সবে শুরু। এখনও আছে সময়। সাংবাদিক বৈঠকে জেটলি। ছবি: পিটিআই
লড়াইটা যেন নরেন্দ্র মোদী বনাম নরেন্দ্র মোদী।
বিপুল প্রত্যাশা জাগিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন মোদী। তাঁর রাজত্বের প্রথম একশো দিনের সাফল্যের খতিয়ান মাপতে গিয়ে সেই প্রত্যাশার সঙ্গেই তুলনা চলছে। লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোদীর থেকে প্রত্যাশা বনাম মোদীর থেকে পাওনা।
এই লড়াইয়ে আজ মোদী সরকারের হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর সরকারের সব থেকে বড় সাফল্য হিসেবে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিতকেই তুলে ধরেছেন তিনি। জেটলির যুক্তি, কারখানার উৎপাদনের রেখচিত্র উপরের দিকে। পরিষেবা ক্ষেত্রের উন্নতি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির হার আস্তে আস্তে কমছে। এপ্রিল থেকে জুন, এই তিন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশ ছুঁয়েছে। যা গত আড়াই বছরে সব থেকে বেশি। অর্থনীতিতে লগ্নিকারীদের আস্থা ফিরেছে। জেটলি বলেন, “যে সব পদক্ষেপ আমরা করছি, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আগামী দিনে আরও বেশি করে দেখা যাবে।”
মনমোহন-সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম একশো দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। নরেন্দ্র মোদী তেমন কিছু করেননি। কিন্তু ২ সেপ্টেম্বর মোদী সরকারের একশো দিন পূর্ণ হওয়ার আগে সরকার কী করে দেখাল, তা জানানোর চাপ তৈরি হয়েছে। মোদী গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সাংবাদিক সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আজ জেটলি তার সূচনা করেছেন। যে হেতু কোনও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কথা ছিল না, তাই অর্থ মন্ত্রকের কাজের খতিয়ান দিতে গেলেও কোথাও একশো দিনের প্রসঙ্গ টানেননি তিনি। কিন্তু সেই খতিয়ানেও কী কী হয়েছে, তার সঙ্গে না হওয়ার কথাও বলতে হয়েছে জেটলিকে।
অর্থমন্ত্রীর দাবি, লোকসভা ভোটে মোদীর জিতে আসাটাই অর্থনীতিকে ঘিরে হতাশার পরিবেশ অনেকটা কাটাতে পেরেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো গিয়েছে। প্রতিরক্ষা ও রেলে বিদেশি লগ্নির পথ আরও প্রশস্ত করা হয়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণে গতি এসেছে। কর সংক্রান্ত বিবাদ মেটাতে বিশেষ ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যের প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নেও খরচ তেমন কিছু কমানো হয়নি।
আর না পাওয়া? সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, মোদী সরকার খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে রেহাই দেবে। মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে এই মূল্যবৃদ্ধিকে বিজেপি হাতিয়ার করেছিল। আজ জেটলি নিজেই বলেছেন, অনেকখানি লাগাম পড়ানো গেলেও মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আজও জেটলিকে অল্প বৃষ্টি, এই মরসুমে দাম বাড়ার প্রবণতার দোহাই দিতে হয়েছে। তবে দ্বিতীয়টি যে মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ, সে কথা অন্যরাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাতে সরকারের দায়িত্ব কমে না বলেই মনে করছে বিরোধীরা। এমনকী, মরসুমি মূল্যবৃদ্ধি সামলাতে হোর্ডিং ঠেকানোর যে আইন কেন্দ্র করেছে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। অনেক রাজ্যই বলছে, আইনে মজুতদারদের বিরুদ্ধে জামিন যোগ্য ধারা দেওয়ায় পরিস্থিতি আগে যা ছিল, তা-ই রয়েছে। বেআইনি মজুতের অভিযোগে কাউকে ধরলেও সে সহজেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আবার মূল্যবৃদ্ধি না কমায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এখনও সুদের হার কমায়নি। জেটলি অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, খাদ্যশস্য পর্যাপ্ত পরিমাণেই মজুত রয়েছে। অনাবৃষ্টিতেও কোনও সমস্যা হবে না। আর নিত্যপণ্যের দাম যে কিছুটা হলেও কমেছে, তা মানছেন অনেকেই।
সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রেলভাড়া বাড়িয়েছে মোদী সরকার। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও সদানন্দ গৌড়া রেলকে বাঁচাতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে ধীরে ধীরে সুফলও মিলছে। অন্য কয়েকটি ক্ষেত্র, যেমন বিমা বিল পাশ বা পণ্য পরিষেবা কর চালু, এগুলিতে এখনও পিছিয়ে রয়েছে সরকার। জেটলি আজ নিজেই এ কথা মেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তাঁরা চেষ্টা করছেন। আশা করছেন, আগামী অধিবেশনেই বিমা বিল পাশ করানো যাবে। সে ক্ষেত্রে আরও লগ্নি আসবে। পণ্য-পরিষেবা কর চালু করতে রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই অর্থ কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জেটলি বলেছেন, বছরের শেষে ডিজেলের দাম সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু ভর্তুকির বহর এক ঝটকায় কমানোর সাহস দেখানো যায়নি। তার জন্য জেটলি এখনও বিমল জালানের নেতৃত্বে তৈরি ব্যয় সঙ্কোচ কমিশনের সুপারিশের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। বিলগ্নিকরণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। তবে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি হয়েছে। তাতে রয়েছে এনটিপিসি, ওএনজিসি-র মতো কয়েকটি সংস্থা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই এই কাজ শুরু হবে।
এপ্রিল থেকে জুন মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫.৭ শতাংশে পৌঁছনোর তথ্যকে সামনে রেখেই আজ জেটলি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, অর্থনীতির হাল শোধরাচ্ছে। কিন্তু তাতে মোদী সরকারের কতখানি কৃতিত্ব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জেটলির পূর্বসূরি প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম দাবি করেছেন, অর্থনীতির হাল ফেরাতে মনমোহন জমানার শেষ পর্বে কারখানার উৎপাদন বাড়াতে শুল্ক ছাড়, বিদ্যুৎ ও খনি ক্ষেত্রে যে সব পদক্ষেপ করা হয়েছিল, তার জন্যই বৃদ্ধির হার বেড়েছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, এপ্রিল থেকে জুন, এই তিন মাসে ২৬ মে পর্যন্ত মনমোহন সরকারই ক্ষমতায় ছিল। চিদম্বরমের যুক্তি, “আমরা তো বলেইছিলাম, অর্থনীতির অধোগতি আটকানো গিয়েছে। এ বছরের শুরুতে তা ঘুরে দাঁড়াবে। সেটাই হয়েছে। আমরা তাই এর কৃতিত্ব দাবি করতেই পারি। আমি খুশি যে অর্থ মন্ত্রক মেনে নিয়েছে যে এটাই আশা করা হয়েছিল।”
চিদম্বরমের এই দাবি শুনে জেটলির কটাক্ষ, “এখন ফল ভাল হয়েছে বলে যে কোনও ভারতীয়ই তাতে খুশি হতে পারেন!” কিন্তু সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও অভিযোগ তুলেছেন, “নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অর্থনীতির বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। বৃদ্ধির হার বা লগ্নির পরিমাণ বাড়ার মতো জেটলি যে সব যুক্তি দিচ্ছেন, তা আর্থিক সমীক্ষাতেই বলা হয়েছিল। যে আর্থিক সমীক্ষা আদতে মনমোহন জমানারই পর্যালোচনা। জেটলি যে বাজেট পেশ করেছিলেন, তা র্কাযত চিদম্বরমের অন্তর্বর্তী বাজেটেরই প্রতিলিপি।”
একই সঙ্গে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সুদিন আসছে’ বলে যে প্রচার ভোটের সময় চালিয়েছিল বিজেপি, তা কোথায়? স্মার্ট সিটি.বা বুলেট ট্রেনই বা কত দূরে? পাঁচ বছরে এ সব আদৌ সম্ভব হবে তো? জবাবে বিজেপি নেতারা বলছেন, একশো দিনে এত কিছু সম্ভব নয়। কিন্তু জন-ধন প্রকল্প শুরু করে মোদী অন্তত বুঝিয়ে দিয়েছেন, উন্নয়নে ধনী-গরিব সকলকে যোগ করতে চান তিনি। সুতরাং সুদিন আসবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy