আমাদের সৌরমণ্ডলের এখানে ওখানে মিলতে শুরু করেছে আদ্যিকালের যুদ্ধ-টুদ্ধের ছবি! চিহ্ন, তথ্যপ্রমাণ! তা হলে কি লক্ষ, কোটি বছর আগেও যুদ্ধ-টুদ্ধ ছিল এই সৌরমণ্ডলের এ মুলুক, ও মুলুকে? মঙ্গলের তল্লাটে? শুক্রের রাজ্যপাটে? ছিল কি সভ্যতা? আমাদের মতো? বা, আরও আরও উন্নত?
বহু দিন ধরেই বাতাসে ভেসে চলা আর ছুটে বেড়ানো এই কৌতুহলগুলির পালে উৎসাহের বাতাস লাগল, সম্প্রতি। মঙ্গলে মিলল ‘প্রাচীন সৈনিকের মমি’! আর শুক্র গ্রহে দেখা গেল সুবিশাল একটা ‘ধনুক’!
গোটা বিশ্বে আপাতত জ্যোতির্বিজ্ঞান আলোড়িত হচ্ছে এই ‘আদ্যিকালের যুদ্ধ’ নিয়ে! আদ্যিকালের যুদ্ধাস্ত্র আর সৈনিকদের নিয়ে! আর সেই ‘লড়াইয়ের চিহ্ন’ গায়ে বয়ে বেড়াচ্ছে এই সৌরমণ্ডলে আমাদের দুই প্রতিবেশী গ্রহ। ‘দৈত্যগুরু’ শুক্র গ্রহ আর ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গল।
মঙ্গলে সেই ‘সৈনিকের মমি’!
মঙ্গলে ‘মানুষের মুখ’!
আদ্যিকালে প্রাণ ছিল, সভ্যতা ছিল ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে, এই দাবিতে একদল বিজ্ঞানী যখন আবার উৎসাহিত হয়েছেন নাসার রোভার মহাকাশযান ‘মিস কিউরিওসিটি’র তোলা ‘ফুটেজে’ আচমকা ‘প্রাচীন সৈনিকের মমি’র হদিশ মেলায়, তখন আর একদল বিজ্ঞানীর কার্যত, চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হয়েছে জাপানি উপগ্রহ ‘আকাতসুকি’র তোলা ছবিতে শুক্র গ্রহের গায়ে ‘ধনুকে’র চিহ্ন দেখে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলের একেবারে শীর্ষ স্তরে খোঁজ মিলেছে একটি সুবিশাল ধনুকের! এই প্রথম।
শুক্রের সেই ‘ধনুক’!
বিজ্ঞানীরা আরও অবাক হয়ে গিয়েছেন এটা দেখে যে, শুক্রের বায়ুমণ্ডলের একেবারে শীর্ষ স্তরে যেখানে প্রতি ঘণ্টায় বাতাস ছোটে ২০০ মাইলের চেয়েও বেশি গতিবেগে, সেখানে বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকা সব কিছুরই ফুৎকারে উড়ে যাওয়ার কথা চোখের এক পলকে, সেখানে বায়ুমণ্ডলের একেবারে শীর্ষ স্তরে থাকা শুক্রের ওই ‘ধনুক’ একেবারেই ‘নট নড়নচড়ন’! যেন সেই ‘ধনুক’ খুব ভারী আর শক্তপোক্ত ইস্পাত দিয়ে গড়া কোনও সুবিশাল একটা ‘মেগা-স্ট্রাকচার’! শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলের একেবারে ওপরের স্তরে অত শনশন করে বয়ে যাওয়া বাতাস একচুলও নড়াতে পারছে না সেই ধনুক! অন্তত যে চার দিন ধরে একটানা সেই ‘ধনুকে’র ছবি তুলে গিয়েছে ‘জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি’র (‘জাক্সা’) পাঠানো উপগ্রহ- ‘আকাতসুকি’, সেই চার দিনে অত উত্তাল বাতাসের ঝাপটা একচুলও নড়াতে পারেনি শুক্রের ওই ‘ধনুক’টিকে! ইনফ্রারেড ও আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মির দু’টি বর্ণালীতেই একেবারে নিখুঁত ভাবে ধরা পড়েছে আদ্যিকালের সেই ‘ধনুকে’র ছবি।
শুক্রের সেই ‘ধনুক’!
কোনও গল্পকথা নয়, নয় কোনও কল্প-কাহিনীও। শুক্রের ‘গায়ে’ ওই সুবিশাল ‘ধনুকে’র অস্তিত্বের কথা ও কাহিনী দিন দু’য়েক আগে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-জিওসায়েন্স’-এ। টোকিওর রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাকোতো তাগুচির নেতৃত্বে ওই আন্তর্জাতিক গবেষকদলে রয়েছেন এক অনাবাসী ভারতীয়ও। আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়।
শুক্রের ‘ধনুক’ নিয়ে কী বলছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মিশিও কাকু? দেখুন ভিডিও
কী দেখেছেন গবেষকরা?
শুক্রের সেই ‘ধনুক’!
আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে তাগুচি টোকিও থেকে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘আমরা এক ধরনের তরঙ্গ দেখেছি। সেটাই ওই ‘ধনুক’! যে ‘ধনুক’টা শুক্রের বায়ুমণ্ডলের একেবারে ওপরের স্তরে ৬ হাজার মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলের স্তর কিন্তু মোটেই পাতলা নয়। তার পিঠের (সারফেস) ওপরে ৪০ মাইল উচ্চতা পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে শুক্রের বায়ুমণ্ডল। যত ওপরে ওঠা যায়, ততই সেই বায়ু উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়েছে। সেই বায়ুমণ্ডলে ঠান্ডা আর গরম বায়ুর মধ্যে চলাচল রয়েছে, যেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ‘ধনুক’টাকে আমরা চার দিন ধরে নজরে রেখেও দেখেছি, তা ‘নট নড়নচড়ন’! শুক্রের বায়ুমণ্ডল কিন্তু ঠিক পৃথিবীর মতো নয়। তা বড়ই চঞ্চলা। সবসময়েই সেই বায়ুমণ্ডলে রয়েছে একটা প্রবল ঘূর্ণি। যদিও নিজের কক্ষপথে শুক্র কিন্তু লাট্টুর মতো ঘুরলেও সেই ঘূর্ণির গতি খুব একটা বেশি নয়। পৃথিবীর মতো তো নয়ই। সূর্যকে পাক মারতে শুক্র যে সময় নেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় শুক্র নেয় নিজের কক্ষপথে লাট্টুর মতো ঘুরতে। পৃথিবীর গতির মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ গতিবেগে তার বায়ুমণ্ডল ঘোরে। যেখানে শুক্রের বায়ুমণ্ডলের গতি অনেক অনেক গুণ বেশি। আর সেই খুব জোরে ঘোরা শুক্রের বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই তৈরি হয় এক ধরনের ‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ’। সেই ‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ’ই এই ‘ধনুক’টা বানিয়েছে শুক্র গ্রহে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলের চাপ অনেক অনেক বেশি পৃথিবীর চেয়ে। ১০০ গুণ তো বটেই। আর সেই বায়ুমণ্ডলের বেশির ভাগটাই ভরা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসে।’’
‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ’ কী জিনিস?
শুক্রের সেই ‘ধনুক’!
জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী, সহযোগী গবেষক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ কিন্তু ক’দিন আগে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার নিয়ে এত হই-হল্লা হল, সেই তরঙ্গ নয়। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হল ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ’। শুক্রের পাহাড়-পর্বতে, উঁচু-উঁচু এলাকায় (হাইল্যান্ডস) ধাক্কা খেতে খেতে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে ওই ‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ’-এর জন্ম হয়। সেই ধাক্কাই বায়ুমণ্ডলকে ঠেলে ওপরে তুলে দেয়। আর তার গতিবেগ কমাতে কমাতে তাকে একটা ‘ধনুকে’র চেহারা দেয়। নুড়ি-পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নদীর জলস্রোতে যেমন ওঠা-নামা হয়, এই ‘ধনুক’টাও তৈরি হয়েছে অনেকটা সেই ভাবেই। শুক্রে এই ‘ধনুক’টা যেখানে দেখা গিয়েছে, সেই এলাকাটার নাম- ‘অ্যাফ্রোডাইট টেরা’। এশিয়া বা আফ্রিকার মতো পৃথিবীর কোনও মহাদেশের মতো আকারে বিশাল একটা এলাকা শুক্রের এই ‘অ্যাফ্রোডাইট টেরা’। শুক্রে ‘গ্র্যাভিটি ওয়েভ’-এর দেখা প্রথম পেয়েছিল ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) মিশনই। কিন্তু ওই ‘ধনুকে’র দেখা মিলল এই প্রথম। তা ধরা পড়ল জাপানি উপগ্রহের চোখে।’’
আর ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে ‘সৈনিকের মমি’র হদিশ মিলল কী ভাবে?
মঙ্গলে সেই ‘সৈনিকের মমি’!
নাসার ‘মিস কিউরিওসিটি’ রোভার মহাকাশযানের পাঠানো ছবির ভিতিতে ওই দাবি করেছে ‘প্যারানরম্যাল ক্রুসিব্ল’ নামে একটি সংস্থা। সেই ছবি তারা ইউটিউব চ্যানেলে ছড়িয়েও দিয়েছে। যদিও নাসার গডার্ড স্পেস সেন্টারের মিডিয়া সেলের অন্যতম মুখপাত্র মুকুলিকা দত্তশর্মা তাঁর ই-মেল জবাবে আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ‘‘সরকারি ভাবে এর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। এর কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই। সবটাই ‘প্যারেইডেলিয়া’। বা, দৃষ্টির বিভ্রান্তি। মেঘ নিয়ে বা পাহাড়ের খাঁজে আমরা যেমন মানুষের মুখ বা পশু, পাখির চেহারার আদল খুঁজে পাই কল্পনায়, এটাও তেমনই কল্পনার একটি উৎকৃষ্ট ফসল!’’
আরও পড়ুন- ছিন্নভিন্ন তারা, আগুনের গোলা তীব্র গতিতে ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে!
ছবি সৌজন্যে: নাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy