Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নাছোড় অধীর, থাকতে দিন আর ক’দিন

কেটে দেওয়া হয়েছে জল ও বিদ্যুতের লাইন। উঠোনে ছড়িয়ে সংসারের যাবতীয় কিছু। এই অবস্থাতেও কাল তিনি হম্বিতম্বি করে গিয়েছেন নিজস্ব মেজাজে। আজ কিন্তু আদালত সরকারি বাংলো আটকে রাখার ব্যাপারে কোনও রকম ছাড় দিল না বহরমপুরের সাংসদ তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে।

সংসার পড়ে রয়েছে নিউ মোতি বাগের বাড়ির উঠোনেই। ইনসেটে হুমায়ুন রোডের বাড়ি দেখে হতাশ অধীর চৌধুরী। বুধবার। ছবি: প্রেম সিংহ।

সংসার পড়ে রয়েছে নিউ মোতি বাগের বাড়ির উঠোনেই। ইনসেটে হুমায়ুন রোডের বাড়ি দেখে হতাশ অধীর চৌধুরী। বুধবার। ছবি: প্রেম সিংহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৫১
Share: Save:

কেটে দেওয়া হয়েছে জল ও বিদ্যুতের লাইন। উঠোনে ছড়িয়ে সংসারের যাবতীয় কিছু। এই অবস্থাতেও কাল তিনি হম্বিতম্বি করে গিয়েছেন নিজস্ব মেজাজে। আজ কিন্তু আদালত সরকারি বাংলো আটকে রাখার ব্যাপারে কোনও রকম ছাড় দিল না বহরমপুরের সাংসদ তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে। জানিয়ে দিল, হুমায়ুন রোডে নতুন বরাদ্দ করা বাংলোতেই উঠে যেতে হবে চার বারের সাংসদকে। সেই বাংলো বরাদ্দের চিঠিও নিয়ে নিয়েছেন অধীরবাবু। তবে জেদ ছাড়ছেন না। ইউপিএ জমানায় অল্প কিছু দিন রেলমন্ত্রী থাকার সুবাদে ১৪ নিউ মোতি বাগের যে বাংলোটিতে এত দিন থাকছিলেন, সেখানেই যাতে আরও দিন পনেরো অন্তত থাকতে পারেন, তার জন্য আগামিকাল ফের তিনি আদালতের শরণ নিতে পারেন।

গত কাল দুপুরে উচ্ছেদ অভিযান থমকেছিল আদালতের স্থগিতাদেশে। আজ সকালে দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, নিউ মোতি বাগের বাসভবন পত্রপাঠ ছেড়ে হুমায়ুন রোডের বাড়িতে উঠে যেতে হবে প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রীকে। এর পর দুপুরেই অধীরবাবু হুমায়ুন রোডের বাসভবন ঘুরে দেখতে যান। প্রশ্ন হল, নতুন বাড়িতে উঠে যেতে তাঁর আপত্তিটা কীসে? অধীরবাবুর দাবি, এই বাড়িটি বাসযোগ্য নয়। জল-বিদ্যুৎ কোনওটাই নেই। চুনকাম করা হলেও মেরামতির কাজ হয়নি। অভাব নিরাপত্তারও। যদিও এ দিনই সরকারের তরফে সলিসিটর জেনারেল রঞ্জিত কুমার আদালতকে জানিয়েছেন, হুমায়ুন রোডের বাসভবনটি বাসযোগ্য। আর তা শোনামাত্রই অধীরবাবুর আর্জি আজ খারিজ করে দেয় উচ্চ আদালত। অধীরবাবুর জানাচ্ছেন, বাড়িটি সংস্কার করতে পূর্ত বিভাগ দু’সপ্তাহের মতো সময় চেয়েছে। আবার নিউ মোতি বাগের বাড়িতেও জল-বিদ্যুৎ নেই। অন্তত পনেরো দিন যাতে মোতি বাগের বাড়িতেই থাকতে পারেন সে জন্য কাল তিনি ফের আদালতের দ্বারস্থ হতে চান।

রাজধানীর পুরনো লোকজন ও রাজনীতিকরা বলছেন প্রাক্তন মন্ত্রীদের সরকারি বাংলো না ছাড়া নিয়ে আগেও অনেক টালবাহানা হয়েছে। কিন্তু ঘরের মালপত্র টেনে উঠোনে টেনে বার করে দেওয়ার মতো ঘটনা, মনে করতে পারছেন না কেউই। সাংসদ পদ চলে যাওয়ার পরেও জনপথে সনিয়া গাঁধীর বাসভবনের লাগোয়া বিশাল বাসভবনে এক রকম জোর করে ছিলেন রামবিলাস পাসোয়ান। পরে সরকারকে মোটা টাকা ভাড়া দিয়ে সেই বাড়িতে থাকেন তিনি। মনমোহন সিংহের জমানায় একই কাজ করেছিলেন বিজেপির যশবন্ত সিন্হা ও যশোবন্ত সিংহ। আবার নরেন্দ্র মোদীর জমানায় ইউপিএ সরকারের দুই প্রাক্তন মন্ত্রী অজিত সিংহ, অম্বিকা সোনির সরকারি বাসভবন খালি করতে ঘাম ছুটে যায় সরকারের।

নতুন মন্ত্রীদের জন্য বাসভবনের ব্যবস্থা করতে গিয়েও কম হ্যাপা পোহাতে হয় না সরকারকে। যেমন অধীরবাবু নিউ মোতি বাগের যে বাড়িতে ছিলেন নতুন সরকার আসার পর প্রথমে সেটি কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। পরে তথ্য-সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠৌরের জন্য বরাদ্দ করা হয়। অধীরবাবু বাড়ি না ছাড়ায় অগত্যা তাঁদের অন্য বাসভবন খুঁজে নিতে হয়। নিউ মোতি বাগের ওই বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বারবার নোটিস পাঠিয়েছে লোকসভার হাউস কমিটি। কিন্তু প্রতি বারই নানান যুক্তি ও অছিলায় বাড়িটি ছাড়তে রাজি হননি অধীরবাবু। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সচিবালয়ের তরফেও এ ব্যাপারে তাঁর হয়ে তদ্বির করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকে। আর এ ভাবেই মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরেও দেড় বছর ওই বাড়িটি আঁকড়ে ছিলেন অধীরবাবু। শেষমেশ ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাঁকে বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য নোটিস পাঠিয়েছিল সরকারের এস্টেট বিভাগ। সেই নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আদালতে চলে যান বহরমপুরের সাংসদ! আজ কিন্তু তাঁর অযৌক্তিক বায়নাক্কা শুনতে চাইল না আদালতও!

কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু আজ ঘরোয়া মহলে বলেন, ‘‘এঁরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক। তাঁদের এ ভাবে বার বার নোটিস দিতে হবে কেন? লোকসভায় সাংসদরা আইন প্রণয়ন করেন। তাঁরাই যদি নিয়ম-নীতির ফাঁক খোঁজেন, তা হলে মানুষ কী ভাববে? প্রাক্তন মন্ত্রীদের উচিত বিনা বাক্য ব্যয়ে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা।’’ এ বিষয়ে বরং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের তারিফ করছেন সরকারের নেতারা। মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর তথা লোকসভা ভোটে পরাস্ত হওয়ার পর দিনই সরকারি বাসভবন ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন চিদম্বরম। নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এক যুগ্মসচিবের কথায়, ‘‘অধীর চৌধুরীর উচিত ছিল নোটিস পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া। বরাদ্দ করা নতুন বাসভবনে গিয়ে কোনও সমস্যা হলে তখন তিনি বিকল্প ব্যবস্থার জন্য হাউস কমিটির কাছে আর্জি জানাতে পারতেন।’’

অধীরবাবু কিন্তু এখনও বাড়িটি না ছাড়ার পক্ষেই যুক্তি দিয়ে চলেছেন। তাঁর বক্তব্য, রেল প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে যখন ওই বাসভবন বরাদ্দ করা হয়, তখনই তিনি হাউস কমিটিকে বলেছিলেন, ভোটের বেশি দিন বাকি নেই। তাঁর মন্ত্রিত্ব খুবই স্বল্প মেয়াদের হবে। তাই তাঁকে এমন বাড়িই দেওয়া হোক যা চার বার জেতা লোকসভার সাংসদ পেতে পারেন। সেই মোতাবেক তাঁকে লুটিয়েন দিল্লির বৃত্তের প্রায় বাইরে নিউ মোতি বাগের বাংলোটি দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, গত বছর নভেম্বর মাসে তাঁকে যখন তৎকালীন হাউস কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিজেপি সাংসদ কিরিট সোমাইয়া নোটিস পাঠান, তখন জবাবে তিনি অনুরোধ করেছিলেন নিউ মোতি বাগ বা লাগোয়া এলাকায় বিকল্প বাসস্থান দেওয়া হোক। কারণ, তিনি দিল্লিতে সব সময় থাকেন না। তাঁর ছ’বছরের শিশুকন্যার স্কুল মোতি বাগের বাড়ির কাছে। নিউ মোতি বাগে ও তিলক লেনে জেনারেল পুলে কিছু বাড়ি ফাঁকাও রয়েছে। বর্তমান বাসভবনের থেকে মাপে ছোট হলেও এর মধ্যে কোনও একটি বাড়িতে তিনি ‘খুশি’ মনে চলে যেতে রাজি। কিন্তু তা করা হয়নি। মাঝে এক দিন রাজ্যবর্ধন রাঠৌর সপরিবার নিউ মোতি বাগের বাড়িটি দেখতে আসেন। তাঁকে তিনি গোটা বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। কারণ, বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন। অধীরবাবুর এ-ও বক্তব্য, হুমায়ুন রোডের বাসভবন নিরাপদ নয়। বাসযোগ্যও নয়।

তবে দল নির্বিশেষে বেশির ভাগ রাজনীতিকই প্রশ্ন বলছেন, সব প্রাক্তন মন্ত্রীই যদি এ ধরনের যুক্তি সাজিয়ে বাড়ি ছাড়তে দেরি করেন, তা হলে নতুন মন্ত্রীরা কোথায় থাকবেন? এই সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় নগোরন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এ দিনও বলেন, ‘‘অধীরদা খামোখা জেদাজেদি করে হয়রান হলেন। ওঁকে আমি বলেছিলাম, হুমায়ুন রোডের বাড়িতে কী অসুবিধা রয়েছে আমাকে বলুন। কী মেরামতি করতে হবে, একটা তালিকা তৈরি করে দিন। মুখ্য কারিগরি আধিকারিককে দিয়ে আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করিয়ে দেব।’’ এর জবাবে অধীরবাবু কিন্তু বাবুলকেই বিঁধেছেন। তাঁর কথায় ,‘‘বাবুল প্রতিমন্ত্রী। তাঁর কোনও এক্তিয়ারই নেই। গত কাল যখন আমার বাড়িতে জল ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হয়, তখনও বাবুল আমাকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন।’’

রাজ্যে ভোটের মুখে এই চাপানউতোরে কার কতটা রাজনৈতিক লাভক্ষতি সে প্রশ্ন আলাদা। তবে সার কথা এটাই, নিউ মোতি বাগের বাস ওঠাতেই হচ্ছে অধীরবাবুকে। দু’রাত্তির তিনি ওই বাড়ির বাইরে। উঠোনে খোলা পড়ে আছে বাক্সপ্যাঁটরা, সংসারের মালপত্র, সংসদে তোলা গ্রুপ ফটো, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি.....। সেগুলো কবে সরাবেন, প্রশ্ন এখন শুধু এটুকুই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE