এখনও জলে বরফ ভাসছে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের অন্তরে, অন্দরে!
ভেসে চলেছে, গড়িয়ে চলেছে বড় বড় উঁচু উঁচু বরফের পাহাড়, বরফের চাঁই আর চাঙর। আর বড় বড় সেই বরফের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘষা লাগলে, সেই বরফ তো গলবেই। ফলে তৈরি হবে জলের স্রোত। আর সেই স্রোতেই ভেসে চলেছে, গড়িয়ে চলেছে উঁচু উঁচু বরফের পাহাড়, বরফের চাঁই আর চাঙর। এখনও, মঙ্গলে!
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড়
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড় (নীল এলাকা)
আর এই চমকে দেওয়ার মতো ঘটনাটা এখনও ঘটে চলেছে আপাতদৃষ্টিতে রুখুসুখু, কঠিন পাথুরে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের অন্তরে, অন্দরে। বিশাল একটা এলাকা জুড়ে। কতটা বিশাল সেই এলাকা, জানেন? আকারে, আয়তনে যতটা বিশাল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ (৩৪ হাজার ২৬৭ বর্গ মাইল) তার সাড়ে চার গুণ (১ লক্ষ ২১ হাজার ৫৮৯ বর্গ মাইল) মঙ্গলের ওই এলাকা। তার মানে ‘লাল গ্রহে’র ওই ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’ ঢুকে যাবে সাড়ে চার খানা পশ্চিমবঙ্গ।আর সেই সুবিশাল এলাকায় এখনও রয়েছে প্রায় ২৬০ ফুট (বা, ৮০ মিটার) থেকে ৫৬০ ফুট (বা, ১৭০ মিটার) পুরু বরফের পাহাড় বা যাকে পর্বতমালাও বলা যায়। যেটা আরও বেশি অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা, তা হল; সেই পুরু বরফের পাহাড়ের প্রায় অর্ধেকটা থেকে ৮৫ শতাংশই আর পুরোদস্তুর কঠিন অবস্থায় নেই। তা গলে জল হয়ে গিয়েছে বা গলে যাচ্ছে বা গলে চলেছে এখনও। এটাকেই বলে ‘ওয়াটার আইস’। যার মধ্যে মিশে রয়েছে প্রচুর ধুলোবালি (ডাস্ট) আর ছোট, বড় নানা আকারের, নানা চেহারার এবড়োখেবড়ো পাথর (রকি পার্টিক্লস্)।
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড় (নীলচে এলাকা)
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড়
মঙ্গলের যেখানে বরফের পাহাড়: দেখুন ভিডিও।
মঙ্গলের দক্ষিণ মেরুর মধ্য-উত্তর অক্ষাংশের (মিড-নর্দার্ন ল্যাটিটিউডস্) ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’র ওপর দিয়ে নাসার মহাকাশযান ‘মার্স রিকনাইস্যান্স অরবিটার’ (এমআরও) ৬০০ বার চক্কর মেরে যে ছবি আর তথ্যাদি পাঠিয়েছে, তা সবিস্তার বিশ্লেষণ করেই এই চমকে দেওয়ার মতো খবর পাওয়া গিয়েছে। ওই জলে ভাসা বরফের পাহাড় স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে আসছে মঙ্গলের নিরক্ষরেখার (ইক্যুয়েটর) কাছেও। ‘শারাড ডিটেকশন অ্যান্ড ক্যারেকটারাইজেশন অফ সাব-সারফেস ওয়াটার আইস ডিপোজিটস্ ইন ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া, মার্স’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স’-এর ১৪ নভেম্বরের সংখ্যায়। কিন্তু সেই বরফের স্রোত একেবারেই ‘অন্তঃসলিলা’ মঙ্গলে। তা কিছুতেই উঠে আসতে পারে না ‘লাল গ্রহে’র পিঠে (আউটার সারফেস)।
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড় (দক্ষিণ মেরুতে সাদা দাগ)
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড় আর তা ছড়াচ্ছে (সাদা দাগ)
মঙ্গলের যে এলাকায় রয়েছে বরফের পাহাড় আর তা ছড়াচ্ছে (সাদা দাগ)
কেন ওই বরফের স্রোত মঙ্গলে ‘অন্তঃসলিলা’? কেন তা উঠে আসতে পারে না মঙ্গলের পিঠে বা সারফেসে?
সহযোগী গবেষক, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুনন্দ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ওই ওয়াটার আইস মঙ্গলের সারফেসে উঠে আসলেই আর ওয়াটার আইস হিসেবে থাকতে পারে না। মঙ্গলের অভিকর্ষ বল প্রায় নেই বলেই, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের স্তর অত্যন্ত পাতলা। কারণ, অত্যন্ত দুর্বল অভিকর্ষ বলের জন্য মঙ্গল তার বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে পারেনি। ফলে, ওয়াটার আইস মঙ্গলের সারফেসে উঠে এলেই তা বাষ্পীভূত হয়ে জলীয় বাস্প হয়ে যায়। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের কিছুটা যদি কোনও ভাবে ‘লাল গ্রহে’র সারফেসের ফাঁক গলে তার নীচে থাকা ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’র পুরু বরফের পাহাড়গুলোতে ছোবল দিত, তা হলে মঙ্গলের পিঠের তলায় ‘লুকিয়ে থাকা’ ওই বরফের পাহাড়গুলো আর থাকতো না। সেগুলিও বাষ্পীভূত হয়ে জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে যেত। ছড়িয়ে পড়ত মহাকাশে। তা হতে পারেনি, কারণ, ওই বরফের পাহাড়গুলিকে ঢেকে রেখেছে ৩ থেকে ৩৩ ফুট (বা, ১ থেকে ১০ মিটার) পুরু মাটির আস্তরণ। যা ফুঁড়ে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ঢুকতে পারেনি ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’র পুরু বরফের পাহাড়ি এলাকায়। ফলে, বরফ টিঁকে গিয়েছে। টিঁকে গিয়েছে পাহাড়ও। আর সেই পাহাড় গলে যে জলের স্রোত বয়ে চলেছে এখনও মঙ্গলের অন্তরে, অন্দরে, সেই জলও বাষ্পীভূত হয়ে মহাকাশে উড়ে যেতে পারেনি।’’
মঙ্গলে জলের স্রোতের দাগ
মঙ্গলে জলের স্রোতের দাগ
মঙ্গলে জলের স্রোতের দাগ
ওই বরফের পাহাড়গুলি তৈরি হয়েছিল কী ভাবে মঙ্গলের অন্তরে, অন্দরে ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’?
গবেষণাপত্রে মূল গবেষক অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ জিওফিজিক্সের অধ্যাপক ক্যাসি স্টুরম্যান গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘মঙ্গলের কক্ষপথ ঝুঁকে থাকার সময়েই প্রচুর তুষারপাতের ফলে ওই বরফের পাহাড়গুলি তৈরি হয়েছিল। মঙ্গলের কক্ষপথ এখন ঝুঁকে রয়েছে ২৫ ডিগ্রি। ফলে, ওই ওয়াটার আইসের বেশির ভাগটাই রয়েছে এখন ‘লাল গ্রহে’র মেরুতে। আর এ ভাবে সেটা থাকার কথা, গাণিতিক হিসেবে, কম করে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর। এর পর ওই কক্ষপথ ঝুঁকে পড়বে আরও দু’গুণ। তখন ওই বরফের পাহাড়গুলো বা ওয়াটার আইস গড়িয়ে চলে আসবে গ্রহটির মধ্য অক্ষাংশে। যা এখন রয়েছে মধ্য-উত্তর অক্ষাংশের ৩৯ ডিগ্রি থেকে ৪৯ ডিগ্রির মধ্যে।’’
উঁকি মারছে বরফের পাহাড়?
উঁকি মারছে বরফের পাহাড়? (সাদা দাগ)
উঁকি মারছে বরফের পাহাড়?
মঙ্গলে এখনও পর্যন্ত জলের হদিশ পাওয়ার সম্ভাবনাগুলির মধ্যে এই ওয়াটার আইসই কি সবচেয়ে বেশি ‘সহজলভ্য’?
উঁকি মারছে বরফের পাহাড়? (নীল রং)
সহযোগী গবেষক, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সুনন্দ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, সেটাই। কারণ, এটা রয়েছে ‘লাল গ্রহে’র সবচেয়ে লো ল্যাটিটিউড বা নীচের অক্ষাংশে। আর সেটা রয়েছে একটা কার্যত সমতল, মসৃণ এলাকায়। যেখানে কোনও মহাকাশযান বা ‘ল্যান্ডার’ নামানোর কাজটা অনেক বেশি সহজতর হতে পারে আগামী দিনে। ওই ‘ইউটোপিয়া প্লানিশিয়া রিজিওনে’র ব্যাস প্রায় ২ হাজার ৫০ মাইল বা ৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটার।’’
মঙ্গলে জলের স্রোতের দাগ
মঙ্গলে শুকনো বরফের ছবি: দেখুন ভিডিও।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy