১০০ বছর পরে এই প্রথম সরাসরি হদিশ মিলল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের।
১৯১৬ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা জানান।
তিনি অবশ্য ভাবতেও পারেননি, অত্যন্ত দুর্বল ওই তরঙ্গের প্রভাব এই পৃথিবীতে বসে সূক্ষ্ম ভাবে মাপা কোনও দিন আদৌ সম্ভব হবে।
কিন্তু গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আমেরিকার দুই প্রান্তে দু’টো ‘LIGO’ ডিটেক্টরে একই সঙ্গে হদিশ মিলল সেই তরঙ্গের। যার জন্ম হয়েছিল ৩০টা সূর্যের সমান ভারী দু’টো কৃষ্ণ গহ্বরের সংঘর্ষে, ১৩০ কোটি বছর আগে। ওই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই সরাসরি প্রমাণিত হল এই ব্রহ্মাণ্ডে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব। হদিশ মিলল নতুন দু’টি কৃষ্ণ গহ্বরেরও। আরও এক বার প্রমাণ হল, আইনষ্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, এ বার আরও গুরুত্বপুর্ণ পরিস্থিতিতে, যাকে বলে, শক্তিশালী মহাকর্ষে (strong field) অচল নয়। দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের গত ৪০ বছরের লাগাতার চেষ্টা এই ভাবেই ফলপ্রসূ হল। তবে এটা কিন্তু কোনও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের শেষ নয়। সবে শুরু।
আরও পড়ুন- মহাকর্ষ তরঙ্গের খোঁজে এ বার বড় ভূমিকা নিচ্ছে ভারত
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সরাসরি হদিশ মেলার ঘটনাকে অনেকেই এখন তুলনা করছেন গ্যালিলিওর দূরবিনের সঙ্গে। যা জ্যোতির্বিজ্ঞানে এনেছিল আমূল পরিবর্তন। রেনেসাঁ। সেখান থেকে আজ আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি। সূর্য পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে নাকি পৃথিবী সূর্যের চার দিকে ঘুরছে না, সেই বিতর্কটা অন্তত শিক্ষিত মহলে এখন আর নেই।মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিটাই পুরো ব্রহ্মান্ড, নাকি তার বাইরে আরও আরও গ্যালাক্সি রয়েছে, একশো বছর আগেকার সেই বিতর্কও আজ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের মতোই, মহাকর্ষীয় তরঙ্গও জ্যোতির্বিজ্ঞানকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তা মূলত, তিন ভাবে হতে পারে
প্রথমত, যেমন ধরুন, নিউটনের গতিবিদ্যার সুত্রগুলি যেমন আলো বা আলোর মতো খুব দ্রুত গতিতে খাটে না, আইনষ্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদকে সেখানে ব্যবহার করতে হয়। সেই ভাবেই কি এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে আইনষ্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ আদৌ কাজ করে না?
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বুঝতে দেখুন ভিডিও।
দ্বিতীয়ত, ব্রহ্মান্ডে ক’টা কৃষ্ণ গহ্বর রয়েছে, তারা কী ভাবে তৈরি হল, নিউট্রন-নক্ষত্রের স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী, সে সব জানতে আর সৃষ্টি-তত্বের অনেক প্রশ্নের জবাব পেতে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আমাদের সাহায্য করতে পারে।
তৃতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের চমকে দিয়েছে এমন কিছু দেখিয়ে, যা কেউ কখনও কল্পনাও করেননি। যেমন ধরা যাক, ‘পালসার’ বলে এক ধরনের মৃত তারা থেকে যখন প্রথম কোনও ‘সিগন্যাল’ পাওয়া গেল, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, ভিন গ্রহের ‘প্রাণী’রা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে! আমার মনে হয়, মহাকর্ষীয় তরঙ্গও আমাদের এই ধরনের অনেক কিছু বিস্ময়কর ঘটনার হদিশ দেবে।
এখন আমাদের করণীয় কি? কী ভাবে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গবেষণা?
অনেক কিছুই করার রয়েছে। পরবর্তী কয়েক দশকের জন্য কাজের ছক বিজ্ঞানীরা অনেকটাই কষে ফেলেছেন, আর কাজও চলছে জোর কদমে। যদিও আমেরিকাতে সরকারি অনুদানের পরিমাণ কমে যাওয়া্য় ওই সব অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তাবিত মহাকাশ অভিযানগুলি নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রভাব খুবই সূক্ষ্ম। তার হদিশ পেতে আমরা ব্যবহার করি চার কিলোমিটার লম্বা ‘L’ আকারের মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এর দু’টো হাতের মধ্যে দৈর্ঘ্যের ফারাক তৈরি করে। একটা চার কিলোমিটার লম্বা ডিটেক্টরেও সেই ফারাকটা সাধারণত, একটা প্রোটনের চেয়েও ছোট হয়। তাই এমন ব্যবস্থা নিতে হয়, যাতে খুব ছোট ছোট কম্পনও না দুলিয়ে দিতে পারে ডিটেক্টরের ৪০ কিলোগ্রাম ওজনের সিলিকার আয়না। কয়েক কিলোমিটার দুরে কোনও ট্রাক, বিমানের চলাচল, এমনকী ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অণুর কম্পনও ঢাকা-চাপা দিতে পারে ডিটেক্টরে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সূক্ষ্ণ প্রভাব। বিশ্বজুড়ে তাই বছরের পর বছর গবেষণা চলছে, কী ভাবে ডিটেক্টরগুলিকে আরও সংবেদনশীল করে তোলা যায়।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য হল ডিটেক্টরগুলির গ্লোবাল নেটওয়ার্ক। আগামী দু’-তিন বছরে চারটি ৩/৪ কিলোমিটার লম্বা ডিটেক্টর পুরোদমে চালু হতে চলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আমেরিকায় দু’টো ‘LIGO’ ডিটেক্টর তো চলছেই, ইতালিতে ‘ভার্গো’ আর জাপানে ‘কাগরা’ ডিটেক্টর চালু হয়ে যেতে পারে খুব শীঘ্রই। এতে সুবিধা হবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নতুন নতুন উৎস খুঁজে বের করতে।আর তাদের অবস্থান সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে।
কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে এই কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে, একই রকমের আরও একটা ডিটেক্টর যদি ভারতে বসানো হয়। আমেরিকার দু’টো ‘LIGO’ আর ইতালির ‘ভার্গো’ এক সঙ্গে মিলে যে সূক্ষ্মতায় একটা উৎস খুঁজে বের করতে পারবে, ভারতে আরও একটা ‘LIGO’ ডিটেক্টর বসানো হলে সেই নেটওয়ার্কের সূক্ষ্মতা প্রায় ৫ গুণ বেড়ে যাবে। বুধবার ওই প্রকল্পের ব্যাপারে চূড়ান্ত সরকারি অনুমোদন মিলেছে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শুনতেও পারা যাবে?
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।
গ্যালিলিও তাঁর দূরবিন ব্যবহার করেছিলেন অপটিক্যাল তরঙ্গ দেখার জন্য। মানে, যে তরঙ্গ খালি চোখে দেখা যায়। এর পর চারশো বছর ধরে প্রায় সব তড়িৎ-চুম্বকীয় ব্যাণ্ডে তৈরি হয়েছে টেলিস্কোপ, রেডিও, ইনফ্রারেড, অপটিক্যাল, এক্স-রে, গামা-রে। প্রতিটি ব্যাণ্ড আমাদের দিয়েছে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য। হদিশ দিয়েছে এমন সব মহাজাগতিক বস্তুর, যাদের অস্তিত্ব কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু তা সম্পূর্ন ভাবে পাল্টে দিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক ধ্যান-ধারণা।
এই মুহুর্তে আমরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শুধু একটা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যাণ্ড থেকেই তথ্য জোগাড় করছি। করতে পারছি। মজার বিষয়টা হল, সেই ব্যাণ্ডটা অডিও-ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে পরে। অনেকে তাই বলেন, এত দিন ধরে আমরা ব্রহ্মাণ্ডকে শুধুই দেখে এসেছি। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে এ বার সেই ব্রহ্মাণ্ডকে আমরা শুনতেও পারব। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গও বিভিন্ন ব্যাণ্ডে আলাদা আলাদা তথ্য বয়ে নিয়ে চলে। সেই তথ্য জানতে হলে আমাদের বানাতে হবে আরও অন্য রকমের যন্ত্র। আরও আধুনিক। যেতে হবে পৃথিবীর বাইরে, মহাকাশে।
আমার জোরালো বিশ্বাস, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ‘জানলা’গুলো দিয়ে যখন আমরা ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে শুরু করব, তখন আবার বদলে যাবে আমাদের অনেক মৌলিক ধ্যান-ধারণা। আর তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানে আসবে নতুন রেনেসাঁ!
ছবি সৌজন্য: নাসা।
ভিডিও সৌজন্য: আয়ুকা, পুণে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy