যে বরফের পাহাড় দেখা গিয়েছে গ্রহাণু ‘সেরেস’-এ।
আরও প্রচুর বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ (ক্রায়ো-ভলক্যানো) লুকিয়ে রয়েছে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যে থাকা গ্রহাণুপুঞ্জ (অ্যাস্টারয়েড বেল্ট) ‘সেরেস’-এ? মাত্র একটা নয়? আরও আরও অনেকগুলো? সেগুলোর খোঁজখবর এখনও পাইনি আমরা?
একেবারে হালের একটি গবেষণাপত্রে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। বরফেরও যে ‘আগ্নেয়গিরি’ হয়, তা প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল ২০১৫ সালে।
যখন নাসার মহাকাশযান ‘ডন’-এর তোলা ছবিতে দেখা গিয়েছিল গ্রহাণুপুঞ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রহাণু ‘সেরেস’-এ মাথা উঁচিয়ে রয়েছে ‘আহুনা মন্স’ নামে একটি বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা ক্রায়ো-ভলক্যানো। যার উচ্চতা ৪ কিলোমিটার। মানে, আমাদের মাউন্ট এভারেস্টের যতটা উচ্চতা, তার ঠিক অর্ধেক উচ্চতা ‘সেরেস’-এর ওই বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’র। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এত দিন ধারণা ছিল , এই ধরনের বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা ক্রায়ো-ভলক্যানো হয়তো আরও অনেক লুকিয়ে রয়েছে এই সৌরমণ্ডলের ‘গ্রহ’ প্লুটো বা বৃহস্পতি ও শনির চাঁদ- ইউরোপা , ট্রাইটন, শ্যারন ও টাইটান-এ। কিন্তু ‘সেরেস’-এ এমন বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ হয়তো আর নেই।
‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ বলতে কী বোঝায়?
‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’রই অন্য নাম- ‘আইস ভলক্যানো’। বা , ‘বরফের আগ্নেয়গিরি’। যা একেবারে আগ্নেয়গিরির মতোই। কিন্তু সেখান থেকে ‘আগুনের গোলা’ বা গলতে থাকা পাথর যে ভাবে বেরিয়ে আসে , ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ থেকে তেমন কোনও ‘আগুনের গোলা’ বেরিয়ে আসে না। তার বদলে ভেতর থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসে জলের কণা, অ্যামোনিয়া, বা মিথেন। এদের যৌথ ভাবে বলে, ‘ক্রায়ো-ম্যাগমা’ বা, ‘আইস-ভলক্যানিক মেল্ট’। এগুলি মূলত থাকে তরল অবস্থায়। যা ধোঁয়ারও জন্ম দেয়। গ্যাসীয় অবস্থাতেও থাকতে পারে।
শনির চাঁদে ‘বরফের আগ্নেয়গিরি’ বা, ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’: ভিডিও
পৃথিবীতেও কি ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ দেখা যায়?
একমাত্র দেখা যায়, লেক সুপিরিয়রের দক্ষিণ উপকূলে। এটা মূলত দেখা যায় উপকূলের পরকুপাইন পার্বত্য এলাকায়। শীত কালে। ওই সময় লেক সুপিরিয়রের জল জমে বরফ হয়ে যায়। সেখান থেকেই ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসে জল আর বরফের কণা, ধোঁয়া।
বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা, ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’
‘সেরেসে’র বুকে সেই বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা, ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ (সাদা বরফের চিহ্ন)
হালের গবেষণা বিজ্ঞানীদের সেই ধারণারই মর্মমূলে সজোরে ধাক্কা দিল। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স’-এ প্রকাশের জন্য গৃহীত একটি গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, ‘আহুনা মন্স’-এর মতো ‘সেরেস’-এর অন্তরে-অন্দরে আরও অনেক বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্টই। সেই ‘আগ্নেয়গিরি’গুলি হয়তো ছিল লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বছর আগে।
তা হলে সেই বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’গুলিকে এখন আর দেখা যায় না কেন?
শনির চাঁদ ‘এনসেলাডাস’-এ বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’র ‘অগ্নুৎপাত’...
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’গুলি হয় নীচে চেপে বসে গিয়েছে (ফ্ল্যাটেন্ড) বা ‘সেরেস’-এর পিঠে সেঁধিয়ে গিয়েছে।
এত দিন ধাঁধাটা ছিল কোথায়?
হঠাৎ অমন একটা বরফের উঁচু পাহাড় কী ভাবে আর কেনই-বা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে গেল গ্রহাণু ‘সেরেস’-এর বুকে, তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ-সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মনে। আর ‘আহুনা মন্স’-এর বরফের পাহাড়ের ঢালটা যে অতটা খাড়াই, তারও কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এটা থেকেই মনে করা হচ্ছিল, অতটা খাড়াই যখন ‘আহুনা মন্স’-এর পাহাড়ের ঢাল, তখন নিশ্চয়ই সেই পাহাড়টা তৈরি হয়েছে খুব সম্প্রতি। মানে, সেই পাহাড়টা তৈরি হওয়ার জন্য ‘সেরেস’-এর ভূ-স্তরের ওলটপালট খুব বেশি দিন আগে হয়নি।
কোন দুই সম্ভাবনার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা?
যেমন দেখতে লাগে বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা, ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’-কে...
এক, ‘সেরেস’-এর বুকে ‘আহুনা মন্স’-এর মতো বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ আর একটিও নেই। আর সেই ‘বিরল’ বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’টি খুব বেশি দিন আগে তৈরি হয়নি ‘সেরেস’-এর বুকে।
দুই, ‘সেরেস’-এর বুকে এমন ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ আরও অনেক রয়েছে। তবে সেই সবক’টিই লুকোনো। বা, সেগুলি ‘সেরেস’-এর ভূ-স্তরে কোনও অস্বাভাবিক বা অজানা ওলটপালটের জন্য কোনও এক সুদূর অতীতে হারিয়ে গিয়েছে বা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শুধু একটি ক্রায়ো-ভলক্যানোই এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছে। তার নাম- ‘আহুনা মন্স’।
যে ভাবে তৈরি হয় বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা, ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’
কী ভাবে সেই ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’গুলি হারিয়ে গিয়েছে ‘সেরেস’-এর বুক থেকে?
গবেষকরা একটি উপায়ের কথাও বাতলেছেন তাঁদের গবেষণাপত্রে।
আরও পড়ুন- আসছে ডেঙ্গি, জিকা, ক্যানসারের নতুন ওষুধ, সৌজন্যে ক্রায়ো-ইএম
পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরিগুলি হারিয়ে যায় বায়ুমণ্ডলের বাতাস, বৃষ্টি আর বরফের তোড়ে বা ‘তোপে’র মুখে। কিন্তু গ্রহাণু ‘সেরেস’-এ কোনও বায়ুমণ্ডল নেই। তাই বাতাস, বৃষ্টি বা বরফের ‘দাপটে’ তাদের (ক্রায়ো-ভলক্যানো) হারিয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই ওই গ্রহাণুতে।
গ্রহাণু ‘সেরেস’, যার গায়ে সেই ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’ (সাদা দাগ)
সে ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি উপায়ে সেগুলির হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে গবেষকদের অনুমান। সেই পদ্ধতির নাম- ‘ভিসকাস রিল্যাক্সেশন’।
‘ভিসকাস রিল্যাক্সেশন’ কী জিনিস?
খুব কনকনে ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা মধুকে অনেকটা কঠিন পদার্থের মতো লাগে। কিন্তু অনেকটা সময় কেটে গেলে দেখা যায়, সেই ‘কঠিন’ মধু ধীরে ধীরে গলে যায়। তার পর এক সময় সেই মধুর ‘কঠিন’ চেহারাটা একেবারেই হারিয়ে যায়। এটাকেই বলে ‘ভিসকাস রিল্যাক্সেশন’।
এই ‘ভিসকাস রিল্যাক্সেশন’-এর মাধ্যমেই গ্রহাণু ‘সেরেস’-এর বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে তার লক্ষ-কোটি বছর আগেকার বরফের ‘আগ্নেয়গিরি’ বা ‘ক্রায়ো-ভলক্যানো’গুলি।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy