মোহনদাস এবং মোদী।
ইতিহাসের গতি বড় বিচিত্র। এক দিন এই গুজরাত থেকে উঠে এসেই ভারতভূমিতে নতুন ধারার এক আন্দোলন রচনা করেছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। ব্যক্তিগত ভাবে নিজেকে হিন্দু সমাজের অংশ হিসেবে দেখলেও, দেশের সমাজ-রাজনীতির বৃহত্তর প্রাঙ্গনে তিনি ধর্মীয় বিভাজনকে কখনওই প্রশ্রয় দেননি। হিন্দু সমাজের বর্ণভিত্তিক কর্মবিভাজনে বিশ্বাসী থেকেও, তিনি প্রবল ভাবে বিরোধিতা করেছেন জাতপাত, অস্পৃশ্যতার।
ঘটনাচক্রে গাঁধীর গুজরাত থেকেই উঠে আসা আর এক মুখ, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, আজকের ‘ফেস অব দ্য নেশন’ হয়ে উঠেছেন। প্রভাবে, ক্যারিশ্মায়, দাপটে, একচ্ছত্র ক্ষমতায় এই মুহূর্তে দেশে তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই। আর নরেন্দ্র মোদী যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নেতা, সেখানেও তিনি এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর দৌলতে গুজরাতই এখন বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আদরের ‘রাজধানী’।
আজকের এই গেরুয়াধামে গেরুয়া রাজনীতির উত্থান শুরু গত শতকের সাতের দশকে। ১৯৬০ সালে গুজরাত আলাদা রাজ্য হয়। প্রথম বিধানসভা ভোট ১৯৬২-তে। ভারতীয় জনসঙ্ঘ সেই ভোটে লড়ে মাত্র ১.৩৪ শতাংশ ভোট পায়। আসন একটাও পায়নি (মোট আসন ছিল ১৫৪)।
পরের ভোট ১৯৬৭ সালে। একটি আসনে জেতে জনসঙ্ঘ (সে বার মোট আসন ১৬৮)। ১৯৭২-এ তিনটি আসন। ১৯৭৫ সালের ভোটে আসন বেড়ে হল ১৮ (সে বার থেকেই গুজরাত বিধানসভায় মোট আসন ১৮২)।
১৯৭৭-এ জনসঙ্ঘ মিশে যায় জনতা পার্টিতে। তবে বছর তিনেকের মধ্যেই সেই সংগঠন ভেঙে বেরিয়ে পুরনো জনসঙ্ঘীরা তৈরি করলেন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। গুজরাতে ১৯৮০-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ন’টি আসন। ১৯৮৬-র ভোটে ১১টি। এই সংখ্যা এক লাফে ৬৭ ছুঁয়ে ফেলে ১৯৯০ সালে। এবং জনতা দলের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়ল বিজেপি। সে সরকার অবশ্য এক বছরও টেকেনি। বিজেপি সরে গিয়ে তার জায়গায় সরকারে ঢোকে কংগ্রেস।
১৯৯৫ সালের ভোটে ১২১ আসনে জিতে গুজরাতে একক ভাবে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। দু’বছরের আগেই সে সরকার ভেঙে গিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন। বছর দেড়েক পর আবার ভোট। বিজেপি ১১৭। এর পর থেকে কোনও ভোটেই ১০০-র কম আসন পায়নি বিজেপি।তবে ব্যতিক্রম ঘটল এ বার।
২০০১-এর শেষ দিকে নানান অভিযোগে জর্জরিত এবং অসুস্থ কেশুভাই পটেল মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়ান। মুখ্যমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী। এবং সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশের এক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। গুজরাত দাঙ্গা, সংখ্যালঘুদের উপর একের পর এক নৃশংস হামলায় তাঁর পরোক্ষ মদতের অভিযোগ উঠল। দেশ জুড়ে নিন্দা, সমালোচনার ঝড়। কিন্তু ২০০২-এর শেষে গুজরাত তাঁকে সাদরে ক্ষমতায় বসাল আবার। এবং এই জয়টাই বোধহয়, নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক 'কেরিয়ার' এবং বিজেপি-র সাংগঠনিক জীবনে নিয়ে এল বড়সড় টার্নিং পয়েন্ট।
গুজরাতে নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ধরে রেখে, এক যুগের মধ্যেই বিজেপির সাংগঠনিক রাশ তিনি তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে সামনে রেখে কংগ্রেসকে ধুলিসাত্ করে দেয় বিজেপি। ১৯৮৪-র পর এই প্রথম কোনও দল লোকসভায় একক ভাবে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেল। এই বিপুল জয় সংগঠনেও তাঁর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে দিল এক লহমায়। দলের প্রথম প্রজন্মের নেতৃত্বকে কোণঠাসা করে, পূর্ণ রাশ হাতে তুলে নিতে সময় নেননি মোদী।
জয়ের মালা। দুই রাজ্যে জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি
সর্বভারতীয় সভপতি অমিত শাহ। সোমবার নয়াদিল্লিতে বিজেপির দফতরে।ছবি: এএফপি।
গুজরাতে এ বার জয় এলেও, আসন অনেকগুলো কমেছে। স্বয়ং মোদীর পক্ষে এটা বেশ অস্বস্তির। কারণ গুজরাতে তাঁকে মুখ করেই ভোটে নেমেছিল দল। সেটা না করলে যে বিপর্যয় হত, তাও পরিষ্কার। কিন্তু ২০১৯-এ পরের লোকসভা ভোটে যাওয়ার আগে, তাঁর নিজের রাজ্যে তুলনামূলক খারাপ ফলটা মোদীর পক্ষে স্বস্তির হল না। তবে জেতাই যদি শেষ কথা হয়, তবে মোদী জিতেছেন, এবং তাঁর হাত ধরেই বিজেপি গুজরাতে টানা ছ’টা বিধানসভা ভোট জেতার কৃতিত্ব অর্জন করল।
আরও পড়ুন: ‘জয় হয়েছে উন্নয়নের রাজনীতির, হেরেছে পরিবারতন্ত্র, জাতপাত’
বিজেপি-র এই কৃতিত্ব অন্য কোনও রাজ্যে নেই। তবে ১৯৮০ সালে জন্মের কয়েক বছর পর থেকে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতা যে ভাবে বেড়েছে, তা নজর করার মতো।
এই মুহূর্তে দেশের ২৯টা রাজ্যের মধ্যে ১৪টাতে একক ক্ষমতায় বিজেপির সরকার। এ ছাড়া আরও দুই রাজ্যে, বিহার এবং জম্মু-কাশ্মীরে, জোট করে সরকারে আছে বিজেপি। কংগ্রেস ক্ষমতায় মাত্র চার রাজ্যে। কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরি ধরলে পাঁচ।
গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ভৌগোলিক আয়তনের নিরিখে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিজেপি-র একক শাসনে আছে। জোট সরকার ধরলে এই এলাকা ৬৯ শতাংশের বেশি।
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy