অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
বাঘাযতীনের নিরিবিলি রাত্তিরে জীবনানন্দীয় পঙ্ক্তিতে ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে, এখন আর কেউ ব্যান্ডের নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ রাখে না! দমবন্ধ ধোঁয়াশায়, কংক্রিটের জঙ্গলে রিলিফ খঁুজতে গিয়ে ভুল করেও ভাবে না দলের নাম হোক ‘গড়ের মাঠ’ কিংবা ‘অভিলাষা’! ‘মা-মাটি-মানুষের’ মহানগরও নাকি নাক সিঁটকোয় ব্যান্ডের মেঠো নস্টাল নামে! আর লালন? সে তো এখন হরির লুঠ!
দেখেশুনে কলকাতার ‘রক’-এর হাওয়া বলছে, ফুল-পাখি-চাঁদ-তারা মার্কা নেকুপানা কাব্যিক নামের চেয়ে, ‘ক্যাওড়া’ নামের কদর এখন ঢের বেশি! খুচরো তর্ক থাকলেও জেন ওয়াই ব্যান্ড-বাজারের অভিমত, রক ব্যান্ড ‘রিপ’, হিপ হপ ব্যান্ড ‘আফটার স্লিম’ বা হার্ডকোর মেটালিক ব্যান্ড ‘ক্যাওস’-এর মতো চটকদার, ‘গান্ডু সার্কাস’-এর মতো ফিউশন নামের দর বেশি। কান টানে দিব্য। মতির ঘরে মেটাল সুরের দোলন লাগানোয়, এ সব নামের না কি জুড়ি মেলা ভার!
কথা-সুর নিয়ে সে পাগলামি করতে করতে দলের ড্রামার অভিরূপ চট্টোপাধ্যায় এগারো সালে নামটা দিয়েছিল। গানবাজনা করতে চেয়ে উন্মাদনা। সেই উন্মাদনার তুখড় টানে ‘হটকে’ নামকরণ? “মোটেই তেমন নয়, অর্থ তো আছেই, পাগলামিও আছে।” বলছিলেন ‘ক্রেজিপেটালস্’ ব্যান্ডের লিড ভোকাল পথিক রায় চৌধুরী। মনে পড়ল, নাম নিয়ে সে দিনও উন্মাদনা ছিল, সেই চুয়াত্তরে! এই শহরের সাত জন ‘বেপরোয়া’ যুবক এক পাড়া-ফাংশানে নাকতলায় হাজির হয়েছিল। তারা, নতুন ধরনের গান বাজনা করতে চায়। যদিও তখনও দলের কোনও নাম ঠিক হয়নি। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা জিজ্ঞেস করে, কী নাম লেখা হবে দলের? কী নাম? যেহেতু সাত জন, হঠাত্ করেই নাম ঠিক হয়ে গিয়েছিল ‘সপ্তর্ষি’!
‘অমাবস্যা’! উন্মাদনা থেকেই হয়তো এমন নামকরণও হয় ব্যান্ডের। এ-ও হয়, যে দলের নাম শুনলেই উসখুস মন শুনতে চায় ব্যান্ড ‘আত্মহত্যা’র ডেথ মেটাল! কখনও, নেশা ঝিম ঝিম গহন ঘুমের অতলে নেমে যেতে নাছোড় হয়ে ওঠে সে। নেশা ও মৃত্যুর ছোঁয়াচে ঝিম ধরানো এমন ব্যান্ডের নজিরও রয়েছে। ২০১০ এ ‘এন ১০’- যেমন! দিব্য মনে আছে, সিডির কভারে ইংরেজিতে ‘এন’ শব্দটা। জড়াজড়ি লালে লেখা, নিউমেরিক এক। একের পাশে শূন্য নয়, একটি ঔষধি বড়ির ছবি! এন ১০! তাঁদের ‘দাপুটে ভালবাসার গান’-এর প্রথম অ্যালবাম ছিল ‘ভালবেসেই দ্যাখো না’। শেষ গান, ‘ছঁুলেই নির্বাসন’!
স্রেফ চমক? বহুর মাঝে ‘অপূর্ব একা’ হতে এই সহজ চটক! না হলে এমন নাম কেন? উত্তর মিলল না এত দিন পরে আর! দলের যোগাযোগ, ঠিকানাবিহীন। সে দিনের গৌতম চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষালদের ‘সপ্তর্ষি’-ও বেশি দিন টেকেনি। হারিয়ে গিয়েছিল নিরুদ্দেশে! কিছু দিনের মধ্যে দল বদলে গিয়েছিল নতুন নামে। ‘তীরন্দাজ’। তবুও ঠিক জমছিল না। বলছিলেন রঞ্জন ঘোষাল। ‘দলের নাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বি এস সি এবং সম্প্রদায়’!
বেঙ্গালুরুতে অনুপম রায়ের ব্যান্ডের নাম ছিল ‘কাগদাসপুরা গ্র্যাজুয়েট ব্যান্ড’! রেখেছিলেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র রঞ্জন। শুনলে মনে পড়ে যায় ‘জাতিস্মর’-এ সৃজিতের অনুকৃতি ‘ফরাসডাঙা গ্র্যাজুয়েট ব্যান্ড’। কিন্তু অল্টারনেটিভ বাংলা রক ব্যান্ড ‘ইনসোমনিয়া’ বা, ধমকদার মেটাল ব্যান্ড ‘শাট আপ অ্যান্ড লিসন’? এমন নাম শুনে সত্যিই চুপ করে কী গাইবে, শুনতে চায় কান।
একানব্বইয়ে কুট্টি মজুমদারের হাত ধরে গল্ফগ্রিন এলাকায় জন্ম নেওয়া ব্যান্ড ‘অভিলাষা’-র মতো শ্রুতিসুখ শব্দের শহরে মেটালিক নামকরণের পিছনে সেই হেভি মেটালের প্রভাব লক্ষ করছেন ‘গড়ের মাঠ’-এর সুব্রত ঘোষ। ‘হিপ পকেট’ নামে ছিয়ানব্বইয়ে হার্ড-রক ব্যান্ড গড়েছিলেন ড্রামার নন্দন বাগচি। সে সময় বেশ অন্য রকম নাম। রক ব্যান্ড ‘ক্রসউইন্ডস’-এর শুরু তারও ছ’ বছর আগে। চটকদার ভৌগোলিক নাম কেন? ‘ক্রসউইন্ডস’-এর লিড গিটারিস্ট বিক্রমজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “ছ’ জন সদস্য ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়া নিয়ে মিলেছি।” মিলনের তাগিদ থেকে জন্ম, চলতি সময়ের অল্টারনেটিভ রক-ব্যান্ড ‘ইক্যুলিব্রিয়াম’, ‘ক্রসরোডস’, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অথরিটি’-রও। এমন নামের রহস্য নিয়ে কথা হচ্ছিল, ‘ইক্যুলিব্রিয়াম’-এর সদস্য কবীর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। “সকলেই পৃথক পৃথক ধারার গান শুনে বড় হয়েছি আমরা। কেউ ব্লুজ, কেউ ফোক, কেউ বা রক। সকলে ব্যালেন্স রাখার ভাবনা থেকেই এমন নাম বেছে নেওয়া।”
চমকপ্রদ নামের প্রয়োজন নিয়ে বলছিলেন, ‘ক্রসরোডস’-এর লিড ভোকালিস্ট সপ্তক দাসও। শব্দ চটকদার অথচ প্রাসঙ্গিক’। একই বক্তব্য ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অথরিটি’-রও। দলের বেস গিটারিস্ট সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বলছিলেন, “সময়ের সঙ্গে যায় এবং অর্থবহ, সেই জন্য এমন নাম। নতুন শিল্পীদের তো কেউ জানে না, আন্ডারগ্রাউন্ড সকলে।”
নর্থ কলকাতার ব্যান্ড ‘কায়া’, ‘পৃথিবী’-র নামকরণেও রয়েছে বিশেষ অর্থ। বাংলা রক ব্যান্ড ‘ডিলিট’ বা, ‘রিখটার স্কেল’-এর মতো তুমুল চটকদারি না থাকলেও শহরে সুবিদিত ‘কায়া’। সে জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা সরিয়ে ‘কায়া’-র নামকরণ নিয়ে বলছিলেন বেস গিটারিস্ট অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়। ‘স্রেফ চটক নয়, অর্থও রয়েছে নামে। গানের দেহের সঙ্গে শরীরকে মিলিয়ে দিতেই এমন নাম নিয়েছি’। অর্থাত্ কিনা, সকলেই যে চটকদার নামে বিশ্বাস করেন, তেমন নয়! উইকি সূত্রে পাওয়া ব্যান্ড তালিকা থেকে ‘ক্রনিক জর্ন’ বা, ‘কাসিনিস ডিভিশন’-এর মতো মেটাল কোর-অলটারনেটিভ-হাইব্রিড ব্যান্ডের প্রসঙ্গ তুলতে, নামকরণে বাঙালিয়ানার প্রশ্ন তুললেন যেমন, ‘স্বর ও বর্ণ’-এর সদস্য স্বরূপ হালদার। ‘এসব নামে চটক হয়তো থাকে, কিন্তু বাংলায় গান-বাজনা করব আর নামে বাঙালিয়ানা থাকবে না’?
স্বরূপ হালদারের ‘স্বর ও বর্ণ’, অর্পণ চক্রবর্তীর ‘চারণ’ বা, তিমির বিশ্বাসের ‘ফকিরা’-র মতো মাটির গান নিয়ে ব্যান্ড করেও কেউ কেউ এখন চটকদার নামে সু-বিদিত! ফোক ব্যান্ড বোলপুর ব্লুজ যেমন।
চুয়াত্তর থেকে নিরানব্বই। শ্রুতি-সুখ কাব্যিক নামের পর, বাংলা ব্যান্ড নামকরণে মেটালিক শব্দের ভূত দেখছেন বহু ব্যান্ডের আয়োজক ও ম্যানেজার সায়ন্তন দত্তগুপ্ত। বলছিলেন, “প্রাথমিক উন্মাদনা কেটে যায় এক সময়। বহু রক বন্ধুকে চিনি, সকলেই থিতু হতে চায়। যেন মেটালের পোড়া ছাই ঝরে পড়ে। নবজন্ম হয়।” সায়ন্তন হয়তো ঠিক বলছিলেন। এ ভাবেই বুঝি ফিনিক্স জন্মে চির চেনা রূপকথায় ফেরে জেন ওয়াইয়ের নগর কবিয়াল!
ওঁদের কথা
মহীনের ঘোড়াগুলি
একদিন বেশ রাত, বাঘাযতীনের রাস্তায় হাঁটছিলাম আমরা। জীবনানন্দ মনে পড়ছিল। ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোত্স্নার প্রান্তরে’।
মণিদা মানে গৌতমদাকে বললাম, ব্যান্ডের নাম যদি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ রাখা যায়, কেমন হয়? ফিরে তাকিয়ে বলল, “এক্ষুনি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।”
রঞ্জন ঘোষাল মহীনের ঘোড়াগুলির সদস্য
দোহার
দোহার কেন? কেন না, কেউ তো আমরা মূল গায়ক নই, সকলেই ধুয়ো দিই। সেই জন্য ‘দোহার’
কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য দোহারের মূল গায়েন
লক্ষ্মীছাড়া
বাবা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়)-র মনে হয়েছিল, আমরা যেটা করছি সেটা লক্ষ্মীছাড়ামো!
গৌরব চট্টোপাধ্যায় (গাবু) ‘লক্ষ্মীছাড়া’-র ড্রামার
ক্যাকটাস
‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে’ র বদলে আমাদের মনে হল নতুন ধরণের গান করার কথা। তাই ‘ক্যাকটাস’
বাজি ওরফে শিবাজী পাল লিড সিঙ্গার, ক্যাকটাস
ফসিলস
ফসিল-এর মতো, আমাদের গান হয়তো বহু বছর পর শ্রোতারা নতুন করে আবিষ্কার করবে
রূপম ইসলাম লিড ভোকালিস্ট, ফসিলস
চন্দ্রবিন্দু
প্রথমত বাংলা বর্ণমালার শেষ অক্ষর দলের লক্ষ্যও বাংলা গানের শেষ কথা বলার। দ্বিতীয়ত, কেউ মারা গেলেও বসে চন্দ্রবিন্দু।
দেবতাদের আগেও বসে বলতে পারেন মৃতে-অমৃতে চন্দ্রবিন্দু এবং শেষটি হল, কখনও একা নয় চন্দ্রবিন্দু।
সব সময় কোনও না কোনও অক্ষরের সঙ্গে বসে। অর্থাত্ চন্দ্রবিন্দুতে কেউ একলা নয়। সকলে মিলে
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য গীতিকার, ‘চন্দ্রবিন্দু’
পটার মরুদ্যান
মরুদ্যান কেন না, এটা আমাদের স্বস্তির জায়গা, শান্তির জায়গা। বন্ধুদের নিয়ে এখন স্বস্তিতে আছি, খুব ভাল আছি পটার মরুদ্যানে
পটা ওরফে অভিজিত বর্মণ সদস্য, ‘পটার মরুদ্যান’
শহর
এই শহরে জন্ম, বেড়ে ওঠা, প্রেম, দুঃখ পাওয়া, ভাললাগার এ শহর কিছু পাওয়ার জন্য দৌড়তে দৌড়তে দেখে ফেলা এ শহরের মুখ আমাদের
গান-বাজনার সৃষ্টিশীল এক মঞ্চ ‘শহর’। আর ‘পরশপাথর’! সে কবেকার কথা! ভেবেছিলাম, সুরের পরশপাথরে সোনা হয়ে যাবে সব
অনিন্দ্য বসু সদস্য, ‘শহর’
গড়ের মাঠ
‘গড়ের মাঠ’- যেন শহরের রিলিফ ট্যাগ লাইন ছিল ‘শহরের দমবন্ধ ধোঁয়াশায়, এক মুঠো সবুজ অবকাশ’
সুব্রত ঘোষ-জয়জিত্ লাহিড়ি গীতিকার-সুরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy