Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

এ কোন আকাশবাণী? মহাকাশ থেকে কে পাঠাল ৭২ সেকেন্ডের বার্তা!

লিখছেন অঙ্কন দাস। লেখক কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স’-এর ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোবায়োলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।একুশ শতকে পৌঁছে এই পৃথিবীর মানবসভ্যতা এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের জট খুলতে পেরেছে। কিন্তু এখনও যে প্রশ্নটির জবাব আমরা কেউই পায়নি, তা হল- এই ‘আদিগন্ত, অতলান্ত’ ব্রহ্মাণ্ডে, আড়ে ও বহরে এই উত্তরোত্তর প্রসারমান ব্রহ্মাণ্ডে আমরা, এই বাসযোগ্য গ্রহ- পৃথিবীর বাসিন্দারা কি একেবারেই একা? নিঃসঙ্গ? নির্বান্ধব? এমনকী, আমাদের কি কোনও ‘শত্রু’ও নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে? উত্তর খুঁজেছেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স’-এর জ্যোতির্রসায়নবিদ অঙ্কন দাস।

এও একটি সাঙ্কেতিক বার্তা। যা ভিনগ্রহীদের পাঠিয়েছিলেন কার্ল সাগান।

এও একটি সাঙ্কেতিক বার্তা। যা ভিনগ্রহীদের পাঠিয়েছিলেন কার্ল সাগান।

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ১১:৩০
Share: Save:

আমরা ডাকছি। কেউ কি শুনছ?

আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি তোমাদের দিকে। তোমরা কি ‘হাত’টা বাড়িয়ে দিয়েছ? বা, অনেক ভেবে-চিন্তে এ বার ‘হাত’টা বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছ?

আমরা তোমাদের সিগন্যাল (বার্তা) পাঠিয়েছি। তোমরা কি সেই বার্তা পেয়েছ ? সেই বার্তার ‘ভাষা’ (কোডেড ল্যাঙ্গোয়েজ) কি তোমরা বুঝতে পেরেছ? মানে, আমরা কি তোমাদের বোঝাতে পেরেছি? পেরেছ কি আমাদের পাঠানো সেই সব সিগন্যালকে ‘ডি-কোড’ করতে?


ভিনগ্রহীদের আমরা যে বার্তা পাঠিয়েছি।

হয়তো আমরা মনে করছি, কী সব জটিল ‘কোড’ তোমাদের পাঠিয়ে ফেলেছি! আর তোমরা ভাবছ, খেলার ছলে ‘কোথাকার কোন শিশু’রা কী সব আজেবাজে বকছে! কী সব খেয়ালের অদ্ভূতুড়ে আঁকাজোকা করছে! পাঠাচ্ছে!


ভিনগ্রহীদের আমরা যে বার্তা পাঠিয়েছি।

আড়ালে বসে হাসছে সেই ‘বিরাট শিশু’! ‘যে’ এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বানিয়েছে! আমাদের বানিয়েছে। তোমাদেরও!

একুশ শতকে পৌঁছে এই পৃথিবীর মানবসভ্যতা এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের জট খুলতে পেরেছে। কিন্তু এখনও যে প্রশ্নটির জবাব আমরা কেউই পায়নি, তা হল- এই ‘আদিগন্ত, অতলান্ত’ ব্রহ্মাণ্ডে, আড়ে ও বহরে এই উত্তরোত্তর প্রসারমান ব্রহ্মাণ্ডে আমরা, এই বাসযোগ্য গ্রহ- পৃথিবীর বাসিন্দারা কি একেবারেই একা? নিঃসঙ্গ? নির্বান্ধব? এমনকী, আমাদের কি কোনও ‘শত্রু’ও নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে? আমরা রাতের আকাশে কত কত তারা দেখি, তাদের মধ্যে এমন কি একটিও তারা নেই, যার একটি গ্রহে অন্তত, অস্তিত্ব রয়েছে প্রাণের?

সেই ‘প্রাণ’ বলতে আমরা কিন্তু শুধুই আমাদের মতো ‘মানুষ জাতীয় প্রাণী’ বোঝাচ্ছি না। ‘প্রাণ’ মানে সেটি যে কোনও রকমের প্রাণই হতে পারে। হতে পারে তা কোনও এক কোষী প্রাণীও। এই কার্যত অনন্ত, আদিগন্ত মহাবিশ্বে আমাদের এই বাসযোগ্য পৃথিবী এমন কোনও ‘বিশেষ জায়গা’ নয় যে, এখানেই একমাত্র প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে! কারণ, অন্য অন্য গ্রহের মতোই পৃথিবীরও জন্ম হয়েছে প্রকৃতির একেবারে স্বাভাবিক নিয়মেই।

তা হলে, শুধুই কেন বুদ্ধিমান প্রাণীর বিকাশ ঘটল পৃথিবীতে? ঘটল, কারন পৃথিবীতে প্রাণের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল বলে, রয়েছে বলে। সেটা কেমন? পৃথিবী সুর্যের চার দিকে মোটামুটি একটি বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। ফলে, পৃথিবী সারা বছর মোটামুটি একটা গড় তাপমাত্রা বজায় রেখে চলছে। এটা না হয়ে যদি পৃথিবীর কক্ষপথটি এমন হতো, যাতে তাপমাত্রার ফারাকটা হতো অনেক বেশি, তা হলে সে ক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিমান প্রাণে’র (ইন্টেলিজেন্ট লাইফ) বিকাশ আদৌ সম্ভবই হতো না পৃথিবীতে।


ভিনগ্রহীদের আমরা যে মোর্স কোড পাঠিয়েছি।

এখন যদি জানতে চাই, আমরা এই মহাবিশ্বে একেবারেই নিঃসঙ্গ কি না, তা হলে আমাদের লক্ষ্যটা হবে-আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করা। আর সেই ‘প্রাণ’ খুঁজতে গেলে হয় আমাদের সেখানে যেতে হবে, না হলে তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের কোনও ‘সংবাদ’ বা ‘বার্তা’ অথবা কোনও ‘সিগন্যাল’ পাঠাতে হবে।

যেহেতু আমাদের এই সৌরজগতের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে যাওয়াটা বাস্তবে এক রকম অসম্ভব বললেই চলে, তাই আমাদের যোগাযোগের একমাত্র উপায়টাই হল, তাদের উদ্দেশ্যে ‘সংবাদ’ পাঠানো। আর যেহেতু ‘সিগন্যাল’ পাঠানো ছাড়া সেই জগতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ গড়ে তোলার আর কোনও উপায় আমাদের হাতে নেই, তাই আমাদের ‘সংবাদ’টিকে এমন হতে হবে, যাতে তার মানে বুঝতে পারে ভিন গ্রহের ‘প্রাণী’রা।

আর তার জন্য একটি গাণিতিক সমীকরণ দিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেক। ১৯৬১ সালে। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, আমাদের গ্যলাক্সি- ‘মিল্কি ওয়ে’র কতগুলি জায়গার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারি, তার সংখ্যা। ড্রেকের মতে, সেই সংখ্যাটি নীচের গাণিতিক সমীকরণের কয়েকটা ‘ফ্যাক্টর’-এর ওপরেই নির্ভর করে।

সমীকরণটা হল-

N= R fp ne fl fi fc L

এখানে, ‘R’ হল প্রতি বছরে আমাদের গ্যালাক্সিতে ক’টি করে নতুন তারার জন্ম হচ্ছে, তার সংখ্যা। প্রতিটি তারার চার দিকেই গ্রহ থাকবে, এমনটা নয়। আবার একটি তারার চার দিকে অনেকগুলি করে গ্রহ থাকতে পারে। ‘fp ঠিক করছে কত ফ্র্যাকশান (ভাগ) তারার চার দিকে গ্রহ রয়েছে, তার সংখ্যা। ‘ne ঠিক করছে একটি তারার চার দিকে গড়ে ক’টি তারা থাকবে, যাতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব, তার সংখ্যা। ‘fl বোঝাচ্ছে, কত ফ্র্যাকশান (ভাগ) গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে। ‘fi বোঝাচ্ছে, কত ভাগ গ্রহের ভেতর সেই প্রাণটি একটি বুদ্ধিমান প্রাণে উন্নীত হচ্ছে। ‘fc দিয়ে বোঝানো হচ্ছে, সেই গ্রহগুলির মধ্যে কত অংশ একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলার সহায়ক হতে পারে। আর, ‘L’ দিয়ে বোঝানো হচ্ছে, সভ্যতার গড় আয়ু।


ভিনগ্রহীদের আমরা যে বার্তা পাঠিয়েছি।

অধ্যাপক ড্রেকের মতে, আমরা ওপরের গাণিতিক সমীকরণের সাতটি ফ্যাক্টরের জন্য যদি একটি করে আনুমানিক সংখ্যা (মান) বসাই, তা হলেই আমরা মোটামুটি ভাবে আন্দাজ করতে পারব, আমাদের গ্যলাক্সিতে (‘মিল্কি ওয়ে’) কতগুলি জায়গায় বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে পারে।

অধ্যাপক ড্রেক নিজেই ওপরের গাণিতিক সমীকরণের সাতটি ফ্যাক্টরের জন্য এই এই আনুমানিক সংখ্যাগুলি বসিয়েছিলেন,

R= ১। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছরে একটি করে নতুন তারা তৈরি হচ্ছে আমাদের গ্যলাক্সিতে (যদিও আধুনিক মতে, ‘মিল্কি ওয়ে’তে প্রতি বছর গড়ে ৭ টি করে নতুন তারা জন্মাচ্ছে।)

fp= ০.২ থেকে ০.৫। এর মানে, এই তারাগুলির কম করে এক-পঞ্চমাংশ থেকে শুরু করে সর্বাধিক অর্ধেকের চার পাশে গ্রহ রয়েছে। যেখানে ‘প্রাণে’র অস্তিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে। (যদিও আধুনিক মতে এটি ১)।

ne= ১ থেকে ৫। অনেকগুলো গ্রহের মধ্যে কম করে ১টি এবং সর্বাধিক ৫টি গ্রহ রয়েছে যেগুলি ‘প্রাণ’ সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত। কেপলার মিশন থেকে পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে, fp ne-এর মান ০.৪)।

fl= ১। এর মানে, উপযোগী পরিবেশ ‘প্রাণ’ তৈরি করবেই।

fi=১। যার মানে, পরিবেশ সহায়ক হলে সেই ‘প্রাণে’র উত্তরণ ঘটবে। তা একটি বুদ্ধিমান প্রাণীতে উন্নীত হবে।

fc=০.১ থেকে ০.২। এর মানে, ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের ১০ থেকে ২০ শতাংশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।

L= ১০০০ থেকে ১০০,০০০,০০০ বছর। এটা এই সভ্যতার টিঁকে থাকার গড় আয়ু। মাইকেল শ্রিমার পৃথিবীর ৬০টি সভ্যতার গড় আয়ু বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, L-এর মান ৪২০ ধরা যেতে পারে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার জন্য তিনি এটির যে মান নির্ধারণ করেন, তা হল- ৩০৪)।

ড্রেকের এই সংখ্যাগুলি যদি আমরা ওপরের সমীকরণে বসাই, তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ‘N’-এর সর্বনিম্ন সংখ্যা ২০ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যাটা হয়- ৫০,০০০,০০০। তার মানে, আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে’ গ্যলাক্সিতে খুব কম করে ২০টি জায়গায় এবং খুব বেশি হলে ৫০,০০০,০০০টি জায়গায় এমন ‘প্রাণ’ থাকতে পারে, যাদের সভ্যতা এতটাই উন্নত যে, আমাদের পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব। তা হলে দেখা গেল, এই ব্রহ্মাণ্ডের বহু জায়গাতেই প্রাণ থাকতে পারে। ফলে, এই মহাবিশ্বে আমরা একেবারে নিঃসঙ্গ নই।

এখনও পর্যন্ত আমরা ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কী কী চেষ্টা চালিয়েছি?

১) ‘দ্য মর্স মেসেজ’

এটি ছিল এই ধরনের প্রথম প্রচেষ্টা। যা পাঠানো হয়েছিল শুক্র গ্রহের দিকে। ১৯৬২ সালে। এটি পাঠানো হয়েছিল ‘Yevpatoria RT-70 Radio Telescope’ এবং planetary radar থেকে। যা ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় ইয়েভপাতোরিয়ায় ‘Centre for Deep Space Communications’-এ রয়েছে। এটিতে বার্তা পাঠানো হয়েছিলো ‘Morse code’-এর আকারে। ‘Morse code’ কী জিনিস? এটা হল কোনও ভাষার letter-কে ‘code’-এ বদলে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। যা দিয়ে আমরা টেলি-যোগাযোগ করতে পারি। মোট দু’বার বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল। প্রথমে যেটি পাঠানো হয়েছিল, তাতে শুধুই পাঠানো হয়েছিল একটি শব্দ- ‘MIR’। রুশ ভাষায় যার মানে ‘শান্তি’ এবং ‘বিশ্ব’। দ্বিতীয় বার্তাটিতে পাঠানো হয়েছিল, আরও একটি শব্দ- ‘LENIN’ (বলশেভিক নেতার নাম) এবং ‘SSSR’ (সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক নাম)।


ভিনগ্রহীদের আমরা যে বার্তা পাঠিয়েছি।

২) অ্যারিসিবো মেসেজ

এটি ছিল এই ধরনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। যা পাঠানো হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৬ই নভেম্বর। পুয়ের্তো রিকোয় ‘Arecibo Radio Telescope’ থেকে। বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল গ্লোবিউলার স্টার ক্লাস্টার ‘M13’-র দিকে। যা আমাদের থেকে ২৫,০০০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। ওই বার্তাটিতে ১৬৭৯টি Binary digit রয়েছে। যার সাইজ ছিল ২১০ বাইট্‌স। সেই বার্তাটি পাঠানো হয়েছিল ২৩৮০ মেগা-হার্ৎজ কম্পাঙ্কে। বার্তাটি শুধুই ‘১’ এবং ‘০’ দিয়ে লেখা। যা দেখে সাধারণ ভাবে বোঝা খুব মুশকিল যে, তাতে কী রয়েছে। বোঝার সুবিধার জন্য যদি তাকে রঙিন করে তোলা যায়, তা হলে তা কিছূটা বোঝার মতো দেখতে হয়। ভাল ভাবে রঙিন ছবিটির দিকে দেখলে বোঝা যায়, সেই বার্তায় মোট ৭টি ভাগ রয়েছে। সাংকেতিক এই বার্তাটি এতটাই জটিল, এক বার দেখে যা কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়। আসলে ওই বার্তার মূল লক্ষ্য ছিল, ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী। যাতে তারা সেই বার্তাটি decode করতে পারে। তার ভিতরে কী লেখা রয়েছে, তা বুঝতে পারে। আর, আমাদের উদ্দেশেও তারা কিছু বার্তা পাঠাতে পারে।

এ বার দেখে নেওয়া যাক, ওই বার্তার ৭টি ভাগে কী কী রয়েছে?

প্রথম ভাগঃ এখানে রয়েছে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যা। যেগুলি আমরা ব্যবহার করি। সেগুলি binary digit-র মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগঃ এখানে আমাদের ‘প্রাণ’ তৈরির ক্ষেত্রে যে সমস্ত উপাদানের প্রয়োজন হয় (যেমন, হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ও ফসফরাস), তাদের ‘atomic number’ বা পরমাণু ক্রমাঙ্ক বলা হয়েছে।

তৃতীয় ভাগঃ এখানে আমাদের ‘প্রাণ’ তৈরির জন্য অন্যতম উপাদান সুগার বা চিনি এবং ‘bases’, যা DNA-র ‘nucleotide’-এ থাকে, তাদের সঙ্কেত বোঝানো হয়েছে।

চতুর্থ ভাগঃ DNA-তে কতগুলি ‘nucleotide’ রয়েছে এবং DNA-এর ‘double helix structure’টি ঠিক কেমন দেখতে, তা বলা হয়েছে। তখনকার দিনের হিসেব অনু্যায়ী, DNA-তে ‘nucleotide’ থাকতে পারে ৪.৩ x ১০৯ টি। সেই সংখ্যাটাই এখানে বোঝানো হয়েছে।

পঞ্চম ভাগঃ এখানে দেখানো হয়েছে মানুষের আকৃতি কেমন। তার গড় উচ্চতা কত এবং আমাদের পৃথিবীর জনসংখ্যা। মাঝের দিকে মানুষের আকৃতি, বাঁ দিকে মানুষের গড় উচ্চতা (৫ ফুট ৯.৪৫ ইঞ্চি) এবং ডান দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা বোঝানো হয়েছে। তখনকার গণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৪.৩ x ১০৯ ।

ষষ্ঠ ভাগঃ আমাদের সৌরজগতকে বোঝানো হয়েছে। পৃথিবীটি একটু উপরে দেওয়া আছে এটা বোঝাতে যে, এখান থেকে বার্তাটি পাঠানো হচ্ছে। সেই সময় ‘প্লুটো’কে গ্রহ হিসেবে গণ্য করা হতো। তাই এই তালিকায় ‘প্লুটো’ জায়গা পেয়েছিল।

সপ্তম ভাগঃ অ্যারিসিবো রেডিও টেলিস্কোপের আকৃতি এবং তার অ্যান্টেনার ব্যাস বোঝানো হয়েছে। ছবির নীচের দু’টি লাইনের binary digit-কে রূপান্তরিত করলে আমরা যে মানটি পাই, তা হল- ২,৪৩০। তাকে যদি আমরা গুণ করি, যে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যে তা ছাড়া হয়েছিল, তা দিয়ে, তা হলে যে মানটি পাই, সেটা হল- ৩০৬.১৮ মিটার। এটাই রেডিও টেলিস্কোপের ব্যাস।

সহজেই বোঝা যাচ্ছে, একটি অসম্ভব জটিল বার্তা পাঠানো হয়েছিল, যেটি একমাত্র উন্নত কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর পক্ষেই বোঝা সম্ভব হয়।

আর কী কী বার্তা পাঠানো হয়েছিল?

১) কসমিক সেল মেসেজ

এটি পাঠানো হয়েছিল ক্রিমিয়ার ‘RT-70 Radio Telescope’ থেকে। ১৯৯৯-এ পাঠানো হয় ‘কসমিক সেল-ওয়ান’ এবং ২০০৩ সালে পাঠানো হয়েছিল ‘কসমিক সেল-টু’। ওই বার্তাগুলিতে অ্যারিসিবোর বার্তাটিও পাঠানো হয়েছিল। আর তা পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন তারার উদ্দেশে। তার মধ্যে সবচেয়ে কাছেরটি হোল- ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ‘GI-777’-এর উদ্দেশে। তা পাঠানো হয়েছিল ২০০৩ সালের ৬ই জুলাই। বার্তাটি সেখানে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৩৩ বছর। অর্থাৎ, ওই গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছবে ২০৩৬ সালের এপ্রিলে।

২) টিন এজ মেসেজ

এটি পাঠানো হয়েছিল ২০০১ সালে, সুর্যের মতো ৬টি তারার দিকে। সেই বার্তায় পাঠানো হয়েছিল পৃথিবীর অত্যন্ত আশ্চর্য এক আবিষ্কার- ‘music’। ওই বার্তায় ‘Theramin’ (একটি ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র)-এ বাজানো ‘music’ পাঠানো হয়েছিল। সঙ্গে ছিল অ্যারিসিবোর ডিজিটাল বার্তাটি। খুব কাছের একটি তারা- ‘HD 95128’ কে লক্ষ্য করে তাকে পাঠানো হয়।

৩) আ মেসেজ ফ্রম আর্থ

এটি ২০০৮ সালে পাঠানো হয় ‘Gliece 581-c’-এর দিকে। ইউক্রেন স্টেট স্পেস এজেন্সির ‘RT-70 Radar Telescope’ ব্যবহার করে। সেই বার্তায় মোট ৫০১টি ‘সংবাদ’ পাঠানো হয়েছিল। আর, সেগুলি বেছে নেওয়া হয়েছিল একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ‘বেবো’ থেকে। একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। ওই মেসেজটি ‘Gliece 581-c’-তে পৌঁছবে ২০২৯ সাল নাগাদ।

পাঠানো হয়েছিল আরও কিছু বার্তা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘Across the Universe’, ‘Hello from Earth’ ইত্যাদি। এত ক্ষণ দেখলাম, আমরা কী কী চেষ্টা চালিয়েছি এত দিন ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য।

কী বার্তা পেয়েছি ভিনগ্রহীদের কাছ থেকে?

এ বার দেখি, ভিনগ্রহীদের থেকে আমরা কিছু পেয়েছি কি না। এখনও পর্যন্ত একটি মাত্র বার্তা বা ‘সিগন্যাল’ আমরা পেয়েছি। যাকে ভিনগ্রহীদের কাছ থেকে আসা বলেই মনে করা যেতে পারে। তার নামটি হোল- ‘WOW message’।

১৯৭৭ সালের ১৫ অগস্ট, জেরি এহম্যান ওই ‘ন্যারো-ব্যান্ড রেডিও সঙ্কেতটি’কে দেখেছিলেন। তিনি সেই সময় ‘SETI’ প্রজেক্টে কাজ করছিলেন দ্য ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ‘বিগ ইয়ার রেডিও টেলিস্কোপ’ নিয়ে। ওই সঙ্কেতটি আচমকা পেয়ে তিনি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, বার্তাটির প্রিন্ট-আউটের ওপর লিখে দিয়েছিলেন- ‘Wow!’। বার্তাটি এসেছিল ‘M-55’-এর গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে। যেটি রয়েছে স্যাজিটেরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ‘শি স্যাজিটারি’ নক্ষত্র-ঝাঁকের কাছে। ওই ‘স্ট্রং সিগন্যাল’টি মোট ৭২ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল। এর পর বহু বার চেষ্টা করেও সেই সঙ্কেতটি আর দ্বিতীয় বার ধরা পড়েনি। ভিনগ্রহীদের পাঠানো সেই বার্তার ৩৫ বছর পূর্তি হয় ২০১২ সালে। সেই উপলক্ষে অ্যারিসিবো অবজারভেটরি থেকে ১০,০০০ টুইটার বার্তা পাঠানো হয়েছে, যে দিক থেকে এসেছিল ‘Wow!’, সেই দিকে।


ভিনগ্রহীদের পাঠানো সেই Wow মেসেজ! জট খোলেনি রহস্যের।

এখন ভরসা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও রুশ ধনকুবের ইউরি মিলনরের স্বপ্নের প্রকল্প ‘ব্রেকথ্রু-লিস্‌ন’ বা ‘ব্রেকথ্রু-স্টারশট’। যার মাধ্যমে আগামী ৪০/৫০ বছরের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টাউরির গ্রহ-উপগ্রহগুলো থেকে আমরা পেয়ে যেতে পারি ভিনগ্রহীদের ‘সিগন্যাল’! হয়তো বা!

মানুষ যে বার বারই প্রমাণ করেছে, কোনও স্বপ্নই ‘স্বপ্ন’ নয়। আদতে তা সত্যি। নির্ভেজাল সত্যি!


ভিনগ্রহীদের আমরা যে বার্তা পাঠিয়েছি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy