আর কোনও রাখ-ঢাক নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন, ‘‘দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) কিছু ছাত্রের ভারত-বিরোধী স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি মদত রয়েছে পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার।’’
বলা ভাল, একেবারে তিল থেকে তাল!
ছাত্রদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের যোগসাজশ রয়েছে কি না, এ বার সেটাও খুঁজতে শুরু করে দিল পুলিশ।
ও দিকে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভারত-বিরোধী স্লোগান, সত্যি-সত্যি কারা দিয়েছিলেন, বামপন্থী নাকি বিজেপি-র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র ছাত্ররা, তা নিয়ে তদন্তের দায়িত্ব জেলাশাসককে দিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। তিনি আজ টুইট করে বলেছেন, ‘‘ভারত-বিরোধী স্লোগানটা সত্যি-সত্যিই কারা দিয়েছে, তার তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। সেই দায়িত্বটাই দেওয়া হয়েছে জেলাশাসককে।’’
আরও পড়ুন- জেএনইউ ঝড়ে ফের মোদীর বিরুদ্ধে এককাট্টা বিরোধীরা
বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিতর্ক, এখন ঘটনাচক্রে জাতীয় রাজনীতির বড় বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এর কিছু ছাত্রের ভারত-বিরোধী স্লোগান এবং তার জেরে ছাত্র সংসদের সভাপতির গ্রেফতারির বিরুদ্ধে কেন্দ্রকে একজোটে নিশানা করল কংগ্রেস, বাম, নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) এবং আম আদমি পার্টি। কংগ্রেস, বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে এককাট্টা করার কৃতিত্বটা অবশ্যই প্রাপ্য মোদী সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ এবং সঙ্ঘ-পরিবারের। ঘটনা হল, সংসদে বাজেট অধিবেশনের মুখে আচমকা জেএনইউ নিয়ে ওঠা এই ঝড়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল মোদীর সংস্কার কর্মসূচির ভবিষ্যৎ।
জেএনইউ ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ সভায় রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরিরা একসঙ্গে হাজির হয়ে আজ মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, এটা সেই অসহিষ্ণুতা, যা ভিন্ন মত উঠে এলেই কণ্ঠরোধ করতে হাত তোলে। রাহুলের কথায়, ‘‘এক জন ছাত্র নিজের মত প্রকাশ করছে বলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলছে। এরা ও এদের নেতারাই রোহিত ভেমুলাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলেছিল হায়দারাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।’’ ইয়েচুরি বলেন, ‘‘হাতে গোনা কিছু ছাত্রের ভুলকে হাতিয়ার করে গোটা ছাত্রসমাজে সন্ত্রাস ছড়ানো হচ্ছে। যাতে কোনও বিরুদ্ধ মত উঠে আসতে না পারে।’’
সব মিলিয়ে ঘটনার চেয়েও তার পিছনে রাজনীতির অঙ্কটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে গোনা কিছু ছাত্র আফজল গুরুর ফাঁসি ও অন্যান্য মানবাধিকার প্রসঙ্গে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তাতে বাধা দেয় সঙ্ঘ-পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। এই বিবাদের মধ্যে দু’একজন ছাত্র ভারত-বিরোধী স্লোগান দেন। ক্যাম্পাসেই হয়তো মিটে যেত ব্যাপারটা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের গন্ধ পান। দু’জনেই জানিয়ে দেন, এ সব রাষ্ট্রবিরোধী কাজকর্ম বরদাস্ত করা হবে না। নির্দেশ পেয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে দিল্লি পুলিশ। শুক্রবার ছাত্র সংসদের সভাপতি, সিপিআইয়ের ছাত্র সংগঠনের নেতা কানহাইয়া কুমারকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঠোকা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। রাতেই অন্য বাম ছাত্রনেতাদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চলে হোস্টেলে হোস্টেলে। গত কাল কানহাইয়া গ্রেফতার হওয়ার পর আজ ফের সাত ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে দিল্লি পুলিশ।
এমন ঘটনায় যে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে, সরকার বা বিজেপি কারওই তা অজানা নয়। তাই প্রশ্ন উঠছে, এক দিকে নরেন্দ্র মোদী যখন মুম্বইয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র কর্মসূচি নিয়ে দেশে লগ্নি ও শিল্পায়নের জোয়ার আনতে চাইছেন, সংস্কারের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ঐকমত্যের কথা বলছেন, তখন বিজেপি কেন এ ভাবে বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার মঞ্চ তৈরি করে দিচ্ছে? জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে কেন তাঁদের হাতে অসহিষ্ণুতা, বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে?
মোদী সরকার তথা বিজেপির এই মনোভাব নিয়ে কংগ্রেসের ব্যাখ্যাটি এ রকম: এ সব আসলে আর্থিক ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা। অনেকে বলছেন, বিজেপি নেতাদের স্বভাবই এমন যে, তাঁরা সংযম রাখতে পারেন না। মুখে উদারতা ও সহিষ্ণতার কথা বললেও অসহিষ্ণু চেহারাটা বেরিয়েই পড়ে।
কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বের দাবি, জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে আসলে বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি। নিজেদের জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করতে তারা কংগ্রেস-বামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলছে। কংগ্রেসের এক নেতা এমনও বলছেন, উত্তরপ্রদেশে মুজফ্ফরনগর, দেওবন্দ-সহ ৩টি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন ও কর্নাটকের কিছু জেলায় পঞ্চায়েত ভোট ছিল কাল। এ সব মাথায় রেখেই জেএনইউ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
শিক্ষাবিদদের অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, দু’একজন ছাত্র ভারত- বিরোধী স্লোগান দিলেই কি রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়ে? বিশ্বে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা এমন কিছু আন্দোলনে যোগ দেয়, যা সাধারণ নিয়মে বেআইনি। তার জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশ পাঠাতে হয় না। বিশেষ করে জেএনইউ-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে
বরাবরই সব ধরনের মত বা বিতর্ককে উৎসাহ দেওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। প্রভাত পট্টনায়েক, উৎসা পট্টনায়েক, মৃদুলা মুখোপাধ্যায়, কে এন পানিক্করের মতো জেএনইউ-এর প্রাক্তন শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, ছাত্র সংসদের সভাপতিকে শেষ বার গ্রেফতার করা হয়েছিল জরুরি অবস্থার সময়। বাম ও কংগ্রেস নেতাদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও অবিলম্বে কানহাইয়ার মুক্তির দাবি তুলেছেন। ক্যাম্পাসে এ দিনের বিক্ষোভে হাজার আড়াই ছাত্রের ভিড়ে ছিল এবিভিপি-র সদস্যরাও। তাদের হাতে খানিকটা হেনস্থা হতে হয় কংগ্রেসের আনন্দ শর্মাকে। কংগ্রেস এক দীর্ঘ বিবৃতিতে এর নিন্দা করেছে।
বাম নেতা ও ছাত্ররা কিন্তু এর মধ্যে অন্য অঙ্কও দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, এবিভিপি জেএনইউ-এ জমি বাড়াতে মরিয়া। জনপ্রিয় ও সুবক্তা কানহাইয়া তাদের পথে বড় কাঁটা। তাই তিনি শাসক শিবিরের নিশানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy