একশো বছর আগে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কথা বলেছিলেন আইনস্টাইন, সদ্যই তার হাতেনাতে প্রমাণ মিলল।
তার পরেও ‘কিন্তু’ রয়েছে কিছু কিছু!
এই প্রথম সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিললেও, তাকে ‘ধরা’ সম্ভব হয়েছে শুধুই মহাকাশের একটি প্রান্ত থেকে।
মহাকাশের অন্য প্রান্তে, ওই তরঙ্গের হদিশ মেলেনি এখনও। জানা যায়নি, আর কোন কোন উৎস থেকে ওই তরঙ্গের হদিশ মিলতে পারে।
আর তারই জন্য ভারতের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হচ্ছে আমেরিকাকে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য।
আরও পড়ুন- মিলল মহাকর্ষ-তরঙ্গ, সাফল্যে সঙ্গী ভারত
আমেরিকায় যে ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র (অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টর) বসিয়ে সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া গেল, খুব তড়িঘড়ি তেমনই একটি যন্ত্র ভারতে বসানো হবে কবে, তার দিকেই এখন চেয়ে রয়েছেন বিশ্বের তাবৎ মহাকাশবিজ্ঞানীরা। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে, আমেরিকার কার্যত, ‘বিপরীত মেরু’তে থাকা ভারতে একই ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র বসানো না হলে, মহাকাশে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অন্য উৎসগুলি অজানাই থেকে যাবে। তাই এখন শুধুই আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্বের নজর ভারতের দিকে।
বছর চারেক আগেই যার তোড়জোড়-প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন ভারতের মহাকাশবিজ্ঞানীরা। মহারাষ্ট্রে, পুণে আর নাগপুরের মাঝামাঝি নান্দেরে সেই প্রস্তাবিত ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটি এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়। সরকারি সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহের শেষাশেষি ১২৬০ কোটি টাকার ওই প্রকল্পটি সরকারি অনুমোদন পেতে চলেছে। বৃহস্পতিবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিস্কারের কথা ঘোষণা হওয়ার পরেই, টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, ‘‘এ বার লাইগো-ইন্ডিয়া প্রকল্পও হবে।’’
ইসরোর উপগ্রহের তথ্যের ভিত্তিতে লাইগো-ইন্ডিয়া প্রকল্পের ডিজাইন লে-আউট।
ঘটনাচক্রে, গত সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেটের হ্যানফোর্ড ও লুইজিয়ানার লিভিংস্টোনে চালু হওয়া ‘লেসার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি’ (লাইগো) ও ভারতে প্রস্তাবিত লাইগো-ইন্ডিয়া- দু’টি প্রকল্পেই সামনের সারিতে রয়েছেন বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
ভারতে ওই অত্যাধুনিক যন্ত্র (অ্যাডভান্সড লাইগো ডিটেক্টর) তড়িঘড়ি বসানোর প্রয়োজন কেন?
পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ (আয়ুকা)-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোমক রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, ‘‘একটা চোখ দিয়ে কি খুব স্পষ্ট দেখা যায়? দেখা যায় কি খুব দূরে? তাই আমাদের দু’টো চোখ। স্পষ্ট ভাবে দেখার জন্য। কিন্তু, তাতে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। দু’টো চোখ খুব কাছাকাছি থাকে বলে আমরা খুব বেশি দূরে দেখতে পাই না। একই কারণে, দু’টি লাইগো ডিটেক্টরই এখন আমেরিকার দু’টি প্রদেশে (কাছাকাছি) থাকায় মহাকাশের অন্য প্রান্তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎসগুলির হদিশ পাওয়াটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমেরিকার একটি লাইগো-ডিটেক্টর প্রথমে সরিয়ে কার্যত, ‘বিপরীত মেরু’-তে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় বসানোর কথা ভাবা হয়েছিল। তা সম্ভব না হওয়ায়, ভারতই আপাতত বিশ্বের মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে ‘দু’নম্বর চোখের মতো’ আরেকটি লাইগো-ডিটেক্টর বসানোর সেরা জায়গা। যাতে মহাকাশের অন্য প্রান্তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অন্য অন্য উৎসগুলিরও হদিশ পাওয়া যেতে পারে। তার জন্য প্রাথমিক ভাবে স্থান-নির্বাচনও হয়ে গিয়েছে মহারাষ্ট্রের নান্দেরে। সেখানে প্রায় সাড়ে তিনশো একর জমিতে ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটি শুরু করার জন্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। তা এখন সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায়। সেখানে বসানো হবে ইংরেজির ‘L’-এর মতো ওই অত্যাধুনিক যন্ত্র। যার দু’টি বাহুর দৈর্ঘ্য হবে চার কিলোমিটার করে।’’
সোমকবাবুর মতোই আমেরিকার ‘লাইগো’ প্রকল্পের অন্যতম ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রস্তাবিত ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ‘আয়ুকা’র অধ্যাপক তরুণ সৌরদীপ, অধ্যাপক সুকান্ত বসু ও আইআইটি গাঁধীনগরের অধ্যাপক আনন্দ সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘‘আমেরিকায় যে অ্যাডভান্স্ড লাইগো-ডিটেক্টর যন্ত্রে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম সরাসরি হদিশ মিলেছে, তা দিয়ে মহাকাশে ২৫ কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান মিলতে পারে। আর ভারতে যে যন্ত্রটি বসানোর কথা ভাবা হচ্ছে, তা কম করে তার তিন গুণ বা ৬০ কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরও হদিশ দিতে পারবে।’’
ভারতে লাইগো ডিটেক্টর বসানো হলে আর কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে?
কলকাতার ‘আইসার’-এর বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী রাজেশ নায়েক ও পুণের ‘আয়ুকা’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী সঞ্জিত মিত্র জানাচ্ছেন, ‘‘এর ফলে মহাকাশের অন্য প্রান্তে অনেক অজানা ব্ল্যাক হোলেরও হদিশ পাওয়া যাবে।’’
তবে তার পরেও অধরা থেকে যাবে ‘প্রাইমর্ডিয়াল গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’। ১৪০০ কোটি বছর আগে, ‘বিগ ব্যাং’-এর পর পরই যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল।
কী ভাবে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব?
সোমকবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘তার জন্য মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে ‘লিসা-পাথ ফাইন্ডার মিশন’। কারণ, ওই ক্ষীণতর হয়ে আসা তরঙ্গের হদিশ মহাকাশে পাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy