সংসদের পথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: এএফপি।
প্রত্যাশা ছিল, সংস্কারের গোল লক্ষ্য করে আছড়ে পড়বে একের পর এক গোলার মতো শট। অরুণ জেটলির বাজেট কিন্তু সে ভাবে গ্যালারির মন ভরাতে পারল না। হয়তো যথেষ্ট সাহস ও অভিজ্ঞতার অভাবেই মাঝমাঠে আটকে রইলেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী।
এটা ঠিক যে, অনেক বাধা নিয়েই মাঠে নামতে হয়েছিল জেটলিকে।
পর পর দু’বছর ৫ শতাংশের নীচে আর্থিক বৃদ্ধির হার; মাত্রাছাড়া মূল্যবৃদ্ধি; মন্দার বাজারে নতুন কর বসিয়ে আয় বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় কমানোর তেমন সুযোগ না থাকা এত সব সমস্যা নিয়েই বাজেটের অঙ্ক কষতে বসেছিলেন তিনি। চ্যালেঞ্জ ছিল, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানোর দিশা দিতে হবে। রাজকোষ ঘাটতি বেঁধে রাখতে হবে। লাগাম পরাতে হবে মূল্যবৃদ্ধিকে।
এই অবস্থায় শিল্পমহল ও লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করেছেন জেটলি। বিমা ও প্রতিরক্ষায় বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। শিল্পোৎপাদন ও পরিকাঠামোয় জোর দিয়েছেন। এই দুই ক্ষেত্রে অসুখই এত দিন অর্থনীতির গতি কমিয়ে রেখেছিল। জেটলির উদ্যোগ তাই সাধুবাদ কুড়িয়েছে। ভোডাফোনের মতো পুরনো ব্যবসায়িক লেনদেনে কর বসানো (অর্থাৎ রেট্রোস্পেকটিভ ট্যাক্স) নিয়ে শিল্পমহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ওই ব্যবস্থা তুলে না-দিলেও জেটলি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা কম।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্প মহলের যে সব ছোটখাটো দাবিদাওয়া ছিল, ১২৭ মিনিটের দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় তার প্রায় সবই মিটিয়ে দিতে চেয়েছেন জেটলি। শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে শহরের সুযোগসুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া; সব চাষের জমিতে সেচের জল; ১০০টি নতুন শহর; সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা; তরুণদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মতো যে সব প্রতিশ্রুতি মোদী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে দিয়েছিলেন, সেগুলি বাজেটে নিয়ে এসেছেন তিনি। বাজেট পেশের পরে জানিয়েছেন, “বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাজেট তৈরি হয়েছে।”
জেটলির দাবি, তাঁর সিদ্ধান্তে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে বৃদ্ধির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু কী ভাবে তা হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিশা মেলেনি। খামতি রয়ে গিয়েছে সংস্কারের সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও। দু’টি কাজ করতে পারতেন অর্থমন্ত্রী। আয় বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণে বড় মাপের লক্ষ্য নিতে পারতেন। অন্য দিকে ব্যয় কমাতে জ্বালানি, খাদ্য ও সারে ভর্তুকির বহর এক কোপে কমিয়ে দেওয়ার কথা বলতে পারতেন। বন্ধ করে দিতে পারতেন মনমোহন সরকারের নানা খয়রাতি প্রকল্প। কিন্তু এর কোনওটাই করেননি জেটলি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অরবিন্দ পানাগাড়িয়ার মত ছিল, বিলগ্নিকরণ থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকা তোলার লক্ষ্য নিক মোদী সরকার। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অন্তর্বর্তী বাজেটে চিদম্বরমই এই খাতে প্রায় ৫২ হাজার টাকা কোটি টাকা আয়ের কথা বলে গিয়েছিলেন। জেটলি আর খুব বেশি এগোননি।
পাশাপাশি ভর্তুকির বহর কমেনি, উল্টে বেড়েছে। গত আর্থিক বছরে ছিল ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে তা বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। জ্বালানিতে ভর্তুকি কমলেও খাদ্য ও সারে ভর্তুকি বেড়েছে। একশো দিনের কাজের মতো খয়রাতি প্রকল্পের অভিমুখ বদলে তাকে আরও কার্যকর করার কথা বললেও, কী ভাবে সেটা করা হবে, তার কোনও বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি জেটলি।
প্রশ্ন উঠেছে, সংস্কারের পথে কেন আরও সাহসী হতে পারল না নরেন্দ্র মোদী সরকার?
রাজনীতি ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, এর জন্য দায়ী অভিজ্ঞতার অভাব। বিজেপি নেতৃত্ব এক দশক পরে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছেন। সব কিছু বুঝতে একটু সময় লাগবেই। জেটলি নিজেই আজ বলেছেন, সরকার গড়ার ৪৫ দিনের মধ্যে বাজেট পেশটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। সেই হিসেবে একে ভাল বাজেট বলেই আখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অশোক দেশাই। তাঁর মতে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাতে দক্ষ আমলাদের জড়ো করতে পেরেছিলেন। কেন্দ্রে এখনও তা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া, শুরুতেই সংস্কার করতে গিয়ে সরকার জনবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চায়নি। সামনে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার মতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে তাকে।
সংসদে হাজির অরুণ জেটলির স্ত্রী ও মেয়ে। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই
অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেটে ঘোষণা করেছেন, খরচ কমানোর দিশা দিতে খুব শীঘ্রই একটি ‘এক্সপেন্ডিচার ম্যানেজমেন্ট কমিশন’ তৈরি হবে। পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই তার রিপোর্ট চলে আসবে। সেই রিপোর্ট মেনেই ভর্তুকি ও খরচ ছাঁটাইয়ের পথে এগোনো হবে। ডিজেলের দাম প্রতি মাসে ৫০ পয়সা করেই বাড়ানো হবে। বছর শেষে ভর্তুকি শূন্যে পৌঁছে গেলে ডিজেলের দামও পেট্রোলের মতো নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদদের অনেকে অবশ্য বলছেন, সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার হলে এক বারেই নিয়ে ফেলতে হয়। যত দিন যায়, সরকারের হাত-পা আরও বাঁধা পড়ে যায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তব রূপায়ণেও সমস্যা হয়। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বাজেটের পরে বলেছেন, “সংসদে যথেষ্ট শক্তি থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হবে না।” ভর্তুকি নিয়ে তাঁর দাবি, শুধু গরিবদের জন্যই খাদ্য ও তেলে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকবে।
তবে অর্থমন্ত্রীর এই দাবি নিয়ে সংশয় থাকছে। যেমন সংশয় থাকছে কর বাবদ আয় ও রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও। অন্তর্বর্তী বাজেটে চিদম্বরম রাজকোষ ঘাটতি ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখার কথা বলেছিলেন। জেটলি বলেছেন, যথেষ্ট কঠিন হলেও তিনি এই চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। একই সঙ্গে আগামী বছর ঘাটতিকে ৩.৬ শতাংশ ও ২০১৬-’১৭-এ ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছেন তিনি। কিন্তু আয় বাড়াতে না-পারলে এবং ব্যয় না-কমালে কী ভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। মূল্যায়ন সংস্থা মুডি’জ-এর বিশ্লেষক অতসী শেঠের মন্তব্য, “অর্থমন্ত্রী ঘাটতি কমানোর শপথ নিয়েছেন। কিন্তু কী ভাবে সেটা করবেন, তার দিশা মেলেনি।”
মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় জর্জরিত মধ্যবিত্তকে সুরাহা দিতে জেটলি আয়করে ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাতে করদাতাদের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকবে। কিন্তু রাজকোষের ২২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে। অন্য দিকে, পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সিগারেট, চুরুট, পানমশলা, গুটখায় আরও কর চাপিয়ে এবং পরিষেবা করের পরিধি কিছুটা বাড়িয়েও মাত্র ৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকার বাড়তি আয়ের পথ খুলতেপেরেছেন। যার অর্থ, ১৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। আয়বৃদ্ধির আর একটি পথ, পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) এখনও রাজনৈতিক জটিলতায় আটকে। যদিও জেটলির আশা, চলতি আর্থিক বছরের মধ্যে আদর্শ না হোক একটা ভাল জিএসটি ব্যবস্থা তিনি চালু করতে পারবেন।
যদিও তা নিয়েও নানা মহলের সংশয় রয়েছে। সংশয় রয়েছে কর বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও। কারণ, আর্থিক বৃদ্ধির হার খুব বেশি হচ্ছে না। রাজস্ব সচিব শক্তিকান্ত দাসের অবশ্য দাবি, “আমরা আত্মবিশ্বাসী, এই লক্ষ্যে খুব সহজেই পৌঁছনো যাবে।”
গত কয়েক বছরে সঞ্চয়ের হার কমতে কমতে ২০১২-’১৩য় জিডিপি-র প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় ছাড়ের পরিমাণ বাড়ানো ছাড়া সেই দিকে আর কোনও পদক্ষেপের দেখা মেলেনি। আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে মূলত দেশি ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ এবং যৌথ উদ্যোগের উপর ভরসা রেখেছেন জেটলি। পরিকল্পনা খাতে সরকারি ব্যয় বেশি বাড়াননি। ফলে নতুন পরিকাঠামো কী ভাবে তৈরি হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। রেল ও সড়কের অভিজ্ঞতা বলছে, এই ধরনের পরিকাঠামোয় বেসরকারি লগ্নি আসে না। বাজেটে জেটলির দাবি, পরিকল্পনা খাতে তিনি গত অর্থবর্ষের তুলনায় ২৬.৯ শতাংশ বেশি বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু আসলে গত বাজেটে ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার ৩২২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন চিদম্বরম। জেটলি তার থেকে সামান্য বাড়িয়ে ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু চিদম্বরম যে হেতু কড়া হাতে পরিকল্পনা খাতে খরচ কমিয়ে মাত্র ৪ লক্ষ ৫৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছিলেন, তাই জেটলির বরাদ্দ অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে।
বাজেট বক্তৃতার শুরুতে প্রত্যাশা জাগিয়ে জেটলি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি কঠিন চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে। আমরা কি অর্থনীতিকে আরও বেলাইন হতে দেব আর অসহায় ভাবে তাকিয়ে দেখব? সিদ্ধান্ত নিতে না পারার জন্য ভবিষ্যৎকে সমস্যায় ফেলব? আমরা কি জনমোহিনী রাজনীতির শিকার হয়ে বাজে খরচ করতে থাকব?” কিন্তু বাজেট বক্তৃতা যত এগিয়েছে, ততই যেন আটকে গিয়েছেন জেটলি। বাজেটের পরে এক শিল্পপতির মন্তব্য, “চিদম্বরমের কাছে যদি ২৮২ জন সাংসদ থাকতেন এবং তাঁকে শরিকদের উপর ভরসা করতে না হতো, তা হলে হয়তো এই বাজেটই পেশ করতেন। তবে জেটলি তাঁর বাজেটে আগামী কয়েক বছরে কী করতে চান, তারও একটা আভাস দিতে চেয়েছেন। এখনই আশা না-ছেড়ে তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy