আমেরিকার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে একরকম রাজি হয়ে গিয়েছে ইরান এবং ইজ়রায়েল। কিন্তু তার পরেও তিন পরমাণুকেন্দ্রে মার্কিন হামলার প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে তেহরান। বদলা নিতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে নাশকতার জন্য ‘স্লিপার সেল’কে কাজে লাগাবে সাবেক পারস্য দেশ? উঠছে প্রশ্ন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ ১০:৩১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে আপাতত ইতি। মার্কিন মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়েছে যুযুধান ইরান ও ইজ়রায়েল। যুদ্ধবিরতিতে আমেরিকার দেওয়া ক্ষত ভুলে যাবে তেহরান? ‘হাতুড়ি’র এক ঘায়ে সাবেক পারস্য দেশের পরমাণু বোমা তৈরির স্বপ্নকে যে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী! তার প্রতিশোধ নিতে গোপনে গোপনে তৈরি হচ্ছে সেখানকার কট্টরপন্থী সরকার ও সেনা? গোয়েন্দা সূত্রে সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই প্রমাদ গুনছে ওয়াশিংটন-সহ গোটা বিশ্ব।
০২১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, তিন পরমাণুকেন্দ্রে ‘বি-২ স্পিরিট’ নামের কৌশলগত বোমারু বিমান দিয়ে মার্কিন বায়ুসেনার হামলার বদলা নিতে এ বার ‘ঘুমন্ত কোষ’ মাঠে নামাতে পারে তেহরান। সে ক্ষেত্রে বড় আকারের নাশকতার মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। জীবন এবং সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমেরিকার আক্রমণের পর সেই ইঙ্গিতও দেয় ইরান। সমুদ্র পেরিয়ে ‘স্লিপার সেল’-এর আঘাত হানার কথা বলতে শোনা গিয়েছে শিয়া ফৌজকে।
০৩১৯
আত্মঘাতী হামলা বা পর পর বিস্ফোরণের মাধ্যমে বড় আকারের নাশকতার ছক থাকলে সাধারণত এই ‘স্লিপার সেল’কে কাজে লাগায় বিশ্বের তাবড় গুপ্তচরবাহিনী ও জঙ্গি সংগঠন। একে নিষ্ক্রিয় করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব। কারণ, ‘ঘুমন্ত কোষ’-এর সদস্যেরা সারা বছর জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, এমন নয়। উল্টে আমজনতার সঙ্গে মিশে থাকতেই বেশ পছন্দ করেন তাঁরা। বৈধ চাকরি বা ব্যবসাও থাকতে পারে তাঁদের।
০৪১৯
গোয়েন্দাদের দাবি, এক বার অতি সন্তর্পণে এই ‘ঘুমন্ত কোষ’গুলিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েন তাঁরা। এর পর কয়েক দিনের ব্যবধানে জনবহুল এলাকায় বড় আকারের নাশকতা ঘটিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এঁদের। আমজনতার সঙ্গে মিশে থাকার কারণে তাঁদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। আর তাই ইরানের ওই হুমকিতে বেড়েছে উদ্বেগ।
০৫১৯
তেহরানের হুঁশিয়ারি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন লন্ডনের ‘রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট’-এর গবেষক এইচ এ হেলিয়ার। ‘এনবিসি নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘ইরানের পক্ষে সরাসরি আমেরিকাকে আক্রমণ করা কঠিন। তবে ‘স্লিপার সেল’ ব্যবহারের প্রভূত সুযোগ রয়েছে তাদের। কারণ, লেবাননের হিজ়বুল্লা, ইয়েমেনের হুথি এবং প্যালেস্টাইনপন্থী হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে তেহরান। এগুলি শিয়া ফৌজের ‘তুরুপের তাস’ হতে পারে।’’
০৬১৯
ফলে ইরানের ‘স্লিপার সেল’-এর হুমকিকে মোটেই হালকা ভাবে নিচ্ছে না ওয়াশিংটন। দেশ জুড়ে সমস্ত নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে ‘হাই অ্যালার্টে’ থাকার নির্দেশ দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ ইয়র্ক এবং লস অ্যাঞ্জেলসের পুলিশ বিভাগের জন্য। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ শহরের সমস্ত ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক এলাকায় মোতায়েন হয়েছে অতিরিক্ত বাহিনী।
০৭১৯
পাশাপাশি, এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করতে পারে ইরান। এর জন্য ধর্মীয় নির্দেশ জারি করেছে তেহরানের কট্টরপন্থী নেতারা।’’ ওয়াশিংটনের বিদেশ দফতরের তরফে পশ্চিম এশিয়ায় বেড়াতে যাওয়া নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তাঁদের উপরেও শিয়া মুলুকটির জঙ্গি হামলা নেমে আসতে পারে বলে মনে করছে ট্রাম্প সরকার।
০৮১৯
গত ২২ জুন ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইরানের ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান— এই তিন পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনা। সূত্রের খবর, কৌশলগত স্টেল্থ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোট ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ৩০টি টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ওই তিন আণবিক কেন্দ্রকে নিশানা করে তারা। পরমাণুকেন্দ্রগুলি ভূগর্ভস্থ হওয়ায় ‘জিবিইউ-৫৭’ সিরিজ়ের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা সেখানে ফেলা হয় বলে জানা গিয়েছে।
০৯১৯
এর পরই ইরানে এই হামলাকে অত্যন্ত সফল বলে জানিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লেখেন, ‘‘তেহরানের কাছে আর কোনও বোমা নেই।’’ কিন্তু তার পরেও পরমাণুকেন্দ্রগুলির কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। মার্কিন বায়ুসেনা এই অভিযানের পোশাকি নাম রেখেছে ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’।
১০১৯
আমেরিকার এই আক্রমণের পর চুপ করে বসে থাকেনি ইরান। কাতার, লেবানন এবং সিরিয়া-সহ পশ্চিম এশিয়ার একাধিক মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান। পরে এই নিয়ে বিবৃতি দেয় সাবেক পারস্য দেশের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা সাবেক আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। তাঁদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ছাউনিগুলির মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১১১৯
পশ্চিম এশিয়ার অন্তত ১০টি দেশে ছড়িয়ে আছে আমেরিকার সেনাছাউনি। আগামী দিনে সেখানে হিজ়বুল্লার আক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে বলে স্পষ্ট করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। অতীতে সংঘাতের সময়ে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বহু বার কাজে লাগিয়েছে তেহরান। উদাহরণ হিসাবে ১৯৮৩ সালের কথা বলা যেতে পারে। ওই বছর লেবাননের রাজধানী বেইরুটে মার্কিন দূতাবাস এবং নৌঘাঁটিতে হামলা চালায় তারা। এতে মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
১২১৯
২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে আইআরজিসির শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সুলেমানিকে নিকেশ করে আমেরিকা। ওই ঘটনার বদলা নিতে ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরানি সেনা। ফলে সেখানকার মার্কিন সেনাছাউনির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। তবে এর জেরে সে বার মুখোমুখি সংঘাতে জড়ায়নি দুই দেশ।
১৩১৯
যদিও এ বারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, মার্কিন হামলার প্রতিশোধ প্রসঙ্গে ইরানের তরফে দু’ধরনের বয়ান সামনে এসেছে। সাবেক পারস্য দেশের ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আলি খামেনেইয়ের উপদেষ্টা আলি আকবর বেলায়াতি বলেছেন, ‘‘ইসলামিক বিশ্বের হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে আমেরিকা। এর ফল ভুগতে হবে। আমাদের উপরে আক্রমণ শানাতে যে জায়গাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ব্যবহার করেছে, সেখানে অবশ্যই প্রত্যাঘাত শানাবে আইআরজিসি।’’
১৪১৯
ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের গলাতেও শোনা গিয়েছে হুঁশিয়ারির সুর। যুদ্ধের মধ্যেই তেহরানের আমজনতার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানে মার্কিন হামলার ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। প্রকাশ্যে এসেছে শিয়া ফৌজের সদর দফতর খাতাম আল-আনবিয়ার মুখপাত্র ইব্রাহিম জ়োলফাকারির এক ভিডিয়োবার্তাও। সেখানে আবার আমেরিকার মাটিতে প্রত্যাঘাত হেনে হিসাব চুকিয়ে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
১৫১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, প্রতিশোধের আগুনে সবচেয়ে বেশি ফুটছে আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইআরজিসি। ইরানি আধা সেনা তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘জুয়াড়ি’ বলতেও ছাড়েনি। তাদের হুঁশিয়ারি, ‘‘এই যুদ্ধের শুরুটা আপনি করে থাকতে পারেন, কিন্তু শেষটা আমরাই করব।’’ সাবেক পারস্য দেশের কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল আমির হাতামি আবার বলেছেন, ‘‘অতীতে বহু বার যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছি। প্রতি বারই তাদের কড়া জবাব ফিরিয়ে দিয়েছি। যাতে শান্তিতে থাকতে পারি, তার জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।”
১৬১৯
এই সমস্ত হুমকি-হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও ইরানের পক্ষে খোলা ময়দানে আমেরিকাকে হারানো কঠিন বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। কারণ, অত্যাধুনিক হাতিয়ার এবং সৈন্যশক্তির নিরিখে অনেক এগিয়ে ওয়াশিংটন। কিন্তু, এই যুদ্ধে তেহরান ‘স্লিপার সেল’কে নামালে গোটা পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। কারণ সেটা যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
১৭১৯
আমেরিকার বুকে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আল কায়দা’র সদস্যেরা চারটি বিমান ছিনতাই করে একাধিক জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালায়। ওই আক্রমণে চোখের নিমেষে ধ্বংস হয়ে যায় নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জোড়া অট্টালিকা। এ ছাড়া মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনেও আছড়ে পড়েছিল একটি বিমান।
১৮১৯
৯/১১-র জঙ্গি হামলায় প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া হাজার কোটি ডলারের সম্পত্তি নষ্ট হয় আমেরিকার। তদন্তে প্রকাশ্যে আসে ‘আল কায়দা’র শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনের নাম। এর পর তাকে নিকেশ করতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে যুক্তরাষ্ট্র। সেই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন এনডুয়েরিং ফ্রিডম’। হিন্দুকুশের কোলের দেশে প্রায় ২০ বছর চলে ওই লড়াই। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লাদেনকে খতম করে মার্কিন কমান্ডোরা।
১৯১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ফের ৯/১১ ধাঁচের হামলা চালাতে পারে ইরানি ‘স্লিপার সেল’। সেই আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। সেই কারণে সংঘাত আর বাড়াতে চাননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু, প্রতিশোধের আগুনে পুড়তে থাকা তেহরান প্রত্যাঘাত শানালে চুপ করে বসে থাকবে না ওয়াশিংটন। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের মতো লম্বা সময় ধরে পশ্চিম এশিয়ায় যে যুদ্ধ চলবে, তা বলাই বাহুল্য।