নগদের অভাবে সর্বত্র হাহাকার উঠলেও এই পরিস্থিতি আগাম হিসেব কষেই করা হয়েছে বলে দাবি আয়কর দফতরের।
আয়কর দফতরের পশ্চিমবঙ্গ সার্কেলের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেশন) প্রিয়ব্রত প্রামাণিক শনিবার বলেন, ‘‘নগদের জোগান কমানো হয়েছে পরিকল্পনা করেই। আগাম হিসেব কষেই এই পদক্ষেপ। কারণ আমজনতা নগদ-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসুক— এটাই চায় সরকার।’’ ওই আয়কর কর্তা জানান, দেশে নগদের কারবার যত বেশি হবে ততই কর আদায়কারী সংস্থাগুলির কাজ কঠিন হবে। কারণ, নগদ অর্থনীতির উপর নিরন্তর নজরদারি খুবই কঠিন কাজ। এর পদচিহ্ন খুঁজে ফেরা দুষ্কর। কিন্তু নগদের বদলে সমস্ত লেনদেন অনলাইন, কার্ড কিংবা মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে হলে আয়কর দফতরের পক্ষে তার উপর নজরে রাখা সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে কর ফাঁকিও কঠিন হয়ে প়ড়বে। এই কারণেই সরকার চাইছে মানুষ নগদ কম ব্যবহার করুক।
রোটারি সদনে নোট বাতিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক আলোচনা সভায় কলকাতার এই আয়কর কর্তা নগদের জোগান কমানোর যে তত্ত্ব শুনিয়েছেন, গত ২৪ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি দিল্লিতে কার্যত সে কথাই বলেছিলেন। অর্থমন্ত্রী সে দিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সমস্ত ব্যাঙ্কের সিইও-র কাছে সরকারি নীতি তুলে ধরেছিলেন। জেটলির মোদ্দা কথা ছিল, সমস্ত ব্যাঙ্ক এখন থেকে নগদ লেনদেনের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলাকেই অগ্রাধিকার দিক। অর্থমন্ত্রী সে দিন ব্যাঙ্ক কর্তাদের বলেন, ‘‘বাজারে নগদ অর্থের জোগানের চেয়ে মানুষ যাতে ডিজিটাল কারেন্সিতে অভ্যস্ত হয়, সেটাই দেখতে বলা হয়েছে। নোট বাতিলের নেপথ্যে দেশে ডিজিটাল লেনদেনের পথ প্রশস্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।’’
পঞ্জাবের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও নগদের বদলে মোবাইল ওয়ালেট, প্রি-পেড কার্ড, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড, এনইএফটি-র মতো লেনদেনে অভ্যস্ত হওয়ার আবেদন জানান। শহর ছাড়িয়ে আধা শহর কিংবা গ্রামেও যাতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো যায়, সে জন্য ব্যাঙ্কগুলি প্রচার অভিযান চালাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
নোট বাতিলের পর সরকার যে তথ্য পেশ করেছে, তাতে জানানো হয়েছে— প্রথম ১৫ দিনে ৬ লক্ষ কোটি টাকার পুরনো নোট ব্যাঙ্কে জমা হলেও ব্যাঙ্ক থেকে নতুন নোট দেওয়া হয়েছে মাত্র দেড় লক্ষ কোটি টাকার। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বাঞ্চলের কর্তাদের বৈঠকেও বলা হয়েছে, মাস পয়লায় নগদের জোগান দেওয়া বেশ মুশকিল। যার অর্থ, বেতনভোগীদের একপ্রকার বাধ্য করা হচ্ছে কার্ডের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। আগামী তিন মাস এই পরিস্থিতি চললে অনেকেই হাতে টাকা রাখার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবেন বলে মনে করছে সরকার।
যদিও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবর কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বাজারে টাকা নেই। নিজের টাকাও তুলতে পারছেন না মানুষ। তাঁরা কি এখন প্লাস্টিক খাবেন?’’ এ রাজ্যে চা-বাগান ও চটকল শ্রমিকদের মজুরির টাকা বিলি বন্ধ রয়েছে বলেও কেন্দ্রের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে রাজ্য। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট সচিব প্রদীপকুমার সিনহা ভিডিও কনফারেন্সে প্রশ্ন তোলেন— চা বাগানের সব শ্রমিকের এখনও কেন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই? রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এ দিন দিল্লিতে বলেন, ‘‘চা বাগানের অবস্থা কি কেন্দ্র জানে? জানলে চা-শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট করার কথা বলত না।’’
• নগদের জোগান কমানোর ঘটনা পরিকল্পনা করেই এবং আগাম হিসেব কষেই নেওয়া হয়েছে। কারণ সরকার চায় আমজনতা নগদ-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসুক।
প্রিয়ব্রত প্রামাণিক
আয়কর কর্তা
• প্রচলিত ব্যবস্থায় যে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, তার ব্যথা সাময়িক। আগামী তিন মাসে ডিজিটাল অর্থনীতির যে বিকাশ হবে, অন্য সময়ে তা তিন বছরেও করা যেত না।
নন্দন নিলেকানি
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
• ডিজিটাল অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত আমিও চাই। কিন্তু সরকার কোনও নাগরিককে বাধ্য করতে পারে না।... এ সব আবার বলাও মুশকিল। এখুনি হয়তো দেশদ্রোহী বলে বসবে।
অনুপ সিংহ
অর্থনীতিবিদ
নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার প্রশ্ন, ‘‘রাজ্যের ৩৩৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৭০০টিতে কোনও ব্যাঙ্কই নেই। পঞ্চায়েত অফিসে ব্যাঙ্কের শাখা খোলার কথা বলা হলেও ব্যাঙ্কগুলি সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। যে দেশে হাজার হাজার গ্রামে কোনও ব্যাঙ্ক নেই, সেখানে নগদবিহীন অর্থনীতি চলবে কী করে?’’
তবে অর্থনীতিকে ধাক্কা লাগলেও তা সাময়িক বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষ়জ্ঞ নন্দন নিলেকানি। নয়াদিল্লিতে তিনি বলেন, ‘‘প্রচলিত ব্যবস্থায় যে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে তার ব্যথা হবে সাময়িক। আগামী তিন মাসে দেশে ডিজিটাল অর্থনীতির যে বিকাশ ঘটবে তা তিন বছরেও করা যেত না। ’’
সুফল কতটা মিলবে, সে ব্যাপারে অবশ্য আশাবাদী নন আইআইএম জোকার অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘ডিজিটাল অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত আমিও সমর্থন করি। কিন্তু সেটা সুপরিকল্পিত ভাবে করা উচিত। সরকার কখনও নাগরিককে কোনও কাজে বাধ্য করতে পারে না। আমি আয়ের উপর করও দেব। আবার হেনস্থার শিকারও হব আমি?’’ অনুপবাবুর খেদোক্তি, ‘‘এ সব আবার বলাও মুশকিল। এখুনি হয়তো দেশদ্রোহী বলে বসবে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy