Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
নোটের আমি

‘এ ভাবে চললে কী খাবেন? ওঁরা দিন আনেন, দিনই খায় ওঁদের’

লখিরামের কথাই তা হলে ধরা যাক প্রথমে। দিনমজুর, আপাতত বীরভূমের এক প্রত্যন্ত এলাকার কয়লার কারখানায় রোজ খাটছেন। খাটছেন ঠিকই, কিন্তু হাতে টাকা পাচ্ছেন না একটিও। মালিকের কাছে টাকা নেই, তাই ধারেই পরিশ্রম দিচ্ছেন লখিরাম।

শ্রীজাত
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৯
Share: Save:

লখিরামের কথাই তা হলে ধরা যাক প্রথমে। দিনমজুর, আপাতত বীরভূমের এক প্রত্যন্ত এলাকার কয়লার কারখানায় রোজ খাটছেন। খাটছেন ঠিকই, কিন্তু হাতে টাকা পাচ্ছেন না একটিও। মালিকের কাছে টাকা নেই, তাই ধারেই পরিশ্রম দিচ্ছেন লখিরাম। বাড়িতে চাল ছাড়া কিছুই নেই, সেই দিয়েই চালাতে হচ্ছে দু’বেলা দু’মুঠো। তবে কালও যদি মালিক কিছু টাকা না দেন, কী খাবেন লখিরাম জানেন না। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। আধার কার্ড নেই। অপেক্ষা আছে।

অল্প জমিতে ধান চাষ করেন বর্ধমান জেলার দিলীপ মণ্ডল। তাঁর খেতমজুরেরা, ওই লখিরামের মতোই ধারে খাটুনি দিচ্ছেন এখন। কিন্তু আর কত দিন? ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। বিক্রি করে সেই টাকায় আলু চাষ শুরু করবার কথা। এ দিকে কোনও আড়তদার ধান কিনতে পারছেন না। তাঁদের কারও কাছে সেই পরিমাণ নগদ টাকা নেই। এই ধান যদি শেষমেশ বিক্রি না হয়, কী করবেন তা জানেন না মাঝবয়সি কৃষক দিলীপ। কৃষকদের জন্য ব্যাঙ্কের নিয়ম পৃথক রাখা হয়েছে। কিন্তু ক’জন ব্যাঙ্ক অবধি পৌঁছতে পারবেন, তা জানা নেই।

গ্রামের চৌমাথায় ছোট্ট একটা মুদির দোকান চালান আলেমা বিবি। বয়েস অনেক, অবসর নেবার উপায় নেই। কিন্তু পাঁচশো-হাজারের নোট অচল হবার পর দিন থেকে দোকানে খদ্দের নেই বিশেষ। গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। খদ্দের এলেও অবশ্য খুচরো ফেরত দিতে পারবেন না। সুতরাং বিকিকিনি বন্ধ। দোকান এখনও খোলা রাখছেন, কিন্তু এ ভাবে চললে সেটাও বন্ধ করে দিতে হবে সত্তর ছুঁই ছুঁই আলেমা বিবিকে।

বোলপুরের পথে পথে এক ঝাঁক ঝাড়ন কাঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হারেজ মণ্ডল। এটাই তাঁর একমাত্র পেশা, যা থেকে বিগত কয়েকদিনে কোনও রোজগার হয়নি। ঝাড়নের দাম একশো টাকা, যা এখন মধ্যবিত্তের চোখের মণি, হৃদয়ের টুকরো। তাকে বিদেয় করে ঘরে ঝাড়ন আনা মানে নিজের সংসারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ‘এ ভাবে চললে কী খাবেন?’ প্রশ্নটা শুনে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন হারেজ। তার পর বললেন, ‘জানি না’।

উত্তর অবশ্য কেউই জানি না। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তটা শোনামাত্র আমরা প্রত্যেকেই ঘরে মজুত টাকাপয়সার হিসেব কষতে বসেছি আগে। যেমন, আমাদের বাড়িতে নানা ব্যাগ, ওয়ালেট, আলমারি ঝেড়েঝুড়ে বেরিয়েছিল সাকুল্যে চারখানা একশো টাকার নোট। সঙ্গে সাড়ে তিন হাজার টাকা, যা তত ক্ষণে অচল। আমি আর দূর্বা দু’শো টাকা করে নিয়ে পরের তিন দিনের পরিকল্পনা করেছি। সামনে বইমেলা, খুব জরুরি কাজে প্রকাশকের দফতরে যাবার কথা ছিল, টাকা হাতে রাখতে হবে বলে যেতে পারিনি। তার পর দূর্বা ব্যাঙ্ক থেকে দু’হাজার টাকা তুলতে পেরেছিল। আমাদের যারা বন্ধুবান্ধব, তাঁদেরও অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধে হয়েছে বিলক্ষণ। আর সকলেই নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েছি এই ভেবে যে, সেই বেকারজীবন কাটানোর মতো গুনে গুনে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু নস্ট্যালজিয়ার বিলাসিতা আর আদত সমস্যার মধ্যে বহু যোজনের দূরত্ব।

বড় শহরে থাকার সুবাদে কার্ড দিয়ে প্রায় সব কিছুই কিনে ফেলা যায় বলে, সামান্য উদ্বেগের বেশি কিছু আমাদের মানায় না। হ্যাঁ, ব্যাঙ্কে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে, এই যা। গত কয়েক দিন তামাম ভারতবাসী ধৈর্যের সঙ্গে সরণিভুক্ত হয়েছেন, সেখানেও নানা সমস্যা হয়েছে। এ সব সমস্যার আগাম আঁচ নিশ্চয়ই ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে? প্রিয় দেশবাসীদের কাছ থেকে তিনি অপরিসীম সহ্যক্ষমতা ও ধৈর্য প্রার্থনা করেছেন এবং সৌভাগ্যক্রমে পেয়েছেন। সম্ভবত শাসকেরা চিরকালই জেনে থাকেন, সাধারণ মানুষ সব মেনে নেয়। গুটিকয় মানুষ সমর্থনে মানেন, বাকিরা বাধ্যবাধকতায়। এ সবই আঁচ করেছিলেন তিনি।

আঁচ করেছিলেন, সাধারণ মানুষ কিছু দিনের জন্য পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে পড়বেন। উদ্বেগ আর আশঙ্কায় কাটবে তাঁদের প্রহর। কিন্তু বড় কিছু ঘটাতে গেলে এটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হয়। আঁচ করেছিলেন, টানা বেশ কিছু দিন প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে দেশজোড়া ব্যাঙ্ক কর্মীদের। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এটুকু ত্যাগ কি করবেন না তাঁরা? করবেন নিশ্চয়ই। তিনি আঁচ করেছিলেন, খুচরো ও ছোট ব্যবসায়ীরা বিরাট ধাক্কার সম্মুখীন হবেন, যা সামাল দিয়ে উঠতে প্রাণ বেরনোর জোগাড় হবে। কিন্তু ভবিষ্যতের সোনালি দিনগুলোর কথা ভেবে এটুকু সহ্য না-করার কিছু নেই।

এর সব ক’টাই তিনি জানতেন, তাঁর মন্ত্রিসভাও জানত। কিন্তু এত সবের ধাক্কায় যাদের প্রাণ গেল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, সদ্যোজাত শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ, তাঁদের কি তা হলে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? নিহত নিরাপরাধেরা তো চিরকালই এই খেতাব পেয়ে এসেছেন, তাই না?

চমকে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত কতখানি কার্যকরী, তা বিচার করবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদেরা। আমি সাধারণ মানুষ, পাঁচ টাকা রোজগার করি, সাড়ে চার টাকা খরচ করি। ভারতে কালো টাকার মোট পরিমাণ যত, সেই সংখ্যায় কতগুলো শূন্য, জিগ্যেস করলে আমার সময় লাগবে। কিন্তু এটুকু বুদ্ধি হয়তো আছে, যাতে বোঝা যায় কালো টাকা একটা সমান্তরাল ও ক্ষতিকর অর্থনীতি চালায়। যা দেশের অর্থনীতির পক্ষে ভাল নয়। এমনকী সন্ত্রাসও, হ্যাঁ, কালো টাকার মদতে পুষ্ট। সুতরাং কালো টাকার নিকেশ চাইবে না, এমন কোনও সাধারণ মানুষ নেই।

এখন কথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের যখন এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে, তখন কালো টাকাওয়ালা মানুষদের কি এটুকু বুদ্ধি নেই, যা প্রয়োগ করে বড় অঙ্কের কালো টাকা সুরক্ষিত রাখা যায়? কিছু নোট উড়ল, কিছু পুড়ল, কিছু বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে থাকল। কিছু কারবারি নজরে এলেন, যারা এখন কিছু দিন আর কালো টাকার নাম উচ্চারণ করবেন না। কিন্তু আমার সাধারণ বুদ্ধি বলে, এঁরা হলেন হিমশৈলের চূড়া। টিপ অব দ্য আইসবার্গ। জলের নীচে আসল যে-অংশটি চাপা পড়ে আছে, এই সিদ্ধান্তের এলেমে সেই মগ্ন মৈনাক নড়েচড়ে উঠবে তো? আহা, পরশুই চাইছি না। আগামী পাঁচ বছরে? হবে তো তেমন? হলে জাতীয় অর্থনীতির মঙ্গলই হবে এবং শেষমেশ হলে নিশ্চয়ই সে খতিয়ানও প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রিয় দেশবাসীদের সামনে রাখবেন। কিন্তু তার পরেও, এমনকী প্রতিটি পাই-পয়সা ধবধবে ফর্সা হয়ে রাস্তায় বেরনোর পরেও, এই মৃত্যুরাশি ক্ষমার অযোগ্য হয়েই থাকবে। এর দায় কে নেবে তা হলে? উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ?

এ সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুরছিলাম গ্রামগুলোয়। ভাবছিলাম, এই সিদ্ধান্তের পিঠ চাপড়ে দেওয়া যেত নিশ্চিত, যদি একটু পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হতো। যদি পথেঘাটে ঝাপসা প্রশ্নময় চাহনিগুলো দেখতে না হতো। আর হাঁটতে হাঁটতেই বুঝতে পারছিলাম, ভারতবর্ষ আসলে অনেকগুলো দেশের নাম। আমার ভারতবর্ষ, আলেমা বিবির ভারতবর্ষ, শাহরুখ খানের ভারতবর্ষ, দিলীপ মণ্ডলের ভারতবর্ষ, মুকেশ অম্বানির ভারতবর্ষ। খুব নাটকীয় শোনালেও, সত্যি এটাই। এখন প্রশ্ন, একসঙ্গে সব ক’টা ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায় কি? বোধ হয় না। ইব্রাহিম লোধি থেকে নরেন্দ্র মোদী, দেশের নিচুতলার অবস্থা খুব বেশি বদলায়নি। যারা দিন আনেন, দিন খান, সব কিছুর শেষে দিনই এক দিন তাঁদের খেয়ে ফেলে। সেটাই তাঁদের অচ্ছে দিন।

তবে হ্যাঁ, এই সিদ্ধান্তের জোয়ারে গোটা দেশকে এক ঝটকায় নিটোল বানিয়ে ফেলা গেছে। এই যে এলাম গেলাম কলকাতা থেকে, কোথাও কোনও টোল ট্যাক্স দিতে হল না।
সব বন্ধ।

ফিরছিলাম সন্ধেবেলার হাইওয়ে দিয়ে। আর বারবার মনে পড়ছিল নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকা হারেজ মণ্ডলের মুখ। তার পর তাঁর অস্ফুটে বলে ওঠা, ‘জানি না’। সুশাসক তো তিনিই, যিনি সিংহাসনে বসেও দেশের দূরতম প্রান্তিক মানুষটির মুখ দেখতে পান। হারেজ সেই মুখগুলোরই প্রতিনিধি। এক জন ঝাড়ন বিক্রেতাই যদি খেতে না পান, স্বচ্ছ ভারত গড়ে উঠবে কোন উপায়ে?

অন্য বিষয়গুলি:

Srijato Bandyopadhyay labours
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy