এই সেই প্রথম বেসরকারি চান্দ্র অভিযানের ‘এমএক্স-ওয়ান’ ল্যান্ডার।
এক বহুদর্শী ভারতীয়ের স্বপ্নটাকে শেষমেশ সত্যি করে দিলেন এক দূরদর্শী অনাবাসী ভারতীয়।
বেসরকারি লগ্নির ঝড়ের ঝাপটা লাগল এ বার চাঁদের গায়েও! নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনের পা পড়ার ৫০ বছর পর এই প্রথম বেসরকারি পুঁজি নামছে চাঁদে! আমেরিকা নয়, ফ্রান্স নয়, রাশিয়া-জার্মানি নয়, সেই পুঁজি বিনিয়োগকারী আমাদের এই ‘হা-অন্ন’ দেশ ভারতেরই সন্তান।
অনাবাসী ভারতীয় নবীন জৈনের সংস্থা ‘মুন এক্সপ্রেস’ আগামী বছর মহাকাশযান পাঠাচ্ছে চাঁদে। ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’র উদ্দেশে। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে বেসরকারি পুঁজির চাঁদে পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন মিলেছে অগস্টের গোড়ায়। দীর্ঘ টালবাহানার পর আমেরিকার ‘ফেডেরাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফএএ) এই প্রথম কোনও বেসরকারি সংস্থাকে ওই অনুমোদন দিল। আর ঘটনাচক্রে, সেই অনুমোদন পেল এক অনাবাসী ভারতীয়ের হাতে গড়া সংস্থা, চাঁদে মানুষের পা পড়ার ৪৯ বছরের মাথায়। বহু দিন আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মহাকাশ বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম।
আগামী বছরের শেষাশেষি ‘মুন এক্সপ্রেস’-এর সেই চান্দ্র অভিযানে পাঠানো হচ্ছে মাঝারি সাইজের একটা স্যুটকেস। স্যুটকেসই যে ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনের প্রতীক! যদিও সেই স্যুটকেসে থাকবে না এই গ্রহের কোনও মুদ্রাই। তবে আগামী দিনে ‘মুদ্রারাক্ষসে’র পদার্পণের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেই চাঁদে পা দেবে স্যুটকেস-রোবট। দু’সপ্তাহের জন্য। ওই সময়টা যাতে চাঁদের মাটিতে নেমে হেসেখেলে, ঘুরে-ট্যুরে দেখতে পারে স্যুটকেস-রোবট, তার জন্য মহাকাশযানেই পাঠানো হবে একটি ‘ল্যান্ডার’। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘এমএক্স-ওয়ান’। পরে পাঠানো হবে একটি ‘রোভার’ও। চাঁদে চলার গাড়ি। যা আক্ষরিক অর্থেই, নামবে চাঁদ-পর্যটনে। চালাবে চাঁদের মাটিতে অজানা, অচেনা খনিজ পদার্থের সন্ধান।
‘মুন এক্সপ্রেস’-এর চেয়ারম্যান অনাবাসী ভারতীয় নবীন কে জৈন।
চাঁদে প্রথম বেসরকারি লগ্নি টেনে এনে গোটা বিশ্বকে যারা তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সেই ‘মুন এক্সপ্রেস’ সংস্থার চেয়ারম্যান ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা এক জন অনাবাসী ভারতীয়। নবীন কে জৈন। ৫৭ বছর বয়সী নবীন রুরকির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) ও জামশেদপুরের জেভিয়ার স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট বিজনেসে পড়াশুনো শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকে। ছিলেন ‘ইনফোস্পেস’ সহ দুনিয়া-খ্যাত বেশ কয়েকটি সংস্থার সিইও।
চাঁদে প্রথম বেসরকারি লগ্নি। ‘মুন এক্সপ্রেস’-এর ল্যান্ডার ‘এমএক্স-ওয়ান’।
ভারতে সংস্থার এক অন্যতম শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের অভিযানগুলোয় খুঁজে দেখা হবে চাঁদেও দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য কোনও ধাতু বা সোনা, হিরের মতো কোনও উজ্জ্বল, বহু মূল্যবান পদার্থ রয়েছে কি না। শুধু খুঁজে দেখাই নয়, চাঁদের মাটি, পাথর সহ সেই সব কিছুই নিয়ে আসবে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে। চাঁদে এই প্রথম বেসরকারি লগ্নির এই বাণিজ্যিক অভিযানে (কমার্শিয়াল মিশন) অবশ্যই বাদ পড়বে না বিজ্ঞান গবেষণার কাজ।’’
‘মুন এক্সপ্রেস’ সংস্থা সূত্রের খবর, আমেরিকার ‘ফেডেরাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফএএ) এই বাণিজ্যিক অভিযানের চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে গিয়ে মূলত, দু’টি শর্ত দিয়েছে। এক, বাণিজ্যিক চান্দ্র অভিযানে ‘অ্যাপোলো’ বা অন্যান্য মহাকাশযান চাঁদের যে সব জায়গায় নেমেছিল, সেই সব জায়গায় ‘মুন এক্সপ্রেস’-এর মহাকাশযান পা রাখতে পারবে না। দুই, বিজ্ঞান গবেষণার কাজে সরকারি সংস্থা নাসা তাদের পরামর্শ দিতে পারবে ঠিকই, কিন্তু ‘মুন এক্সপ্রেসে’র চান্দ্র-গবেষণার ওপর কোনও রকমের মাতব্বরি করতে পারবে না নাসা।
কী কী কাজ হবে বেসরকারি চান্দ্র অভিযানে
‘মুন এক্সপ্রেস’ সংস্থার পদস্থ কর্তা বব রিচার্ডস বলছেন, ‘‘চাঁদে আমরা এখন নিশ্চিন্তে পৃথিবীর অষ্টম মহাদেশটি গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিতে পারব। যা মানবসভ্যতার কল্যাণ আর এই বাসযোগ্য গ্রহটির অর্থনীতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। এ ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসন একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’
কেন যুগান্তকারী মার্কিন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত?
রিচার্ডসের কথায়, ‘‘আউটার স্পেস ট্রিটি (ওএসটি) নামে ১৯৬৭ সালে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, মহাকাশে কোনও দেশের কোনও বেসরকারি অভিযানের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে শুধু আমেরিকাই। সেই অনুযায়ী, আমাদের তরফে প্রস্তাবটি জমা দেওয়া হয়েছিল চলতি বছরের ৮ এপ্রিল। যেহেতু আমেরিকায় বাণিজ্যিক ভাবে রকেট উৎক্ষেপণের অনুমোদন দিতে পারে একমাত্র ‘ফেডেরাল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফএএ)-ই, তাই সেই প্রস্তাব ওদের কাছেই জমা দেওয়া হয়েছিল। সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখে আর তা ’৬৭-র মহাকাশ চুক্তি ভাঙছে কি না, তা বিচার করেই এফএএ ওই অনুমোদন দিয়েছে গত ৫ অগস্ট।’’
চাঁদের মাটিতে ‘মুন এক্সপ্রেস’-এর বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক! (মডেল)
আর দু’বছর পরেই ২০১৮ সালে মঙ্গল গ্রহে প্রথম বেসরকারি মহাকাশযান পাঠানোর তোড়জোড়-প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে এলন মাস্কের ‘স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস’ (স্পেস-এক্স)। তা ছাড়াও মহাকাশে গবেষণাগার বানানো, বিভিন্ন গ্রহাণুতে (অ্যাস্টারয়েড) খনিজ পদার্থের সন্ধান আর বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহের কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির মহাকাশেই মেরামতি বা যন্ত্রাংশ সংযোজনের জন্য আরও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এফএএ-র চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী! রাতে চাঁদে ‘মুন এক্সপ্রেস’-এর ল্যান্ডার। (মডেল)
‘মুন এক্সপ্রেস’-এর ওয়েবসাইটে তার কর্ণধার, অনাবাসী ভারতীয় নবীন জৈন লিখেছেন, ‘‘দ্য স্কাই ইজ নট দ্য লিমিট ফর মুন এক্সপ্রেস। ইটস দ্য লঞ্চপ্যাড।’’
অনাবাসী ভারতীয় নবীনের হাত ধরেই একুশ শতকের নবীন প্রজন্ম তা হলে চাঁদকে সামনে রেখে মহাকাশে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ শুরু করে দিল!
ছবি সৌজন্যে: বব রিচার্ডস, ‘মুন এক্সপ্রেস, ফ্লোরিডা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy