উৎসব। জয়ের পর বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা। অমদাবাদে সোমবার। ছবি: পিটিআই।
নরেন্দ্র মোদীর জন্যই গুজরাত হারাতে বসেছিল বিজেপি। সেই নরেন্দ্র মোদীর জন্যই শেষ পর্যন্ত গুজরাত ধরে রাখতে সক্ষম হল তারা।
গুজরাত থেকে হাসি নিয়ে ফিরতে পারলেন না রাহুল গাঁধী। কিন্তু অক্সিজেন নিয়ে ফিরলেন অবশ্যই। বিজেপি-র অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগামটা যে টেনে ধরা সম্ভব, সেই বিশ্বাস তাঁকে উপহার দিল এই গুজরাতই।
২০১৪ সালে গুজরাত ছেড়ে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন মোদী। সেই ধাক্কা যে একেবারেই সামলাতে পারেনি রাজ্য বিজেপি, ভোটের ময়দানে তা খুব টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মোদীই। বললেন, ‘‘হুঁ মোদী ছে, আ মাটি মারো মা ছে’’ (আমি হলাম মোদী, এই মাটি হল আমার মা)। শুধুমাত্র সেই মোদী ম্যাজিকে সওয়ার হয়েই জয় পেল বিজেপি, কিন্তু কান ঘেঁষে। গত ২২ বছরে এই প্রথম বার ১০০-র নীচে নেমে গেল বিজেপি-র আসনসংখ্যা।
ভোট শেষে দিল্লি ফিরে গিয়েছেন মোদী। কিন্তু গুজরাতে বিজেপির ভবিষ্যৎ এখন সরু সুতোর উপর ঝুলছে। মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ নির্বাচনে হারলেন রাহুল গাঁধী। তিনি কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর যে দু’টো রাজ্যের নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হল, সেই দুই রাজ্যেই কংগ্রেসকে হারের মুখ দেখতে হল। এই প্রথম অবশ্য রাহুল হারের মুখ দেখলেন না। এর আগেও যে সব রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি-র সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি টক্করে নিজের দলের প্রচারাভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাহুল গাঁধী, সেই সব রাজ্যেই কংগ্রেসের হার হয়েছে। গুজরাত সেই তালিকায় একটি নতুন নাম হিসেবে জুড়ল। কিন্তু গুজরাত রাহুল গাঁধীকে শুধুমাত্র আরও একটা পরাজয় উপহার দিল, এমনটা নয়। গুজরাত রাহুল গাঁধীকে আশার আলোও দেখাল। এবং গোটা দেশ দেখল এক নতুন রাহুলের জন্ম। ‘পাপ্পু’ তকমা ঝেড়ে ফেলে এক পরিণত নেতার সৃষ্টি হল এই গুজরাতের ধুলোতেই।
দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বৃত্তে না থাকা কংগ্রেস গুজরাতে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে, গুজরাতের ১৮২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে মাত্র ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস বিজেপির চেয়ে এগিয়ে ছিল। সে হিসেব যদি ছেড়েও দেওয়া হয়, তা হলেও ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটের হিসেব অনুযায়ী কংগ্রেসের আসন ছিল ৬১। এ বারের ভোটে ৮০টি আসন দখল করে নেওয়া তাই মোটেই মুখের কথা নয়। রাহুল গাঁধীর জন্য গুজরাতের এই ফল তাই ইতিবাচকই।
ঢালাও উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি, গোটা দেশে বিজেপি-র সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজ্য, সে রাজ্যের বিজেপি নেতাই দেশের প্রধানমন্ত্রী, সে রাজ্যের বিজেপি নেতাই দেশের শাসক দলের সভাপতি। এ হেন গুজরাতে বিজেপি-কে এত কষ্টে জিততে হল কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বিজেপি নেতারা একান্তে জানাচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদীর অনুপস্থিতিই কাল হয়েছে গুজরাত বিজেপির। রাজনীতিক মোদীর অনুপস্থিতিতে গুজরাতে প্রশাসনের উপর দলের নিয়ন্ত্রণ অনেক শিথিল হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মোদীর অনুপস্থিতিতে প্রশাসনও অনেক শিথিল হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নানা স্তরের বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্য। দুর্বল রাজ্য নেতৃত্ব কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি পরিস্থিতি।
হার্দিক পটেলের নেতৃত্বে শুরু হওয়া পাটিদার বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারা কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতারই অন্যতম বড় উদাহরণ। পাটিদারদের পথে নামতে দেখে উৎসাহিত হয়েছিল অন্যান্য সম্প্রদায়ও। ফলে অল্পেশ ঠাকোরের মতো ওবিসি নেতা বা জিগ্নেশ মেবাণীর মতো দলিত নেতাও নিজের নিজের সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া নিয়ে জোরকদমে আসরে নেমে পড়েছিলেন। গুজরাতের রাজনৈতিক ময়দানে তীব্র শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন।
সমস্যা আরও ছিল। গ্রামীণ গুজরাতে পর্যাপ্ত উন্নয়নের অভাব, অনেক গ্রামেই এখনও বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা না থাকা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দের প্রশ্নে সরকারের অনীহা, মজুরির অত্যন্ত নিম্ন হার, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না থাকা, বেশ কিছু কৃষিজ পণ্যের দাম পড়তে থাকা, কৃষকের জন্য ফসলের উপযুক্ত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থা না থাকা— এই সব নানান অভিযোগ গুজরাতের গ্রামাঞ্চলে বিজেপি-কে সমস্যায় ফেলেছে এ বারের নির্বাচনে। জিএসটি এবং নোটবন্দির মতো ইস্যুও কোথাও কোথাও প্রভাব ফেলেছে।
গুজরাত নির্বাচন ২০১৭: বিশ্লেষণ
রাহুল গাঁধীর সবচেয়ে বড় সাফল্য হল এই ক্ষোভকে বিজেপি-র বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারা, হার্দিক-অল্পেশ-জিগ্নেশকে এক ছাতার তলায় আনা, চিরাচরিত আদিবাসী ও মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রাখা। এই সমীকরণে ভর করেই জোরদার লড়াইটা দিলেন রাহুল।
আরও পড়ুন: হার ধুমলের, বিজেপি-র হিমাচলে মুখ্যমন্ত্রী পদে ভাসছে অনেক নাম
২২ বছরের একটা সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগই যে দানা বাঁধবে, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব তা আঁচ করেছিল। হার্দিকরা যে সমস্যা বাড়িয়ে তুলবেন, তা-ও গেরুয়া শিবিরের অজানা ছিল না। বিজেপি-র রাজ্য পর্যায়ের এক নেতা জানালেন, ‘‘দু’মাস আগেই আরএসএস-এর তরফ থেকে বিজেপিকে জানানো হয়েছিল যে, বিধানসভা নির্বাচনে ঘোর সঙ্কটের মুখ দেখতে হতে পারে। জনমত যে দিকে যাচ্ছে, তাতে ৮৫টার বেশি আসন পাবে না বিজেপি।’’ সঙ্ঘের সতর্কবার্তাকে একটুও অবজ্ঞা করেননি মোদী। গত কয়েক মাস ধরেই নানা কর্মসূচিতে গুজরাত যাওয়া-আসা বাড়িয়ে তুলেছিলেন তিনি। আর নির্বাচন ঘোষণা হতেই দলের ভার পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। রাজ্য জুড়ে ঝোড়ো প্রচার চালিয়ে, কংগ্রেস বিরোধী সুরকে ধাপে ধাপে তুঙ্গে তুলে, মণিশঙ্কর বা নিজামিদের মন্তব্যকে তাঁর অপমান তথা গুজরাতের অপমান হিসেবে ব্যাখ্যা করে, তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান ষড়যন্ত্র করছে বলে দাবি করে গুজরাতের নির্বাচনী হাওয়া ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মোদী। সে চেষ্টায় যে তিনি সফলও হয়েছেন, তার প্রমাণ মিলল ভোটের ফলাফলেই।
আরও পড়ুন: গাঁধীর গুজরাতই আজ গেরুয়া ভারতের রাজধানী
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভার্গব পারিখ বললেন, ‘‘২০১২ সালে যা ভোট পড়েছিল, এ বার তার চেয়ে সাড়ে তিন শতাংশ ভোট কম পড়েছে। এই সাড়ে তিন শতাংশ ভোটার হলেন তাঁরাই, যাঁরা বিজেপি-র বিরুদ্ধে, কিন্তু মোদীর পক্ষে। নরেন্দ্র মোদী তীব্র স্বরে কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে শুরু করায় এঁরা আর ভোটই দেননি। ভোট যদি দিতেন, তা হলে এঁরা কংগ্রেসকেই দিতেন। সে ক্ষেত্রে ফল কিন্তু অন্য রকম হয়ে যেত।’’
সংখ্যা যা-ই হোক, জয় বিজেপি-রই। টানা ষষ্ঠ বারের জন্য গুজরাতের মসনদ বিজেপি-র দখলে। আসন বাড়া-কমার প্রসঙ্গ এড়িয়ে বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘‘যো জিতা, ওয়হি সিকন্দর।’’ অমদাবাদ, গাঁধীনগর, বডোদরা, সুরত, রাজকোট— নানা প্রান্তে শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের উৎসব। বিকেল থেকেই অমদাবাদ শহরের আকাশে ঝলসে উঠতে শুরু করেছে আতসবাজি, শোনা যাচ্ছে শব্দবাজির একটানা গর্জন।
গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা ফের এক বার জয়ের আনন্দে উৎসবে মাতবেন, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নেতারা দেওয়ালের লিখনটা পড়তে পারলেন তো?
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy