ছবি: পিটিআই
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ফের মুখ খুললেন শর্মিলা ঠাকুর। দিল্লিতে রবিবারের এক লেখক কনভেনশনে আসতে না পারলেও নিজের ভিডিও মেসেজ পাঠান তিনি। শর্মিলার উদ্বেগ, যে অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে তা আমাদের সংবিধানের বিরুদ্ধে, আমাদের গণতান্ত্রিক রীতি নীতির বিরুদ্ধে এবং আমাদের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে। ‘‘এই সব সময়ে আমি রবীন্দ্রনাথের কথা ভাবি। রবীন্দ্রনাথও ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন’’- বলেন শর্মিলা। কদিন আগেই আদন্দবাজারের ওয়েবসাইটে অহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তিনি। সে লেখা আলোড়ন তুলেছিল দেশ জুড়ে।
শর্মিলার মতোই অসহিষ্ণু পরিবেশ নিয়ে সরব হলেন প্রবীণ সরোদশিল্পী উস্তাদ আমজাদ আলি খানও। লখনউয়ে একটি অনুষ্ঠানে রবিবার আমজাদ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর উচিত দলের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আনা। না হলে দেশের শান্তি বিঘ্নিত হবে। পরিস্থিতি আদৌ স্বাভাবিক নয়।’’ প্রতিবাদী শিল্পীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এঁরা কেউ তো পাগল নন। এঁরা সকলে ব্যথিত।’’ তিনিও কি পুরস্কার ফেরত দেবেন? শিল্পী বলেন, ‘‘আমি পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি।’’
সরকার অবশ্য প্রতিরোধের রাস্তা হিসেবে বেছে নিচ্ছে পাল্টা আক্রমণকেই। ফেসবুকে ফের দীর্ঘ নিবন্ধ লিখে আসরে নেমেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সম্প্রতি মুডি়জ-এর মতো মূল্যায়ন সংস্থার রিপোর্ট বলেছে, অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ চলতে থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন থমকে যাবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন, ইনফোসিস-এর নারায়ণমূর্তিরাও একই সুরে সরকারকে সতর্ক করছেন। অরুণ আগে ফেসবুকে বিশিষ্ট জনেদের পুরস্কার ফেরানো নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। ফের কলম ধরে এ দিন তিনি বলতে চেয়েছেন, উন্নয়নের রথ সচল আছে। ‘ইজ অব ডুয়িঙ্গ বিজনেস’ শিরোনাম দিয়ে দাবি করেছেন, বিনিয়োগের পরিবেশ কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বরং জেটলির অভিযোগ, মোদী নিজেই আসলে অসহিষ্ণুতার শিকার। জেটলির কথায়, কংগ্রেস ও বাম চিন্তাবিদরা বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে গোড়া থেকেই আদর্শগত অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে আসছেন। তাঁরাই লাগাতার সংগঠিত প্রচারের মাধ্যমে ভারতকে একটি অসহিষ্ণু সমাজ হিসেবে মেলে ধরার চেষ্টা করছেন।
জেটলি বোঝানোর চেষ্টা করছেন, দাদরি একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার ভারতের বৃদ্ধি তরান্বিত করার কাজেই লিপ্ত। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, বিজেপি যে ক্ষমতায় থাকবে, বিশিষ্ট জনেদের অনেকেই সেটি মেনে নিতে পারেননি। এঁদের কৌশল দু’টি। এক, সংসদ অচল করে দেওয়া, যাতে কোনও সংস্কারের কাজ হতে না পারে। নরেন্দ্র মোদী সরকার যাতে কোনও কৃতিত্ব পেতে না পারে। আর দুই, সংগঠিত ভাবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে ভারত একটি অসহিষ্ণু সমাজ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। ২০০২ সাল থেকে মোদী নিজে এই আদর্শগত অসহিষ্ণুতার সব থেকে বড় শিকার। জেটলির কথায়, ‘‘দাদরির ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। দোষীদের শাস্তি হবে। কিন্তু যাঁরা এই নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁরা কখনও কোনও বিকল্প ও বিপরীত ধারার মতকে সহ্য করতে পারেন না। যে সব বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক সংস্থায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেখানে বিকল্প মতকে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি কখনও।’’ তবে ঘটনা হল, এই মুহূর্তে অসহিষ্ণুতার প্রশ্নটিকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া সরকারের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আগের রবিবার রেডিও-র ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে মোদী নিজে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কথা বলেছিলেন। আগের দিন জেটলিকে মুম্বইয়ের বাণিজ্যসভায় প্রতিকূল অবস্থায় ভারতের লড়াকু মানসিকতার কথা বলতে হয়েছে। এ দিন পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ লিখে তাঁকে বিরোধীদের দিকে তোপ দাগতে হল। গোটা গোটা করে বলতে হল, ‘‘ভারত সহিষ্ণু ও উদার সমাজ ছিল এবং থাকবে। ভারত বারবার অসহিষ্ণুতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কোনও প্ররোচনায় পা দেয়নি।’’
রাঁচিতে তিন দিন ধরে আরএসএসের বৈঠক চলছিল। সেখানে আজ শেষ দিনে সঙ্ঘের নেতা ভাইয়াজি জোশীও বলেন, ‘‘দাদরিতে যা হয়েছে, তা নিন্দনীয়। এই ধরনের ঘটনা সমাজের জন্য ভাল নয়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, সঙ্ঘের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে সঙ্ঘের নাম জড়িয়ে দেওয়া একটি ষড়যন্ত্র।’’
কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, মোদী সরকার আসার পর থেকেই সমাজে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গোমাংস নিয়ে ফতোয়া, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গেরুয়াকরণ, যুক্তিবাদীদের আক্রমণ ও হত্যা, পাকিস্তানি শিল্পীদের আটকে দেওয়া, কালি মাখানোর হিড়িক— গেরুয়া শিবিরের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছে ক্রমাগত।
বিরোধীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী অন্য বিষয়ে কথা বললেও এই সব বিষয়ে সে ভাবে মুখ খোলেন না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক পরে একটি-দু’টি মন্তব্য করেন মাত্র। সরকার এই অবস্থার পরিবর্তনে কতটা আন্তরিক, বোঝা যায় না তা-ও। বিরোধী শিবিরের পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিক-ইতিহাসবিদ-শিক্ষাবিদ-চিত্রপরিচালকরা বেশ কিছু দিন ধরেই এ নিয়ে সরব হচ্ছেন। এ দিন আমজাদও প্রধানমন্ত্রীকে শক্ত হতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য কাজ করতে চান ঠিকই। কিন্তু তাঁর আশপাশের কিছু মানুষ যা খুশি বলেন, যা খুশি করেন। তাঁদের বাগে আনা না-গেলে সমূহ বিপদ।’’
আমজাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এ দিন প্রতিবাদী শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অভিনেত্রী শাবানা আজমিও। পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়াকে ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ হিসেবে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
সব মিলিয়ে অসন্তোষের আঁচটা বিজেপি নেতৃত্ব বুঝছেন না, এমন নয়। শুধু দেশে নয়, সরকারের ভাবমূর্তি বিদেশেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূল্যায়ন সংস্থা মুডিজ এই নিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে। এক সময় এই সব সংস্থার রিপোর্ট ধরেই ইউপিএ সরকারকে তুলোধনা করত বিরোধী বিজেপি। সামনেই সংসদের অধিবেশন। সেখানেও বিরোধীরা সুর চড়াবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছেন। মঙ্গলবারই কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির কাছে যাচ্ছে। তিস জানুয়ারি মার্গ থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা করে অসহিষ্ণুতা নিয়ে স্মারকলিপি পেশ করবেন তাঁরা। রাষ্ট্রপতি নিজেও অসহিষ্ণুতা নিয়ে বার্তা দিয়ে আসছেন। এই বহুমুখী আক্রমণ প্রতিরোধ করতেই আজ নিবন্ধ লিখে জেটলি তর্কের মোড় ঘোরাতে চাইলেন। পাল্টা তোপ দাগলেন। কিন্তু প্রকারান্তরে তাঁকে কবুল করতে হল, মোদী সরকারের সমর্থনে বলার মতো বিশিষ্ট জন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হচ্ছে তাঁদের পক্ষে।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
অসিহষ্ণুতা প্রসঙ্গে আমির খানকে কটাক্ষ অনুপমের
দেশ ছেড়ে যেতে হবে না তো! আতঙ্কিত স্ত্রীর প্রশ্ন আমিরকে
বিস্ফোরক শাহরুখ: দেশে এখন চরম অসহিষ্ণুতা
নিজের ধর্মের মৌলবাদ নিয়ে আগে কথা বলুন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy