শশিকলা নটরাজন, মঙ্গলবার। ছবি: রয়টার্স।
প্রায় তিরিশ বছর আগের একটা দৃশ্যপট ফের ফিরে এসেছে চেন্নাইতে। হুবহু এক রকম নয়, কিন্তু অনেকটাই এক রকম।
রাজাজি হলে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল জয়ললিতার দেহ। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দেহ সেখানে শায়িত ছিল বিকেল প্রায় চারটে পর্যন্ত, প্রায় ১০ ঘণ্টা। এই ১০ ঘণ্টা ধরে ‘আক্কা’র (দিদি) দেহ আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন শশিকলা নটরাজন। ঠিক যে ভাবে সেই কোন ’৮৭ সালে এমজিআর-এর মৃতদেহের মাথার কাছে ঠায় দু’দিন দাঁড়িয়েছিলেন জয়ললিতা।
জয়ললিতার দীর্ঘ দিনের বান্ধবী তথা বোন শশিকলা। চেন্নাইয়ের পোয়েস গার্ডেনে জয়ললিতার বাড়িতেই থাকতেন তিনি। দলীয় বা সরকারি কোনও পদে কখনও বসেননি। কিন্তু এমজিআর (এমজি রামচন্দ্রন) চলে যাওয়ার পর থেকে জয়ার জীবনে সবচেয়ে কাছের মানুষটি যে শশিকলা নটরাজন, তা আম্মার সুবিশাল অনুগামীকুলের অজানা নয় মোটেই। তাই রাজাজি হলের দরজায় শায়িত জয়ার মৃতদেহের পাশে শশিকলা নটরাজন ও তাঁর পরিবারকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্য রকম জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক মহলে।
তিন দশক আগে। রাজাজি হলে শায়িত এমজিআর-এর মৃতদেহের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে জয়ললিতা। ছবি: সংগৃহীত।
এমজিআর-এর শেষকৃত্যের দিনটা মনে পড়ছে অনেকেরই। ১৯৮৭ সালে এই ডিসেম্বরেই প্রয়াত হন জয়ললিতার রাজনৈতিক গুরু তথা তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এমজি রামচন্দ্রন। তামিল চলচ্চিত্র জগৎ থেকে এমজিআর-এর হাত ধরেই রাজনীতিতে আসা জয়ললিতাই যে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি, তা অঘোষিত ভাবে অনেকেই জানতেন। কিন্তু এমজিআর-এর স্ত্রী জানকী এবং পরিবারের অন্যরা জয়াকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। এমজিআর-এর মৃত্যুর পর তাই প্রথমে জয়ললিতাকে মৃতদেহ পর্যন্ত পৌঁছতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অদম্য জেদে সব বাধা ঠেলে রাজনৈতিক গুরুর দেহ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন জয়ললিতা।এই রাজাজি হলেই শায়িত ছিলেন এমজিআর-ও। টানা দু’দিন তাঁর দেহ রাখা ছিল সেখানে। টানা দু’দিনই মৃতদেহের মাথার কাছে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন জয়ললিতা। এমজিআর-এর অত্যন্ত ভরসার পাত্রী হিসেবে এআইএডিএমকে-তে তাঁর যে কর্তৃত্ব ছিল, এমজিআর-এর অবর্তমানে যে সেই কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে না, তা জয়ললিতা ভালই বুঝেছিলেন। দলে তাঁকে টিকতে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ে ছিলেন। সেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই সম্ভবত মৃতদেহের মাথার কাছে ঠায় দু’দিন দাঁড়িয়ে ছিলেন জয়া। এমজিআর-এর উপর তাঁর অধিকার এবং এমজিআর-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরার হাতিয়ার করে তুলতে চেয়েছিলেন সেই ছবিটাকেই। জয়া কিন্তু সফল হয়েছিলেন। এমজিআর-এর উত্তরসূরি হিসেবে সফল ভাবে নিজেকে তুলে ধরে দল ও সরকারের কর্তৃত্ব কী ভাবে জানকীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জয়া, কী ভাবে আম্মা হয়ে উঠেছিলেন লক্ষ লক্ষ সমর্থকের কাছে, ভারতীয় রাজনীতি তার সাক্ষী।
জয়ললিতার মৃতদেহের পাশে শশীকলা। এই ছবি অনেককে এমজিআর-এর মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দিয়েছে মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
মঙ্গলবার শশিকলা নটরাজনের সৌজন্যে কিন্তু সেই ছবি আবার ফিরেছে তামিলনাড়ুতে। জয়ললিতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে দীর্ঘ দিন আলোকবৃত্তে ছিলেন তিনি, ক্ষমতার কেন্দ্রেও ছিলেন। কিন্তু দলে যে তাঁর শত্রুর সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, তাও শশিকলা জানেন। জয়ললিতা যত দিন ছিলেন, শশিকলার কেশাগ্র স্পর্শ করার দুঃসাহস ছিল না কারও। আজ জয়ললিতা নেই। তাই দলে তাঁকে আর টিকতে দেওয়া হবে কি না, শশিকলা নিশ্চিত নন। তাই তাঁকে আজ প্রমাণ করতে হচ্ছে, আম্মার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ তিনিই ছিলেন। আম্মার মৃতদেহের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে শশিকলাকে সম্ভবত বোঝাতে হচ্ছে, আম্মার উত্তরাধিকারে তাঁর অংশীদারিত্বকে কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
জয়ললিতার উত্তরসূরি হিসেবে দল বেছে নিয়েছে ও পনীরসেলভমকে। দলের শীর্ষ পদেও তিনি, মুখ্যমন্ত্রীও তিনি। কিন্তু শশিকলা নটরাজন চাইছেন, দলের কর্তৃত্ব তাঁর হাতে আসুক। এআইএডিএমকে সূত্রের খবর অন্তত তেমনই। দলের সাধারণ সম্পাদক পদে সম্ভবত নিজের পছন্দের কাউকে বসাতে চাইছেন শশিকলা। ইচ্ছাপূরণ যে খুব সহজ নয়, তা শশিকলা নিশ্চয়ই জানেন। সেই কারণেই জয়ার মৃত্যুর পর শশিকলার হাত ধরে আবার ফিরে আসছে এমজিআর-এর মৃত্যুর পরবর্তী দৃশ্যপট। শশিকলার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের কোনও মন্তব্যে কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ‘উচ্চাকাঙ্খা’ সংক্রান্ত বার্তা এখনও পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। কিন্তু সাংঘাতিক এক নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই যে শশিকলাকে জয়ার মৃতদেহের পাশে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, সে নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লষেকদের মধ্যে মতভেদ কমই।
আরও পড়ুন: ‘বহু বাধার বিরুদ্ধে লড়েছি, জয়াজির লড়াইটা বুঝি’
দল ও সরকার পরিচালনার পথে শশিকলা কি পনীরসেলভমের পথে কাঁটা হয়ে উঠতে চলেছেন? নাকি পনীরসেলভমদের দাপটে শশিকলা ছিটকে যেতে চলেছেন? উত্তর দেবে সময়ই। তবে ওয়াকিবহাল মহল বলছে, শশিকলার পক্ষে এই মুহূর্তে পনীরসেলভমকে বেকায়দায় ফেলার কঠিন। কারণ এমজিআর-এর মৃত্যুর পর জানকীর অনুগামীরা জয়াকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করেছিলেন বলেই জয়ার পক্ষে দ্রুত সহানুভূতির ঝড় উঠেছিল। শশিকলার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা ঘটতে দেননি পনীরসেলভমরা। তবে রাজাজি হলের দরজায় যে মঙ্গলবার ইতিহাসের এক পুনরাবৃত্তি মঞ্চস্থ হয়েছে, তা নিয়ে তামিল রাজনীতির অলিন্দে প্রায় কারও সন্দেহ নেই।
মাঝের তিরিশটা বছরের দু’পাশেই কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র এক জনই— জয়রাম জয়ললিতা। তিরিশ বছর আগে জীবিত জয়ললিতা রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের কেন্দ্রস্থলে এসেছিলেন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে। তিরিশ বছর পর মৃত জয়ললিতাও রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের কেন্দ্রে। এ বারের চিত্রনাট্য রচিত হচ্ছে জয়ললিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের দখল পাওয়ার লড়াইকে কেন্দ্র করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy