নিজে থেকেই লক্ষ্যবস্তু বেছে নিয়ে হামলা চালাতে পারবে রোবট-অস্ত্র! বলা ভাল, ‘খুনি রোবট’। কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর যন্ত্রদানব এ বার সত্যি হতে চলেছে? সিনেমার পর্দার ‘টার্মিনেটর’ কি এ বার বাস্তব দুনিয়ায় চলে আসছে? অসম্ভব কিছু নয়। গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এখনও চলছে।
হলিউড সিনেমার মতো এই ‘টার্মিনেটর’দের হাত-পা নেই! আছে কৃত্রিম মেধা— যন্ত্রদানবের মগজও বলা যায়। সেটিই এই ‘টার্মিনেটর’দের নিয়ন্ত্রক। গবেষকেরা এদের নাম দিয়েছেন ‘লিথাল অটোনমাস ওয়েপন সিস্টেম’। তবে ‘কিলার রোবট’ বা ‘খুনি রোবট’ নামেই এরা অধিক পরিচিত। ভবিষ্যৎ যুদ্ধের খোলনলচে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এরা।
গত কয়েক বছরে যুদ্ধের আবহে বিভিন্ন সমরাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বিশ্ববাসী। আধুনিক যুদ্ধে পাইলটহীন বিমানের (বোমারু ড্রোন) ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রচলিত পাইলটহীন যুদ্ধবিমান এবং ‘খুনি রোবট’গুলির মধ্যে ফারাক আকাশ-পাতাল। বর্তমানে যে পাইলটহীন যুদ্ধবিমানগুলি রণক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, তা আক্ষরিক অর্থে স্বয়ংক্রিয় নয়। দূরে বসে সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিয়ন্ত্রণ থাকে মানুষের হাতেই। তবে ‘খুনি রোবট’দের এক বার খোলা ছেড়ে দিলে সেটির নিয়ন্ত্রণ আর মানুষের হাতে থাকবে না। পুরোটাই থাকবে যন্ত্রদানবের কৃত্রিম মেধার নিয়ন্ত্রণে।
এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন অস্ত্র কোনও দেশের হাতে নেই। তবে গবেষণা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আমেরিকায় যুদ্ধসরঞ্জাম তৈরির একটি সংস্থা ‘অ্যান্ডুরিল’ এই নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে। বেশ কিছু গবেষণা ইতিমধ্যে সফল। এর মধ্যে একটি ‘ফিউরি’, কৃত্রিম মেধা নির্ভর রোবোটিক যুদ্ধবিমান— কোনও ককপিট নেই, পাইলটও নেই। কারও সাহায্য ছাড়াই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এই যুদ্ধবিমান। ‘রোডরানার’ নামে একটি সমরাস্ত্রও তৈরি করেছে তারা। সেটিও কৃত্রিম মেধানির্ভর। এই অস্ত্রকে এক বার খোলা ছেড়ে দিলে তারা নিজে থেকেই লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। মূলত ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে এটি তৈরি। লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে না পারলে ফিরে আসে। আবার প্রস্তুত হয় দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য।
ক্যালিফর্নিয়ার এই সংস্থার সঙ্গে ইতিমধ্যে বেশ কিছু চুক্তি করে ফেলেছে মার্কিন বাহিনী। অ্যান্ডুরিলের থেকে ‘রোডরানার’ কিনছে আমেরিকা। ‘ফিউরি’ও কেনার কথা ভাবছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘সিবিএস নিউজ়’ অনুসারে, শীঘ্রই মার্কিন আধিকারিকদের সামনে নিজের পরীক্ষা দেবে ‘ফিউরি’। সফল হলে অ্যান্ডুরিলের থেকে ‘ফিউরি’ও কিনতে পারে আমেরিকা। কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন অস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে ভারতও। বেঙ্গালুরুর অস্ত্রনির্মাণকারী সংস্থা ‘ভারত সাপ্লাই অ্যান্ড সাপোর্ট’ (বিএসএস) সম্প্রতি কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন মেশিন গান তৈরি করেছে। সেটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগও হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইজ়রায়েলও ‘খুনি রোবট’ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর। যদিও সংস্থাগুলি কী কী নিয়ে গবেষণা করছে, তা নিয়ে গোপনীয়তার কারণে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ্যে আসে না।
‘খুনি রোবট’দের নিয়ে এই ধোঁয়াশার কারণেই উদ্বেগ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। মানুষের বাঁচা-মরার সিদ্ধান্ত যন্ত্রের হাতে চলে গেলে, তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। তাঁদের আশঙ্কা, কাকে নিশানা করতে হবে, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে তথ্য দেওয়া সম্ভব নয় কৃত্রিম মেধাকে। একটি সাধারণ ধারণা দেওয়া যেতে পারে মাত্র। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক নেহাল ভুটার মতে, কৃত্রিম মেধাকে নিশানা সম্পর্ক কতটা নির্ভুল ধারণা দেওয়া যেতে পারে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
মনুষ্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই রোবট-অস্ত্রগুলি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সাম্প্রতিক এক আলোচনাচক্রে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক দফতরের প্রধান ইজ়ুমি নাকামিৎসু বলেন, “মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া নৈতিক ভাবেই একটি ঘৃণ্য পদক্ষেপ।” তাঁর বক্তব্য, এই ধরনের অস্ত্রের কখনওই অনুমোদন পাওয়া উচিত নয়। আন্তর্জাতিক স্তরে আইন প্রণয়ন করে এটিকে নিষিদ্ধ করা উচিত এবং এটিই রাষ্ট্রপুঞ্জের অবস্থান বলে ব্যাখ্যা করেন নাকামিৎসু।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ’-এর সঙ্কট, সংঘর্ষ এবং অস্ত্র বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ম্যারি ওয়ারহ্যামের বক্তব্য, যুদ্ধক্ষেত্রে কাকে, কখন আক্রমণ করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত মানুষের হাতেই থাকা উচিত। এগুলি যন্ত্রের হাতে চলে গেলে নির্বিচারে গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এমনকি টেসলাকর্তা ইলন মাস্কও এই ‘খুনি রোবট’ তৈরির বিরোধী। এই ধরনের অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ১১৬ জন কৃত্রিম মেধা বিশেষজ্ঞ। সেই তালিকায় ছিলেন মাস্কও।
যদিও এই ‘খুনি রোবট’ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিরও নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। মার্কিন সংস্থা অ্যান্ডুরিলের কর্ণধার পামার লাকি কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন অস্ত্রের ঝুঁকির কথাও স্বীকার করেছেন। তবে তাঁর দাবি, এই সমস্যা মোকাবিলা করার ব্যবস্থাও রয়েছে অ্যান্ডুরিলের অস্ত্রে। সংস্থার তৈরি প্রতিটি রোবট-অস্ত্রে একটি করে ‘কিল সুইচ’ রয়েছে বলে দাবি পামারের। কখনও তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ওই ‘কিল সুইচ’ ব্যবহার করে অস্ত্রটিকে বিকল করা যেতে পারে।