Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মহাশ্বেতা-স্মরণে: হাইলাকান্দি আপনার স্মৃতিচারণায় গর্বিত

কথাটা মহাশ্বেতা দেবী কোথাও লিখে গিয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে তখন বারবার শুনিয়েছেন, আমি আগে কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করিনি। হাইলাকান্দিতেই প্রথম।

নীতীশ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৩
Share: Save:

কথাটা মহাশ্বেতা দেবী কোথাও লিখে গিয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে তখন বারবার শুনিয়েছেন, আমি আগে কখনও সাংবাদিক সম্মেলন করিনি। হাইলাকান্দিতেই প্রথম।

কথাটা প্রথম শুনেছিলাম নির্মল ভট্টাচার্যের মুখে। তাঁর মাধ্যমেই মহাশ্বেতা দেবী আমাদের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। নির্মলবাবু বললেন, সাংবাদিক সম্মেলনেও রাজি হয়েছেন! আপনি সার্থক। এ পর্যন্ত তিনি কোথাও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি। পরে একই কথা শোনালেন মহাশ্বেতা দেবী নিজে। শুরুতেই বললেন, আপনাদের এখানেই আমার জীবনের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন। তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে গর্বিত আমরা—বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, হাইলাকান্দি শহর, এবং এই শহরের সাংবাদিকরা।

তারিখটি ছিল ১৯৯৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ১ তারিখে তিনি হাইলাকান্দিতে আসেন। বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ষোড়শ অধিবেশনের প্রধান অতিথি। এক বক্তৃতায় সবাইকে কাছে টেনে নেন। তখন তিনি সাহিত্যজগতের মধ্যগগনে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা পড়েননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। প্রত্যন্ত শহর হাইলাকান্দিও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি সেদিন রবীন্দ্র ভবনের মঞ্চ উদ্বোধন করেছিলেন। আজও সে মঞ্চে প্রায় প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এও আমাদের গর্বের কথা!

তৃতীয় দিনে হয় সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন। হাইলাকান্দি সার্কিট হাউসে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানেই কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে।

আরও পড়ুন- ‘আমার বর্তিকায় লেখো’! রিকশাওয়ালা মদন সেই থেকে লেখক হয়ে গেলাম

আধঘন্টা ধরে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে মত বিনিময় করেন। মূল বক্তব্য ছিল সমাজের অবহেলিত-জনদের নিয়ে।

আজও কানে বাজে তাঁর সেদিনের কথা। কোন যুক্তিতে পুলিশ কিছু কিছু জনগোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে? পশ্চিমবঙ্গে টোটো এবং শবর-দের এরা ‘ক্রিমিন্যাল ট্রাইব’ হিসেবে বিবেচনা করে! এর বিরুদ্ধেই তিনি আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন।

চার দিনের অধিবেশন হয়েছিল সেবার। চারদিনই ছিলেন। কিন্তু তাঁকে এখানে আসার ব্যাপারে আমাকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি। ষোড়শ দ্বিবার্ষিক অধিবেশনের অভ্যর্থনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। প্রথমে পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাহায্য চেয়েছিলাম। তাঁরা শুনেই বলে দিয়েছিলেন, মহাশ্বেতা দেবীকে পাবেন না। তিনি কোথাও বক্তৃতা করতে যান না। জেদ চাপে আমার। সোজা তাঁর বাড়ি চলে যাই। প্রথম দিন কাছেপিঠে ঘেঁষার

সুযোগ পাইনি। নির্মল ভট্টাচার্যকে বলি। সাধন চট্টোপাধ্যায়কেও ধরি। পরপর চারদিন যাওয়ার পর কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, বড় নাছোড়বান্দা তুমি। একে-ওকে দিয়ে বলানোর জন্য দু-চারটি মন্দকথাও শুনিয়ে দেন।

আরও পড়ুন- সব মরণ নয় সমান

তবে সাংবাদিক সম্মেলনের কথায় রাজি হননি। আবার কী মনে করে পরদিন নির্মলবাবুকে বললেন, নাছোড়বান্দা লোকটিকে জানিয়েও দিও, সাংবাদিক সম্মেলনও করব। এ কথাটা পরে নির্মলবাবুর কাছে শোনা।

সে বার মহাশ্বেতা দেবী ছাড়াও অধিবেশনে এসেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অমিয়কুমার দেব, বিভাস চক্রবর্তী ও সাধন চট্টোপাধ্যায়।

বিরাট হৃদয়ের মহাশ্বেতা দেবী উপর উপর বড় রুক্ষ ছিলেন। হাইলাকান্দির অনেকে তা টের পেয়েছেন। এখনও দেখা হলে গৌতম রায় তাঁর কথা উল্লেখ করেন। গৌতমবাবু তখন প্রতিমন্ত্রী।

আরও পড়ুন-শ্রীমহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬)

দেখা করতে গিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে। পরিচয় জেনেই লাগালেন ধমক। কী করছো তোমরা। জনগণের কাজ কোথায়। আদিবাসীদের জন্য কোনও কাজ তো দেখছি না।

তবে আজ লিখতে গিযেও বারবার মনে পড়ছে সেদিনের সেই সাংবাদিক সম্মেলনের কথা। আমার সঙ্গে ছিলেন বরাক বঙ্গের পক্ষে সুদর্শন ভট্টাচার্য। ছিলেন প্রয়াত শক্তিধর চৌধুরী, অতীন দাশ, হারাণ দে, সন্তোষ মজুমদার, প্রয়াত বিমল কান্তি দাস, শতানন্দ ভট্টাচার্য, আশিসরঞ্জন নাথ, কুমার দাস, অমিত রঞ্জন দাস প্রমুখ।

মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে একটি যুগের অবসান হল। সেই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

আরও পড়ুন- স্মৃতির পাতায় মহাশ্বেতা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE