জল নেই, জল দাও...
একেবারে শুকনো খটখটে বাতাস থেকেও এ বার জল টেনে, শুষে নিয়ে মেটানো যাবে বুকের ছাতি ফাটানো তেষ্টা! এমনকী, মরুভূমিতেও আর ‘হা জল, হা জল’ বলে বুক চাপড়াতে হবে না! আর সেটা করা যাবে আমাদের সব সময়ের সঙ্গী সূর্যালোক দিয়েই!
তেমন একটা ঝক্কি-ঝামেলাও নেই। কফি খাওয়ার মগের মতো ছোট্ট একটা যন্ত্রই সেই মুশকিল আসানটা করে দেবে!
এমন একটি চমকে দেওয়ার মতো যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক ইভলিন ওয়াঙ ও বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ ওমর ইয়াঘির নেতৃত্বে যে আন্তর্জাতিক গবেষকদল, তার অন্যতম দুই ভারতীয় বিজ্ঞানী। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক সমীর আর রাও ও শঙ্কর নারায়ণন।
কতটা জল পাওয়া যাবে, জানেন?
গবেষকদের দাবি, একটি কোকের ক্যানে যতটা জল ধরে, এক ঘণ্টায় ততটা জল শুকনো খটখটে বাতাস থেকে শুধুই সূর্যালোক দিয়ে বানিয়ে ফেলতে পারবে যন্ত্রটি। যা, মরুভূমিতে ‘হা জল, হা জল’ অবস্থায় যথেষ্টই। তবে ওই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করা হচ্ছে, যাতে অনতিদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার শুকনো খটখটে এলাকাগুলিতে পানীয় জলের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও মেটানো যায়। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এর ১৩ এপ্রিল সংখ্যায়। যার শিরোনাম- ‘ওয়াটার হারভেস্টিং ফ্রম এয়ার উইথ মেটাল-অরগ্যানিক ফ্রেমওয়ার্কস পাওয়ারড বাই ন্যাচারাল সানলাইট’।
শুকনো, খটখটে বাতাস থেকেও জল টেনে বের করার সেই ‘ম্যাজিক’ যন্ত্র
এই প্রযুক্তির অভিনবত্ব কোথায়?
আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক সমীর আর রাও ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘ যেখানকার আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ৫০ শতাংশের নীচে, এত দিন সেখানে এ ভাবে শুকনো খটখটে বাতাস থেকে জল টেনে, শুষে নেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু এ বার এই নতুন প্রযুক্তিতে যে এলাকার আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ২১ শতাংশেরও কম, সেখানকার বাতাস থেকেও জল টেনে নেওয়া যাবে পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে।
বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না পানীয় জলের সরবরাহ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমেছে যথেষ্টই। ফলে, পানীয় জলের অভাব আরও প্রকট হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই পানীয় জলাভাবের শিকার।
অথচ বায়ুমণ্ডল থেকেই আমরা মেটাতে পারি পানীয় জলের অভাব। যেহেতু বায়ুমণ্ডলেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বা ওয়াটার ভেপার। তার পরিমাণ কতটা, জানেন? অলিম্পিকের সুইমিং পুল যতটা বড় হয়, সে রকম ৫০০ কোটি সুইমিং পুলে যতটা জল ধরতে পারে, আমাদের বায়ুমণ্ডলে ঠিক ততটাই মিশে রয়েছে জলীয় বাষ্প।
একটু খাওয়ার জলের জন্য...
সেই বায়ুমণ্ডল থেকে জল টেনে, শুষে নেওয়ার কাজটা তখনই সহজতর হয়, যখন সেই বাতাস বেশি ভিজে থাকে। যখন সেই বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ অনেকটাই বেশি হয়। কিন্তু পানীয় জলের অভাব যেখানে প্রকট, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ সেখানে অনেকটাই কম। সেখানকার বাতাস অনেক বেশি শুকনো, খটখটে। তাই ওই সব এলাকার বাতাস থেকে জল টেনে নেওয়ার কাজটা অনেক বেশি কঠিন।
সে ক্ষেত্রে মুশকিল আসান করতে পারে সিলিকা জেলের মতো স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থই। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ অনেক কম থাকলেও, সিলিকা জেলের মতো স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থ দিয়ে বাতাস থেকে জল টেনে নেওয়ার কাজটা করা যায়।
তবে সে ক্ষেত্রেও কিছু অসুবিধা রয়েছে। সিলিকা জেলের মতো স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থগুলি খুব সহজে বাতাস থেকে জল টানতে পারে না। কাজ করে খুব ধীরে ধীরে। তার জন্য অনেক বেশি শক্তিও খরচ করতে হয়।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক ইভলিন ওয়াঙের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক গবেষকদলের উদ্ভাবিত নতুন যন্ত্রটিতে সেই কাজটা করার জন্য যে পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ওই দুই অসুবিধাই দূর করতে পারে।
একটু খাওয়ার জলের জন্য...
আর সেটা করার জন্য গবেষকরা একটি ধাতু ও একটি জৈব যৌগ দিয়ে একটি জটিল যৌগিক পদার্থ বানিয়েছেন। যার নাম- ‘মেটাল অরগ্যানিক ফ্রেমওয়ার্ক’ (এমওএফ)। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যবহার করেছেন জারকোনিয়াম ধাতু ও একটি জৈব যৌগ অ্যাডিপিক অ্যাসিড। যা খুব সহজেই বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প টেনে, শুষে নিতে পারে। তাকে ‘মুঠো’র মধ্যে ধরে রাখতে পারে। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ওই স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থের ভেতরে থাকা ছিদ্রগুলির (পোরস) মধ্যে আটকে থাকে জলীয় বাষ্পের কণাগুলি। তাপমাত্রা বাড়লে তা উবে যায়।
এমন দিন হয়তো আর খুব বেশি দূরে নয়, যে দিন এই যন্ত্রটি থাকবে ঘরে ঘরে। আর আমাদের রোজকার খাওয়ার জলের প্রয়োজন এই যন্ত্র দিয়েই মেটানো যাবে। শুধু সূর্যের আলো দিয়েই জল টেনে বের করে নেওয়া যাবে। শুকনো, খটখটে বাতাস থেকেও। এমনকী, মরুভূমির মতো এলাকাতেও।
আরও পড়ুন- মে’র প্রথম সপ্তাহেই তীব্র তাপপ্রবাহ দেশ জুড়ে? শঙ্কা বিজ্ঞানীদের
বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ্যার ‘জেমস অ্যান্ড নীলট্জে ট্রেটার’ চেয়ার প্রফেসর ওমর ইয়াঘি আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘খুব কম আপেক্ষিক আর্দ্রতার বায়ুমণ্ডল রয়েছে যে সব এলাকায়, সেখানে এত দিন বাতাস থেকে জল টেনে বের করে আনা যেত না। আমাদের উদ্ভাবিত যন্ত্রটি এবার সেই মুশকিল আসান করল। যা করা যাবে খুব কম শক্তি খরচ করেই। ফলে, ঘরে ঘরে ব্যবহারের জন্য সাধারণ মানুষও কিনতে পারবেন ওই যন্ত্র। খুব কম দামে। আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও ১২ ঘণ্টার মধ্যে একনই ওই যন্ত্রটি দিয়ে ২.৮ লিটার জল শুকনো, খটখটে বাতাস থেকে টেনে বের করে আনা যাচ্ছে। আর তার জন্য লাগছে মাত্র ২.২ পাউন্ড ওজনের ‘মেটাল-অরগ্যানিক ফ্রেমওয়ার্ক’ (এমওএফ)।’’
একটু খাওয়ার জলের জন্য...
২০১৪ সালেই জারকোনিয়া ধাতু ও অ্যাডিপিক অ্যাসিড দিয়ে ওই এমওএফ বানিয়ে ফেলেছিলেন ইয়াঘি ও তাঁর দুই সহযোগী ভারতীয় গবেষক অধ্যাপক সমীর আর রাও ও অধ্যাপক শঙ্কর নারায়ণন। তার পর তাঁরা যোগাযোগ করেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক ইভলিন ওয়াঙের সঙ্গে। ওয়াঙের সহযোগিতাতেই তাঁরা ওই এমওএফ-টিকে বাতাস থেকে জল টেনে বের করার ‘হাতিয়ার’ করে তোলেন।
নতুন যন্ত্রটি কাজ করে কী ভাবে?
সাড়াজাগানো সেই গবেষণাপত্রটি, যাতে অবদান রয়েছে দুই ভারতীয় বিজ্ঞানীর
বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শঙ্কর নারায়ণন ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘একটি সোলার অ্যাবজর্ভার (যা সূর্যালোক শুষে নিতে পারে) আর একটি কনডেনসর প্লেটের মধ্যে মুখ খোলা একটি প্রকোষ্ঠে রাখা থাকে একেবারে ধুলোর মতো ২.২ পাউন্ড ওজনের ওই ‘মেটাল-অরগ্যানিক ফ্রেমওয়ার্ক’টি (এমওএফ)। আর ওই এমওএফের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র। বাতাস ওই এমওএফের মধ্যে ঢুকলেই তার থেকে জল টেনে বের করে নিতে পারে ওই এমওএফ-টি। আর সেই জলটাকে ভেতরে ধরেও রাখতে পারে অনেক ক্ষণ। এক্স-রে দিয়ে দেখা গিয়েছে, এমওএফের ওই ছোট ছোট ছিদ্রগুলির মধ্যে আটকে থাকা জলীয় বাষ্পের অণুগুলি কখনও আটটা করে জোট বেঁধে থাকে। অনেকটা যেন ঘনক বা কিউব। প্রকোষ্ঠের বাইরের যে দিকটা খোলা থাকে (ওপেন), সেখান দিয়ে সূর্যালোক ঢুকে পড়ে ওই এমওএফের মধ্যে। আর সূর্যের আলোই তাতিয়ে দেয় ওই এমওএফ-টিকে। আর তার মধ্যে আটকে থাকা জলীয় বাষ্পের অণুগুলিকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় কনডেনসর প্লেটের দিকে। যার তাপমাত্রা যন্ত্রের বাইরের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার সমান। আর সেই কম তাপমাত্রায় যা হওয়াটা স্বাভাবিক, সেটাই হয়। জলীয় বাষ্পের কণাগুলি জমাট বেঁধে গিয়ে তরল জলের কণায় পরিণত হয়। আর সেই জল ফোঁটা ফোঁটা করে যন্ত্রেরই একটা জায়গায় জমা হয়। ওই জায়গাটাকে বলা হয় ‘কালেক্টর’।’’
আগামী দিনে এই যন্ত্রটিকে ঘরে ঘরে ব্যবহারের জন্য কী ভাবে উন্নত করা যায়?
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক সমীর আর রাও ই-মেলে বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত আমরা যে এমওএফ-টি দিয়ে যন্ত্রটি বানিয়েছি, সেটি তার ওজনের ২০ শতাংশ পর্যন্ত জল শুকনো, খটখটে বাতাস থেকে টেনে বের করতে পারে। কিন্তু আরও অন্য ধরনের এমওএফ বানানো সম্ভব, যেগুলি তাদের ওজনের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত জল শুকনো বাতাস থেকে টেনে বের করে আনতে পারে। আর সেটা আরও কম আপেক্ষিক আর্দ্রতার বায়ুমণ্ডলেও সম্ভব হতে পারে। রাতে যখন সূর্যালোক থাকে না, তখনও যাতে যন্ত্রটি শুকনো, খটখটে বাতাস থেকে জল টেনে বের করতে পারে, আমরা একন তারই চেষ্টা চালাচ্ছি।’’
লবণাক্ত জল থেকে পানীয় জল টেনে বের করার চলতি পদ্ধতি কতটা কার্যকরী?
রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই পরিসংখ্যান
এখন এমন একটা পদ্ধতিতে বিশ্বে পানীয় জলের সমস্যা কিছুটা মেটানোর চেষ্টা চলছে। লবণাক্ত জল থেকে খাওয়ার জল বের করে আনার এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় ‘ডিস্যালিনেশন’। তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচুর ‘ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট’ও বানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বিশ্বে ২০১৫ সালে এমন ১৮ হাজার ‘ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট’ চালু হয়েছে। বছরে যেগুলি থেকে মোট ৩১.৬ ট্রিলিয়ন লিটার বিশুদ্ধ পানীয় জল পাওয়া যেতে পারে ‘ডিস্যালিনেশন’-এর মাধ্যমে। সেগুলি ছড়ানো রয়েছে বিশ্বের ১৫০টি দেশে। কিন্তু তা দিয়ে বিশ্বের পানীয় জলের চাহিদা এক শতাংশের বেশি মেটানো সম্ভব নয়।
ফলে, আগামী দিনে শুকনো, খটখটে বাতাস থেকে অনায়াসে, শুধুই সূর্যালোক দিয়ে জল টেনে বের করার এই যন্ত্রই আসতে চলেছে আমাদের ঘরে ঘরে।
ছবি সৌজন্যে: ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy