নোবেল স্মারক।- ফাইল চিত্র।
ব্রহ্মাণ্ডের ‘পুকুর’-এ একটা ‘ঢিল’ পড়েছিল সেই কবে! আলোর গতিতে ছুটলে ১৩০ কোটি বছর আগেকার ঘটনা! তার পর যেমন হয়, একটা তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সেই তরঙ্গের কোনও কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না পৃথিবীতে। কোটি কোটি বছর আগেকার সেই তরঙ্গ শেষমেশ পৃথিবীর ‘ঘাট’-এ ভিড়েছিল এই সে দিন। বছরদু’য়েক আগে।
মূলত যাঁদের কৃতিত্বে সেই কোটি কোটি বছর আগেকার তরঙ্গ ধরা পড়েছিল আমেরিকার লিভিংস্টোন আর হ্যানফোর্ডে বসানো দু’টি ডিটেক্টরের চোখে, সেই তিন বিজ্ঞানীকেই এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। রাইনার ওয়েস, ব্যারি সি ব্যারিশ এবং কিপ এস থর্ন। প্রথম জন জার্মান। বাকি দুই বিজ্ঞানী আমেরিকার নাগরিক। ১০০ বছর আগে এই তরঙ্গের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে। যার নাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ।
এই তরঙ্গের কথা ১০০ বছর আগে বলেছিলেন বটে আইনস্টাইন, কিন্তু সেই তরঙ্গ অত্যন্ত দুর্বল বলে তাঁর নিজেরও সন্দেহ-সংশয় ছিল, আদৌ তার হদিশ মিলবে কি না। বা তা কবে মিলবে। ফলে ১০০ বছর ধরে কিছুতেই পরীক্ষায় পাশ করতে পারছিলেন না আইনস্টাইন।
এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে তিন নোবেলজয়ী। (বাঁ দিক থেকে) রাইনার ওয়েস, ব্যারি সি ব্যারিশ ও কিপ এস থর্ন
হয়তো ১০০ বছর পরেও পাশ করতে পারতেন না আইনস্টাইন, যদি না গত শতাব্দীর সাতের দশকের মাঝামাঝি বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী রাইনার ওয়েস বলতেন, সম্ভব। মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিশ পাওয়া সম্ভব, হ্যাঁ, পৃথিবীতে বসেই! পরে ওয়েসের বক্তব্যকে আরও শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়েছিলেন ব্যারি সি ব্যারিশ ও কিপ এস থর্ন। এই প্রথম এই ধরনের তরঙ্গের হদিশ মেলায় ১৩৭০ কোটি বছরের পুরনো ব্রহ্মাণ্ডের অনেক অজানা ঘটনা জানাক অনেক অচেনা মহাজাগতিক বস্তুর সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনার দরজাটা খুলে গেল। কারণ, এত দিন আমরা ব্রহ্মাণ্ডের নানা রকমের বস্তুর দেখা পেতাম আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের হাত ধরে। এ বার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মতো ঢেউও কয়েকশো কোটি বছর পর পৃথিবীতে আছড়ে পরে আমাদের জানিয়ে দিতে পারবে, কোনও ঘটনা ঘটেছিস সুদূর অতীতে। যেমন ২০১৫ সালে জানা গিয়েছিল অত কোটি বছর আগে ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে।
যে ভাবে ‘লাইগো’ ডিটেক্টরে প্রথম ধরা পড়েছিল মহাকর্ষীয় তরঙ্গ
আরও পড়ুন- শরীরের নিজস্ব ঘড়িকে চিনিয়ে তিন বিজ্ঞানীর নোবেল
আরও পড়ুন- শরীরের দিনরাত্রি বুঝিয়েই বাজিমাত
যাঁদের জন্য ১০০ বছর পর জটিল পরীক্ষায় পাশ করতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন, তাঁরা নোবেল পুরস্কার পাবেন না, তা কি হয়? তাই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম আবিষ্কারের দু’বছরের মধ্যেই নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হল ওয়েস, ব্যারিশ ও থর্নকে। যারা নোবেল পুরস্কার দেয়, সেই রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস জানিয়েছে, পুরস্কারের অর্থমূল্য ৯০ লক্ষ ক্রোনার (সুইডিশ মুদ্রায়) ভাগ করা হয়েছে দু’ভাগে। এক ভাগ পেয়েছেন রাইনার ওয়েস। বাকি অর্ধেক ভাগ করে নিয়েছেন ব্যারি সি ব্যারিশ ও কিপ এস থর্ন।
আলোর গতিতে ছুটলে ১৩০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্তে দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি (কলিশন) হয়েছিল অসম্ভব জোরে। তাতে ওই দু’টি ব্ল্যাক হোল একে অন্যের দেহে লীন হয়ে গিয়েছিল। পুকুরে ঢিল ফেললে যেমন জোরালো তরঙ্গ বা ঢেউয়ের জন্ম হয়, ব্রহ্মাণ্ডে অত কোটি কোটি বছর আগে ওই দু’টি ব্ল্যাক হোলের ধাক্কাধাক্কিতেও তেমনই জন্ম হয়েছিল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের।
সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। শিল্পীর কল্পনায়
অতলান্ত ব্রহ্মাণ্ড সাঁতরানোর পর ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকার লিভিংস্টোন ও হ্যানফোর্ডে বসানো দু’টি লাইগো ডিটেক্টরে ধরা পড়েছিল সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। প্রথমে লিভিংস্টোনে। আর তার ৭ মিলিসেকেন্ড পর হ্যানফোর্ডে।
এই ব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে মোট ৪ ধরনের বল। দুর্বল বল বা উইক ফোর্স, শক্তিশালী বল বা স্ট্রং ফোর্স, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল বা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফোর্স আর মহাকর্ষীয় বল বা গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স। এই ৪ বলের মধ্যে অত্যন্ত দুর্বল বল দু’টি। মহাকর্ষীয় বল আর দুর্বল বল। তাই এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে অত্যন্ত দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল খোদ আইনস্টাইনেরই।
পরবর্তী কালে বিজ্ঞানীরাও যখন কোনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না, সেই সময় গত শতাব্দীর সাতের দশকের মাঝামাঝি রাইনার ওয়েসই প্রথম দেখিয়েছিলেন, শুধু খুব দুর্বল বলেই নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ডে নানা রকমের এতশত ‘গোলমাল’ (নয়েজ), এত রকমের সিগন্যাল রয়েছে যে সেখান থেকে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে আলাদা করে চেনার কাজটাও অত্যন্ত জটিল।
কিন্তু মেধার কাছে জটিল নয় যে কোনও কিছুই, মানুষ যে ব্রহ্মাণ্ডের অনেক সুজটিল রহস্যের জটও খুলতে পারে আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে সেই রাস্তাও দেখিয়েছিলেন ওয়েস। লেসার-ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি (লাইগো)-র ডিটেক্টর বানিয়ে। যে ডিটেক্টরকে পরে আরও গবেষণা দিয়ে সর্বাধুনিক করে তোলেন অন্য দুই পদার্থবিজ্ঞানী ব্যারিশ ও থর্ন।
তারই স্বীকৃতি মিলল প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর তাঁদের নোবেল প্রাপ্তিতে।
আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনে যে দূরত্বে রয়েছে ‘লাইগো’র দু’টি ডিটেক্টর
আমেরিকার লাইগো প্রোজেক্টে জড়িত ছিলেন ভারত সহ বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশের হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী। ছিলেন জনাচল্লিশেক ভারতীয় বিজ্ঞানীও।
ফলে ওয়েস, ব্যারিশ ও থর্নের এই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণাকেও স্বীকৃতি দিল বিশ্বের দরবারে।
ওই লাইগো ডিটেক্টরেই ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বার ধরা দেয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই আবিষ্কারের ঘোযা করা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তার পর এ বছর জানুয়ারিতে তৃতীয় বারের জন্য ধরা দেয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আর এই সে দিন অগস্টে মার্কিন লাইগোর দু’টি ডিটেক্টরের সঙ্গে ইতালির ভার্গো ডিটেক্টরেও সেই তরঙ্গ ধরা দেয় চতুর্থ বারের জন্য।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নোবেল প্রাইজের সরকারি ওয়েবসাইট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy