ইনসেটে বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী শমী চট্টোপাধ্যায়।
আবার বাজিমাত করলেন এক বাঙালি। ‘ভিনগ্রহীদের আলো’র ধাঁধার জট খুলে!
এই ব্রহ্মাণ্ডের একটি অত্যন্ত জটিল রহস্যের জাল কেটে গোটা বিশ্বকে চমকে দিলেন বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী শমী চট্টোপাধ্যায়। শোরগোল ফেলে দিলেন বিশ্বজুড়ে।
এই অতলান্ত ব্রহ্মাণ্ডের কোন সুদূর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে জোরালো রেডিও তরঙ্গ (ফাস্ট রেডিও বার্স্ট)-এর বজ্রনির্ঘোষ আর তা কয়েক লহমার মধ্যে টর্নেডোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আদিগন্ত মহাকাশে, ১০ বছরের সূদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেষমেশ এই মহাবিশ্বে তার ‘ঘরবাড়ি’ খুঁজে বের করলেন এই বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
এই সেই ‘ভিনগ্রহীদের আলো’!
কোথায় তৈরি হচ্ছে ওই রেডিও তরঙ্গ, কোথায় অসম্ভব রকমের তীব্র শব্দে ফাটছে প্রকাণ্ড ‘আতসবাজি’, কে ফাটাচ্ছে সেই ‘আতসবাজি’, সেই রহস্যের জাল ছেঁড়া যায়নি গত শতাব্দীতে। ১৯৬৮-তে আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তে প্রথম রেডিও পালসার আবিষ্কারের পরেও কেটে গিয়েছে ৪৯টা বছর। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে ‘পার্কস’ রেডিও টেলিস্কোপে প্রথম ধরা পড়েছিল ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বেশি রহস্যে মোড়া ওই ‘আতসবাজি’র। তার পর ব্রহ্মাণ্ডের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এমন আরও ১৬টি ‘আতসবাজি’র দেখা মিলেছে। কিন্তু তার উৎস কোথায়, তা ছুটে আসছে ব্রহ্মাণ্ডের কত দূর থেকে, এত দিন তার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই উত্তরটা জানিয়ে দিয়েই গোটা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছেন শমী।
নিউইয়র্কের ইথাকায় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট শমী চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণাপত্রটি দু’দিন আগে, বুধবার প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। যার শিরোনাম- ‘আ ডাইরেক্ট লোক্যালাইজেশন অফ আ ফাস্ট রেডিও বার্স্ট অ্যান্ড ইটস হোস্ট’। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারসে’ও।
মূল গবেষণাপত্রটি পড়ুন এই ঠিকানায়:
http://iopscience.iop.org/article/10.3847/2041-8213/834/2/L8/pdf
------------------------------------------------
শমীর জন্ম দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে হলেও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। তার পর চলে যান চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (আইআইটি)। সেখান থেকে বি-টেক করে শমী পিএইচডি করতে চলে যান হার্ভার্ডে। তার পর তাঁর পোস্ট-ডক্টরাল আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। শমী এখন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট। বাবা, মা থাকেন সল্ট লেকে।
শমী কী আবিষ্কার করেছেন, তার তাৎপর্যটা কী, সেটা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে এই ব্রহ্মাণ্ডে রেডিও সিগন্যালটা আদতে কী জিনিস।
এটা আদতে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ। যা গোটা ব্রহ্মাণ্ডেই ছড়িয়ে রয়েছে। আতসবাজি ফাটানো হলে যেমন হয়, তেমনই খুব শক্তিশালী, অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোর ঝলক। যাকে বলা হয়, ‘লাইট ফ্ল্যাশেস’। প্রতিদিন ব্রহ্মাণ্ডে এমন আলোর ঝলসানির ঘটনা ঘটে গড়ে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজারটি। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের অনেক দূরের সেই আতসবাজির আলোর ঝলক আমাদের চোখে খুব একটা ধরা পড়ে না। ২০০৭ সালে তা প্রথম আমাদের নজরে আসার পর, শমীদের আবিষ্কারটি নিয়ে এখনও পর্যন্ত এমন আলোর ঝলসানি সাকুল্যে ১৮টি ধরা পড়েছে টেলিস্কোপের চোখে। ব্রহ্মাণ্ডের এত শক্তিশালী, এত উজ্জ্বল আলোর ঝলসানিটা হচ্ছে কী ভাবে, গত ১০ বছর ধরে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা। অনেকেরই সন্দেহ ছিল, এখনও এমন ধারণা রয়েছে অনেকেরই যে, ওই আলোর ঝলসানিগুলির ‘কারিগর’ আসলে ভিনগ্রহীরা! তাঁরাই বোধহয় বিশাল বিশাল আতসবাজি ফাটাচ্ছেন! আর সেটাই অত শক্তিশালী, অত উজ্জ্বল আলোর ঝলক তৈরি করছে ব্রহ্মাণ্ডে।
২০০৭-এ ধরা পড়া সেই প্রথম আলোর ঝলসানির বর্ণালী
কী ভাবে আলোর ঝলসানিগুলি তৈরি হচ্ছে, তা যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, তার অন্যতম কারণ ছিল, এক বার সেগুলি আমাদের নজরে আসার পর সেই ঝলসানি আর আমরা দেখতে পারছিলাম না। সেগুলি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল! উধাও, হাপিশ হয়ে যাচ্ছিল! এর থেকে আমাদের অনেকেরই এই ধারণা জন্মেছিল, ব্রহ্মাণ্ডে নিশ্চয়ই কোথাও কোনও বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। কোনও বিস্ফোরণ হলে যেমন হয়, তার পর পরই বেরিয়ে আসে আলোর ঝলক। একটা ঝলসানি। তার পরেই সব নিভে যায়। আবার অন্ধকারে ভরে যায় চার পাশ। গত ১০ বছরে এমন আলোর ঝলসানি যে ১৭ বার দেখা গিয়েছে মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্তে, তার প্রত্যেকটিই এক বার দেখা যাওয়ার পর আর আমাদের নজরে আসেনি। ফলে, যাঁরা বিশ্বাস করেন ভিনগ্রহীরা এখনও বেঁচে-বর্তে, বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না-কোথাও, তাঁরা এমন প্রচারও করতে শুরু করে দিয়েছিলেন, ওই সব আদতে ভিনগ্রহীদেরই কাজ! তাঁরাই ‘আতসবাজি’ ফাটাচ্ছেন!
শমীর গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়? কেন তাঁকে নিয়ে এখন বিশ্বে এত আলোড়ন?
কোথায় তৈরি হচ্ছে সেই আলোর ঝলসানি? কোন পথে আসছে পৃথিবীতে?
নিউইয়র্কে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বৈঠকের ফাঁকে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শমী বললেন, ‘‘আমরা যে আলোর ঝলসানিটা (রেডিও বার্স্ট) দেখতে পেয়েছি, সেটা একেবারেই অভিনব। গত ১০ বছরে এমন যে ১৭টি আলোর ঝলসানির ঘটনা টেলিস্কোপের নজরে পড়েছে, তার সবক’টিই এক বার ঝলসে উঠে হারিয়ে গিয়েছিল। সেগুলি ছিল ‘সিঙ্গল ফ্ল্যাশ’-এর ঘটনা। কিন্তু আমরা যে আলোর ঝলসানিটা দেখেছি, তা ছিল ‘রিপিটেড’। বার বার সেই আলোর ঝলসানিটা আমরা দেখেছি। ২০১৪-য় ‘অ্যারেসিবো’ টেলিস্কোপের ‘চোখে’ ওই আলোর ঝলসানি ধরা পড়ার খবর যখন আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জানিয়েছিলাম, তখন আমরা ২০ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ে ওই আলোর ঝলসানিটা দেখেছিলাম অন্তত ৭/৮ বার। পরে ‘ভেরি লার্জ অ্যারে’ (ভিএলএ) টেলিস্কোপে আমরা মোট ৮৩ ঘণ্টায় (প্রায় সাড়ে তিন দিন) ওই আলোর ঝলসানিটা কম করে ৯ বার দেখতে পেয়েছি। এই ‘রিপিটেড’ আলোর ঝলসানিটা গত ১০ বছরে আর দেখা যায়নি। আলোর ঝলসানিটা যখন ‘রিপিটেড’ হচ্ছে, তখন আমরা নিশ্চিত হই, এটা কোনও বিস্ফোরণ থেকে হচ্ছে না। কারণ, কোনও বিস্ফোরণ থেকে আলোর ঝলসানি হলে তা কখনও ‘রিপিটেড’ হতে পারে না। এক বার সেই আলোর ঝলসানি দেখতে পাওয়ার পরেই তা হারিয়ে যাবে। উধাও, হাপিস হয়ে যাবে। আর সেই আলোর প্রতিটি ঝলসানিই খুব বেশি হলে এক মিলি-সেকেন্ডের চেয়ে স্থায়ী হয় না। এত কম সময় স্থায়ী হয় বলেই এই রেডিও বার্স্ট বা রেডিও তরঙ্গকে অত সহজে আমরা দেখতে পাই না।’’
টেলিস্কোপের নজরে পড়া সেই আলোর ঝলসানি (লাল রং)
কোথায় জ্বলছে ওই ‘ভিনগ্রহীদের আলো’?
শমী বলছেন, ‘‘আমরা বিজ্ঞানীরা এটাকে মোটেই ভিনগ্রহীদের জ্বালানো আলো বলে মনে করি না। পরে ‘জেমিনি’ টেলিস্কোপের ‘চোখ’ দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, ওই আলো রয়েছে একটি ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি বা বামন ছায়াপথে। আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তে এমন আলোর ঝলসানি দেখতে পাওয়া যাবে না বলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস। ওই ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সিটি রয়েছে আমাদের থেকে কম করে ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। মানে, ৩০০ কোটি বছর ধরে ওই আলোর ঝলসানিটা আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘অলিম্পিকের মশাল’-এর মতো এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মানে, ‘বিগ ব্যাং’-এর জেরে ব্রহ্মাণ্ড-সৃষ্টির প্রায় এক হাজার কোটি বছর পর ওই আলোর ঝলসানিটা প্রথম দেখা গিয়েছিল। আর তা এখনও ৩০০ কোটি বছর পরেও দেখা যাচ্ছে! যার মানে, সেই আলোর ঝলসানিটা কী প্রচণ্ড শক্তিশালী আর উজ্জ্বল ছিল!’’
আচার-আচরণে কেমন এই ‘ভিনগ্রহীদের আলো’?
শমীর কথায়, ‘‘ওই রেডিও তরঙ্গের কম্পাঙ্ক ১ থেকে ২ গিগাহার্ৎজ বা ২ থেকে ৪ গিগাহার্ৎজ। আর তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার থেকে ১০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। একেবারে আলোর গতিতেই ছোটে এই তরঙ্গ। আর মূলত তা আলোক-কণা ‘ফোটন’ দিয়েই তৈরি। একটা সূর্যের মোট আয়ুষ্কালে যতটা শক্তির নিঃসরণ হয়, তাকে ১০-এর পিঠে ৩৮টা শূন্য বসিয়ে যে সংখ্যাটা হয়, তা দিয়ে গুণ করলে শক্তির যে পরিমাণ হয়, ওই আলোর ঝলসানি থেকে প্রতি মিলি-সেকেন্ডে তৈরি হয় সেই বিপুল পরিমাণ শক্তি। না হলে ৩০০ কোটি বছর ধরে জ্বলতে পারে ওই আলোর ঝলসানি! আর তা ব্রহ্মাণ্ডে কি এতটা পথ পেরিয়ে এসে এখনও অতটা উজ্জ্বলতা ঘরে রাখতে পারে!’’
ব্রহ্মাণ্ডে সেই আলোর ঝলসানির ‘ঘরবাড়ি’। সেই ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি।
শমী জানালেন, তাঁর গবেষণায় অনেকটাই সহায়তা পেয়েছেন তিনি পুণের ‘জায়েন্ট মিটার ওয়েভ রেডিও টেলিস্কোপ’ (জিএমআরটি) থেকে। পাবেন আগামী দিনেও, তাঁর গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে।
‘ভিনগ্রহীদের আলো’র ধাঁধার জট খুলে রেডিও তরঙ্গের উৎস-সন্ধানে গোটা বিশ্বকে আলো দেখালেন কলকাতার শমী!
ওয়েল ডান, শমী!
ছবি সৌজন্যে: জ্যোতির্বিজ্ঞানী শমী চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy