Advertisement
১১ জুন ২০২৪

সোনার উজ্জ্বল দিনে লজ্জার অন্ধকারও

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয়দের চূড়ান্ত গর্ব আর চরম লজ্জার অত্যাশ্চর্য সহাবস্থান! সম্পূর্ণ উল্টো দুই মেরুর পাশাপাশি চলার অবিশ্বাস্য ঘটনা! অভিনব বিন্দ্রা থেকে পারুপল্লি কাশ্যপ। সুশীল কুমার থেকে বিকাশ গৌড়া। দীপিকা পাল্লিকাল থেকে দীপা কর্মকার। গ্লাসগোয় ভারতকে মহাগর্বিত করার মতো একঝাঁক উজ্জ্বল মুখ গত দশ দিনে যেমন পাওয়া যাচ্ছে, পাশাপাশি রয়েছে দেশকে লজ্জার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া কয়েকটা কালো মুখও!

গৌরব। নতুন শিখরে তেরঙ্গা। ৩২ বছর পর পুরুষদের ব্যাডমিন্টনে সোনা জিতলেন পারুপল্লি কাশ্যপ।

গৌরব। নতুন শিখরে তেরঙ্গা। ৩২ বছর পর পুরুষদের ব্যাডমিন্টনে সোনা জিতলেন পারুপল্লি কাশ্যপ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয়দের চূড়ান্ত গর্ব আর চরম লজ্জার অত্যাশ্চর্য সহাবস্থান! সম্পূর্ণ উল্টো দুই মেরুর পাশাপাশি চলার অবিশ্বাস্য ঘটনা!

অভিনব বিন্দ্রা থেকে পারুপল্লি কাশ্যপ। সুশীল কুমার থেকে বিকাশ গৌড়া। দীপিকা পাল্লিকাল থেকে দীপা কর্মকার। গ্লাসগোয় ভারতকে মহাগর্বিত করার মতো একঝাঁক উজ্জ্বল মুখ গত দশ দিনে যেমন পাওয়া যাচ্ছে, পাশাপাশি রয়েছে দেশকে লজ্জার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া কয়েকটা কালো মুখও!

না, এরা সবার শেষে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছনো কোনও সাঁতারু নন। কিংবা হকি ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এক গণ্ডা গোল খেয়ে চুরমার হওয়া সর্দার সিংহের টিম ইন্ডিয়া-ও নয়। সে তো অলিম্পিক, এশিয়াড কিংবা কমনওয়েলথের ইতিহাসে মাঠের যুদ্ধে ভারতীয়দের ধ্বংস হওয়ার অনেক অতীত নজির আছে। গ্লাসগোয় যা হয়েছে, তা একেবারেই অন্য রকম। সেখানে গেমসের শেষ দিন ৭০টি দেশের সামনে ভারতের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন দুই কর্মকর্তা। যৌন হেনস্থা এবং মদ্যপ অবস্থায় ড্রাইভিংয়ের মতো অভিযোগে স্কটল্যান্ড পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে! এঁদের এক জন আবার ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (আইওএ) মহাসচিব রাজীব মেটা স্বয়ং! অন্য জন কুস্তির রেফারি বীরেন্দ্র মালিক।

চার বছর আগে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে টুর্নামেন্টের ইতিহাসে ভারত যদি প্রথম বার পদকের ‘সেঞ্চুরি’ (মোট ১০১টি পদক জিতেছিল) করে থাকে, তা হলে পাশাপাশি ছিল দিল্লি গেমসের সর্বেসর্বা সুরেশ কলমডী-র ‘লুট’-ও! গেমসের কয়েকশো কোটি টাকা তছরুপের দায়ে দীর্ঘ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল তৎকালীন আইওএ প্রেসিডেন্টকে। শীর্ষপদটিও খোয়ান।

গ্লাসগোর কলঙ্ক তার থেকে কিছু কম নয়। সেখানে শহরের প্রধান সড়কে মদ্যপ অবস্থায় বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালানোর অভিযোগে শনিবার রাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আইওএ মহাসচিব রাজীব। কুস্তির রেফারি বীরেন্দ্রকে স্কটল্যান্ড পুলিশ রবিবার সকালে গ্রেফতার করে। আগের রাতে হোটেলের রিসেপশনিস্টের হাত ধরে টানাটানি করার অভিযোগে। দু’জনকেই সোমবার আদালতে পেশ করবে পুলিশ। তার আগে এক বা দু’রাত বিদেশে পুলিশি হাজতে কাটাতে হচ্ছে ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার মহাসচিব ও কুস্তির রেফারিকে!

লজ্জা। দুই অভিযুক্ত রাজীব মেটা এবং বীরেন্দ্র মালিক।

কলঙ্কের এই ছবির পাশাপাশিই রবিবার, গেমসের শেষ দিনে উজ্জ্বল হয়ে রইলেন কমনওয়েলথে বত্রিশ বছর পর ব্যাডমিন্টনে পুরুষদের সিঙ্গলসে দেশকে সোনা এনে দেওয়া পারুপল্লি কাশ্যপ। এক যুগ ধরে মারাত্মক হাঁপানিকে ‘জয়’ করা পারুপল্লি, যাঁকে প্রত্যেক বছর কঠিন সব মেডিক্যাল টেস্ট দিয়ে থেরাপিউটিক ইউজ এগজেম্পশন সার্টিফিকেট (টুই) জমা দিতে হয় ‘ওয়াডা’ বা বিশ্ব ডোপ প্রতিরোধ সংস্থার কাছে। তার পরেই র্যাকেট-শাটল হাতে কোর্টে নামার অনুমতি মেলে!

কঠিন রোগকে ‘জয়’ করে ব্যাডমিন্টন কোর্টে কাশ্যপের মহাসাফল্য। স্কোয়াশের ইতিহাসে কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের প্রথম সোনা জয়। কুস্তি-শু্যটিংয়ে ঝুড়ি-ঝুড়ি পদক। মেয়েদের জিমন্যাস্টিক্সে প্রথম পদক লাভ। অ্যাথলেটিক্সে সোনা-রুপো-ব্রোঞ্জ। গ্লাসগোর মাটিতে ক্রীড়াবিদদের ১৫ সোনা-সহ মোট ৬৪ পদক জয়ের সমস্ত কীর্তিই বিবর্ণ হয়ে পড়ছে স্বয়ং আইওএ মহাসচিব-সহ দুই কর্মকর্তার কেলেঙ্কারিতে! সারা দিন ধরেই ভারতের প্রাক্তন নামী অ্যাথলিট থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় গোটা দেশ এমনকী বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রাও নিন্দার ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রক তড়িঘড়ি লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস থেকে এক সিনিয়র অফিশিয়ালকে গ্লাসগোয় পাঠিয়েছে। প্রয়োজনে অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তবে কেন্দ্রের সদ্য নতুন সরকার গোটা ঘটনায় যে একই সঙ্গে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ, তা ক্রীড়ামন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালের মন্তব্যেই পরিষ্কার। “ঘটনাটা দেশের পক্ষে চরম লজ্জার। অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী। গ্লাসগোয় ভারতীয় দলের ‘শেফ দ্য মিশন’ রাজ সিংহ-ও বলেছেন, “অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। তবে এর বেশি কিছু বলতে পারব না। কারণ ভারতীয় দলের যে সব অ্যাথলিট আর অফিশিয়াল গেমস ভিলেজে থাকছেন, তাঁদের ব্যাপারেই সব খোঁজখবর রাখা আমার কাজ। যাঁরা ভিলেজের বাইরে আছেন, তাঁদের দেখাশোনা করা আমার ডিউটি নয়।”

শীর্ষকর্তা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার পরেও পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে আইওএ। সংগঠনের যুগ্মসচিব রাকেশ গুপ্ত বলেছেন, “যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত কুস্তির রেফারি গ্লাসগোয় আইওএ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁর দায় আমাদের ঘাড়ে চাপানো ঠিক হবে না।”

এবং এখানেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে এ ধরনের ভুঁইফোঁড় কর্তারা গ্লাসগোয় কী ভাবে, কোন যোগ্যতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়েছেন? দশ দিনের গেমসে ভারতের ২১৫ জন অ্যাথলিটের সঙ্গে গ্লাসগোয় গিয়েছেন শতাধিক কর্মকর্তা! হিসেব কষে দেখা যাচ্ছে, প্রতি দু’জন অ্যাথলিট পিছু এক জন করে কর্মকর্তা! সরকারি টাকার এত বেশি নয়ছয়ের হিসেব চাওয়ার সময়ও এসেছে বলে মনে করছেন ভারতীয় ক্রীড়ামহলের অনেকেই। প্রাক্তন অলিম্পিয়ান অশ্বিনী নাচাপ্পা যেমন বলেন, “ক্রীড়া সংস্থাকে চালাবার জন্য কর্মকর্তারা টাকা পান। টাকাটা করযোগ্যও। দেশের টাকা। তার পরেও যে সব কর্মকর্তা দেশের সম্মান বিদেশে ধুলোয় মিশিয়েছেন, তাঁদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।”

কারও কারও বক্তব্য, গেমসের নামে ভারতীয় কর্মকর্তাদের এ ভাবে দলে দলে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া বরাবরই ছিল। এবং তাঁদের অনেকের নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার উদাহরণও আছে। কিন্তু যে হেতু তখন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিল না, তাই বেশির ভাগ কেলেঙ্কারির কথা সাধারণ মানুষ জানতে পারতেন না। পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে, গত দশ-পনেরো বছরে মাল্টিপল ইভেন্টের আন্তর্জাতিক গেমসে ভারতের পদকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমন ভারতীয় খেলোয়াড়দের (বিশেষ করে ভারোত্তোলন, কুস্তি, বক্সিং, শু্যটিং) ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়ার ঘটনাও বেড়েছে।

রবিবারের পরে অবশ্য সব ঘটনাই চলে গেল পিছনের সারিতে।

ছবি: পিটিআই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE