Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
National News

একক বৃহত্তম বিজেপি, কিন্তু কংগ্রেসের চালে নাটক টানটান, সরকার গড়ার দাবি দু’পক্ষেরই

রায় বেশ চমকপ্রদ। ভোটপ্রাপ্তির বিচারে কংগ্রেস এগিয়ে বিজেপির চেয়ে। কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি। বিজেপি ৩৬ শতাংশের বেশি। কিন্তু আসনপ্রাপ্তির হিসেবে রাহুল গাঁধী-সিদ্দারামাইয়া জুটিকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন মোদী-শাহ-ইয়েদুরাপ্পারা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ১৮:৪৪
Share: Save:

বুথফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত ছিল, কাঁটায়-কাঁটায় টক্করের। আভাস ছিল ত্রিশঙ্কু বিধানসভার। অতএব, ফল ঘোষণার পরে যে টানটান রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা যেতে পারে, বেঙ্গালুরুর রং যে মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাতে পারে, সে কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়েও বেশি চমক দিচ্ছে কর্নাটক।

রায় বেশ চমকপ্রদ। ভোটপ্রাপ্তির বিচারে কংগ্রেস এগিয়ে বিজেপির চেয়ে। কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭ শতাংশের বেশি। বিজেপি ৩৬ শতাংশের বেশি। কিন্তু আসনপ্রাপ্তির হিসেবে রাহুল গাঁধী-সিদ্দারামাইয়া জুটিকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছেন মোদী-শাহ-ইয়েদুরাপ্পারা। একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১০৫টি-র মতো আসন পাওয়া প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে বিজেপি। কংগ্রেস নেমে এসেছে ৭৮-এ। দেবগৌড়ার জেডি(এস)-ও আগের চেয়েও কমে ৩৭-এ নেমেছে। কিন্তু কংগ্রেস-জেডি(এস) হাত মেলালে সহজেই টপকে যাচ্ছে বিজেপি-কে। অনায়াসে টপকে যাচ্ছে ম্যাজিক ফিগারও।

গণনা শুরু হতেই হাসি ফুটতে শুরু করেছিল গেরুয়া শিবিরে। কিন্তু গণনা শেষ পথে যেতেই সেই হাসি ম্লান হয়ে চাপে পড়ে যায় বিজেপি। বৃহত্তম দল হয়েও হয়ত সরকার গড়া যাবে না— ‘আতঙ্ক’ ছড়িয়ে যায় বিজেপি শিবিরে। কারণ, তৃতীয় স্থানে থাকা জেডি(এস)-কে মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়ে ততক্ষণে জোট প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছে কংগ্রেস।

কর্নাটকের নির্বাচনে আক্ষরিক অর্থেই ‘সর্বশক্তি’ প্রয়োগ করেছিল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া একের পর হইচই ফেলে দেওয়া পদক্ষেপ করছিলেন গত কয়েক মাস ধরে। কংগ্রেসি রাজনীতির প্রথাগত ঘরানা থেকে অনেকটা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ইয়েদুরাপ্পাকে রোখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু তকমা পাওয়ার যে দাবি লিঙ্গায়ৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে ছিল, সেই দাবিতে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছিল সিদ্দারামাইয়ার সরকার। ছাপ মারা বিজেপি হিসেবে পরিচিত লিঙ্গায়ৎদের নিজের দিকে টানতেই এই পদক্ষেপ করেছিলেন সিদ্দা। কন্নড় অস্মিতা জাগানোর জোরদার চেষ্টাও করেছিলেন। ভোটের মরসুমেই কর্নাটকের জন্য আলাদা পতাকা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। দক্ষিণী রাজ্যগুলোয় যে হিন্দি-বিরোধী ভাবাবেগ কাজ করে, সেই ভাবাবেগকে সাঙ্ঘাতিক ভাবে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিজেপি-কে ‘উত্তর ভারতীয়দের দল’ আখ্যা দিয়েছিলেন। দক্ষিণী রাজ্যগুলির উপার্জনে উত্তরের রাজ্যগুলি প্রতিপালিত হয়— অর্থ কমিশনের একটি রিপোর্ট তুলে ধরে এই রকম তত্ত্ব চারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: অরুণকে সরিয়ে পীযূষেই ভরসা, বদলি স্মৃতিরও

উত্তর ভারতীয় বনাম দক্ষিণ ভারতীয়ের লড়াই উস্কে দেওয়া কোনও দিনই কংগ্রেসি রাজনীতির অঙ্গ ছিল না। হিন্দি বিরোধী ভাবাবেগ নিয়েও কংগ্রেসকে খেলতে দেখা যায়নি আগে কখনও। আর কর্নাটকের রাজনীতিতে যে জাতপাতের সমীকরণ, তাতে কংগ্রেস ভোক্কালিগাদের দল হিসেবেই পরিচিত। লিঙ্গায়ৎদের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব রয়েছে। তাই লিঙ্গায়ৎ সমাজের একাংশের দাবি মেনে ওই সম্প্রদায়কে ধর্মীয় সংখ্যালঘু তকমা দেওয়ার প্রস্তাবে সিলমোহর বসানোও কংগ্রেসি রাজনীতির প্রেক্ষিতে ছকভাঙা পদক্ষেপ।

শুধু সিদ্দারামাইয়ার কৌশলেই অবশ্য সীমাবদ্ধ ছিল না কংগ্রেসের রণকৌশল। হাইকম্যান্ডও কোমর বেঁধে নেমেছিল কর্নাটকের দখল ধরে রাখতে। এআইসিসি-র একগুচ্ছ দুঁদে নেতাকে সঙ্গে নিয়ে কর্নাটক চষে ফেলছিলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। অসুস্থতা তুচ্ছ করে জনসভা করছিলেন সনিয়া গাঁধী। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আক্রমণ ঝাঁঝালো করতে আসরে নামানো হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেও।

রাহুল-সিদ্দারামাইয়ার যৌথ উদ্যোগ কিন্তু সফল হয়নি। গত বিধানসভায় কংগ্রেসের আসনসংখ্যা যা ছিল, এ বার তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি খুইয়েছে কংগ্রেস। আর বিজেপির আসন আগের বারের চেয়ে প্রায় পৌনে তিন গুণ হয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে মোদী-শাহ-ইয়েড্ডি ব্রিগেড সফল। কিন্তু ১৫০ আসন পাবে বলে দাবি করেছিল যে বিজেপি, ম্যাজিক ফিগার ১১২-তেও পৌঁছতে না পারাটা সেই বিজেপির পক্ষে কিছুটা হতাশাজনকই।

*আসনপ্রাপ্তির এই হিসেব গণনা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগের। চূড়ান্ত হিসেবে সামান্য অদল-বদল হতে পারে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আশা-নিরাশা বা প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেবে ডুব দেওয়ার সময় অবশ্য কোনও পক্ষের হাতেই ছিল না এ দিন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে থেমে যেতে হয়েছে বিজেপি-কে। আর বড়সড় পরাজয়ের মুখ দেখা কংগ্রেস এবং আগের বারের চেয়েও কম আসন পাওয়া জেডি(এস)-এর সামনে পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার সুযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে দু’তরফেই দিনভর ছিল তুমুল টেনশন। যে কোনও মূল্যে সরকার গড়ার জন্য ছিল জোর তৎপরতা।

এর আগে গোয়া এবং মণিপুরে একক বৃহত্তম দল হয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুই রাজ্যেই অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ছোটখাটো দলগুলিকে কাছে টেনে নিয়ে সরকার গড়ে ফেলে বিজেপি। এ বার কর্নাটকে ঠিক সেই ফর্মুলাতেই বিজেপি-কে ধরাশায়ী করতে চাইছিল কংগ্রেস।

বিজেপি-কে সরকার থেকে দূরে রাখাই যে হেতু মূল লক্ষ্য কংগ্রেসের, তাই মুখ্যমন্ত্রিত্ব জেডি(এস)-কে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে সরাসরি দেবগৌড়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। দেবগৌড়ার ছেলে কুমারস্বামীর সঙ্গেও কথা হয় তাঁদের। কুমারস্বামী পূর্ণ মেয়াদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হবেন এবং কংগ্রেসের কোনও দলিত নেতা উপমুখ্যমন্ত্রী পদ পাবেন— এই ফর্মুলা প্রস্তাবিত হয়। দেবগৌড়ার সঙ্গে খোদ সনিয়া গাঁধী কথা বলেন। তার পরেই জেডি(এস)-এর তরফেও জানানো হয়, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়েই সরকার গড়া হবে। দেবগৌড়া বলেন, ‘‘বিজেপি-কে সরকার থেকে দূরে রাখতে হলে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়াই একমাত্র পথ।’’

আলোচনা চূড়ান্ত হতেই রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চান জেডি(এস) এবং কংগ্রেস নেতারা। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রাজ্যপাল তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে রাজভবনের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী কুমারস্বামী রওনাও হয়ে যান রাজভবনের পথে। জেডি(এস)-কংগ্রেস শিবিরে ফের উল্লাসের ছবি ফেরে।

আরও পড়ুন: কর্নাটকের ভোট মিটতেই বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম

কিন্তু বেঙ্গালুরু মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদল করছিল দিনভর। ফলে অপেক্ষায় ছিল আরও নাটক। বিজেপি-র তরফে আগেই সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী বিএস ইয়েদুরাপ্পা, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অনন্ত কুমার এবং কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডি ভি সদানন্দ গৌড়া সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন। ইয়েদুরাপ্পা ধন্যবাদ জানান কর্নাটকের জনতাকে। ‘‘সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছেন জনগণ। তা সত্ত্বেও কংগ্রেস ক্ষমতা দখলে রাখতে চাইছে।’’ মন্তব্য করেন ইয়েড্ডি।

প্রকাশ্যে এটুকুই ছিল বিজেপি নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া। নেপথ্যেই চলছিল আসল তৎপরতা, যা প্রকাশ্যে আসে পরে। সরকার গঠনের দাবি বিজেপি কখন পেশ করবে, রাজভবনে কখন যাওয়া হবে, সে নিয়ে প্রকাশ্যে কিছুই জানানো হয়নি বিজেপির তরফে। কিন্তু কুমারস্বামী রাজভবনে পৌঁছনোর আগেই জানা যায় যে, ইয়েদুরাপ্পা সেখানে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন। সরকার গড়ার দাবিও পেশ করেছেন।

বিজেপি একক বৃহত্তম দল হয়ে উঠেছে এ বারের নির্বাচনে। ইয়েদুরাপ্পা আগেভাগে রাজভবনে পৌঁছে সরকার গড়ার দাবিও পেশ করে দিয়েছেন। রাজ্যপাল সে ক্ষেত্রে ইয়েদুরাপ্পাকেই আগে সরকার গড়ার সুযোগ দিতে পারেন। তেমন হলে ফের অ্যাডভান্টেজ অবস্থানে পৌঁছে যাবে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য সংখ্যা জোগাড়ের খেলায় নেমে পড়বেন ইয়েড্ডি। পরবর্তী কয়েক দিনে তাই আরও অনেক নাটক দেখার অপেক্ষায় থাকছে কর্নাটক। কোন পথে এগোয় দক্ষিণী রাজ্য? চোখ থাকছে গোটা দেশেরও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE