এ বার বারামুলা! আজ সকালেই ‘‘ভারত যুদ্ধবাজ নয়,’’ বলে বিশ্বকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সকালের সেই শান্তিবার্তার জবাব এল রাতে!
মনে করা হচ্ছিল সুতো যেটুকু ছাড়ার দরকার ছিল, উরির জবাবে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মাধ্যমেই তা করা হয়েছে। ফলে ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণরেখা ও সীমান্তে উত্তেজনার লাটাই এ বার কিছুটা গোটানো দরকার। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর জন্মদিবসের সকালে বার্তা দিয়েছিলেন, ‘‘আমাদের দেশ কখনও অন্যের ভূখণ্ডের জন্য লালায়িত নয়। আমরা কখনওই কোনও দেশকে আক্রমণ করিনি।’’
স্বাভাবিক ভাবেই, এমন একটি আপৎকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য গুঞ্জন ও কৌতূহল তৈরি করে বিভিন্ন মহলে। প্রশ্ন ওঠে উগ্র জাতীয়তাবাদকে মূলধন করে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার যখন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে যেতে চাইছে, সেই সময়েই প্রধানমন্ত্রীর এই সাদা পায়রার ওড়ানোর কারণ কী? রাতে বারামুলায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা যে প্রশ্নকে আরও জোরালো করে তুলল।
রাজনীতির লোকজন মনে করছেন, এটা পুরোপুরি সুপরিকল্পিত। এমন নয় যে, সীমান্তে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা অদূর-ভবিষ্যতে জঙ্গি অভিযান নিয়ে প্রস্তুতিতে কোনও রকম ঢিলে দিচ্ছে সাউথ ব্লক। প্রতিরক্ষাগত সতর্কতাকে উচ্চগ্রামেই রাখা হয়েছে। গুজরাত উপকূলে এ দিনও ৯ পাকিস্তানিকে ধরা হয়েছে নৌকা ধাওয়া করে। বারামুলায় জঙ্গি হানার জবাব দিতেও কসুর করেনি ভারতীয় বাহিনী। পাশাপাশি ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর সাফল্য প্রচারও চালানো হচ্ছে আরএসএস-কে দিয়ে। উত্তরপ্রদেশের ভোট ময়দানে জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টাতেও খামতি নেই।
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদী, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি-সহ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব, এমনকী, সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগও এই মুহূর্তে একমত যে, সামরিক ভাবে যেটুকু করা দরকার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে গিয়ে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর বিষয়ে যথেষ্ট প্রচার করা হয়েছে, যা সচরাচর করা হয় না। তাতে কয়েক রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে লাভবানই হয়েছে শাসক শিবির। কিন্তু ঘরোয়া রাজনীতিতে ফায়দা তোলার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক স্তরে ভারসাম্য রাখারও দায় রয়েছে ভারতের।
প্রথম কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে তার চাপ ভারতকেও সইতে হবে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজে উত্তেজনার পারদ কিছুটা নামিয়ে আনতে চাইছেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলকে এই বার্তা দিতে চাইছেন যে, ভারত এমন কিছু করতে চাইছে না, যাতে দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতি মুখ থুবড়ে পরে। আর এই বার্তাটি দেওয়ার জন্যই তিনি আজ বেছে নেন প্রবাসী ভারতীয় মঞ্চকে। প্রবাসী ভারতীয় কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোদী বুঝিয়ে দেন, ভারত কখনওই অন্যের ভূখণ্ডের দখল চায়নি। এখনও তা চায় না। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের দেশ অন্যান্য দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধে দেড় লাখেরও বেশি ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছেন। সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে বিশ্বে এই আত্মত্যাগের বিষয়টি প্রচার করতে পারিনি আমরা।’’
দ্বিতীয় কারণ আন্তর্জাতিক সমর্থন। ভারত-পাক উভয়েই পরমাণু শক্তিধর। দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে গোটা বিশ্বেই তা উদ্বেগের বিষয়। নয়াদিল্লি জানে যে, একতরফা ভাবে পরিমিতি লঙ্ঘন করা হলে আজ যারা সমর্থন করছে, তারাই বেঁকে বসতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে, যা আদৌ কাম্য নয়। সে কারণেও ভারত যে ঐতিহাসিক ভাবেই দায়িত্বশীল ও শান্তিকামী দেশ, সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন মোদী।
তৃতীয়ত, আঞ্চলিক কূটনীতি। ‘সন্ত্রাসের আঁতুড়’ পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ক্ষেত্রে কাজে আসছে ভারতের সংযত ও দৃঢ় ভাবমূর্তি। কূটনৈতিক প্রশ্নে এখনও বিভিন্ন দেশকে পাশে নিয়েই চলছে দিল্লি। সার্কের চেয়ার-দেশ নেপালও আজ ঘোষণা করেছে,
ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন তারা বয়কট করছে। অর্থাৎ ৭টিই এক অবস্থান নেওয়ায় এই জোটে পাকিস্তান এখন পুরোপুরি একঘরে। উরির কড়া নিন্দা করে বিবৃতিতে কাঠমান্ডু জানায়, ‘সার্কের দেশগুলি নিশ্চিত করুক, জঙ্গিরা যেন তাদের জমি আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করতে না পারে।’ এ পর্যন্ত সফল এই আঞ্চলিক কূটনীতি ভেস্তে দিতে চাইছেন না মোদী।
চতুর্থ কারণ, প্রত্যাঘাত এড়ানো। প্রতিরক্ষামন্ত্রী কালই হুঁশিয়ারি দেন, ভারতকে প্রত্যাঘাত করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। দেশের ‘মানবিক’ ভাবমূর্তিটি তুলে ধরে মোদীও আজ বোঝাতে চাইলেন, পাকিস্তান প্রত্যাঘাত করলে, বিশ্ব ভারতেরই পাশে দাঁড়াবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের বিদেশ মন্ত্রক মানবতাকে সামনে রেখে কাজ করছে। বিশ্বের কোনও দেশের নাগরিক আটকে পড়লে, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সম্প্রতি ৮০টি দেশ এই কারণে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ইয়েমেনই হোক বা ইরাক, নিজেদের নাগরিকদের শুধু নয়, ভারত এই সব দেশের মানুষকেও নিরাপদে উদ্ধার করেছে।’’
এতে অবশ্য কাশ্মীরে জঙ্গি তাণ্ডব, সামরিক ঘাঁটিতে হামলার মতো ঘটনা থামছে না। উরি, পঠানকোটের পরে, প্রমাণ মিলল বারমুলায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy