ থাকো। তাতেই মানুষ তোমার ওপর ভরসা করবে।’’ রেখা প্রমাণও করেছিলেন এই সত্য। এক সিরিয়াস অপারেশনের পর আমার শাশুড়ি-মা ছাড়া পেলে রেখা ওঁকে ফোন করে উৎসাহ দিয়েছিলেন নানা ভাবে। আমার পোষা বেড়ালটা মারা গেলে রেখা ফোন করে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আরও একটিকে নিয়ে আসতে। আমার এক অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছিলাম (তিনি রেখারও অসম্ভব প্রিয় ছিলেন।) এই ঘটনার পর প্রায় এক মাস ধরে রোজ ফোন করতেন। এমনকী আজও আমরা একই ভাবে পরস্পরের খোঁজখবর রাখি।
বেড়়াল, কুকুর, পাখি— রেখা পোষ্যদের খুব ভালবাসেন। আর দু্র্বলদের প্রতি তো রেখার ভালবাসা আরও বেশি। যেমন নিজের বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া কাক-ঠোকরানো পরিত্যক্ত বেড়ালছানার ওপর তাঁর মমতা যেন উপচে পড়ে। অন্য দিকে আবার রেখা খুব রসিকও। সাহসী কুকুরের নাম রেখেছিলেন মুকদ্দর। রেখার মধ্যে ছিল অসম্ভব এক ছেলেমানুষি। পাগলের মতো খেতে ভালবাসতেন বান্দ্রার এলকো আর্কেডের ফুচকা। একদিন আমি ওখানে দাঁড়িয়ে সবে ফুচকাটা মুখে পুরেছি, একটা সাদা গাড়ির টিন্টেড গ্লাস-টা নামিয়ে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল! তাকিয়ে দেখি, রেখা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ার উপায় ছিল না তাঁর। অগত্যা গাড়ির ভেতরটাই ভরসা।
তিরিশের বেশি বছর ধরে মানুষটাকে কাছ থেকে দেখে বুঝতে পারি ‘মুকদ্দর কা সিকন্দর’য়ের রেখার সঙ্গে আজকের রেখার সত্যি যেন কোনও তফাত নেই। আজও সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠা চাই। রাতে ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়া চাই। এ ছাড়া খাওয়াদাওয়ার ডিসিপ্লিনেও রেখার ধারেকাছে কেউ আছে বলে মনে হয় না। এখানে এটাও বলি, রেখা কিন্তু আজকের ওই ফ্যান্সি ডায়েটিশিয়ানদের দেওয়া ডায়েটে বিশ্বাস করেন না। আজও মা-কাকিমাদের দেওয়া নিরামিষ ডায়েটেই রেখার স্টেপল ফুড। এ ছাড়া রেখার স্ক্রিপ্ট সেন্স সেই আগের মতোই তুখড়। না হলে ‘ফিতুর’য়ের মতো ছবি মাঝপথে তিনি ছাড়তেন না। সে দিন কথায় কথায় বলছিলেনও, ‘‘যে ভাবে চাইছিলাম সে ভাবে বানানো হল না ‘ফিতুর’। তাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।’’
মাঝে মাঝে লোকে ওঁর জীবনের প্রেমঘটিত ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করতেন। বলিউডের সবচেয়ে খ্যাতনামা অভিনেতার সঙ্গে রেখার সম্পর্ক নিয়ে আজও মানুযের মনে কৌতূহলের বিরাম নেই।
সবাই জানেন সেই অধ্যায়। কিন্তু তা নিয়ে কথা বলা আমার কাছে অন্তত বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। শুধু এটুকুই বলব, রেখা যখন ভালবাসেন, তখন তিনি সমর্পিত প্রাণ। পৃথিবীর কোনও শক্তিই তাঁকে সেই ভালবাসা থেকে দূরে রাখতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy