দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে একের পর এক কামরা। চলছে উদ্ধারের চেষ্টা। পুখরায়াঁয় রয়টার্সের ছবি।
ফের কানপুর!
হাঁটু-ধুলো আর সবুজে ঘেরা ছোট্ট আধা শহর-আধা গ্রাম পুখরায়াঁ। কানপুর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। রবিবার ভোররাতে এই পুখরায়াঁর লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার মুহূর্তে দু্র্ঘটনার কবলে পড়ে ১৯৩২১ ইনদওর-পটনা রাজেন্দ্রনগর এক্সপ্রেস। দু্র্ঘটনায় লাইনচ্যুত হয়ে যায় জেনারেল, স্লিপার ও এসি কামরার ১৪টি বগি। সরকারি ভাবে মৃতের সংখ্যা ১২১ জন। বেসরকারি মতে সংখ্যাটি দেড়শো ছাড়িয়ে গিয়েছে। আহত দু’শোর কাছাকাছি। এ দিন ট্রেনে ছিলেন প্রায় ১২০০ যাত্রী। ফলে জখমের সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
দুর্ঘটনার তীব্রতা এতটাই ছিল যে, এস-টু কামরাটি মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। রবিবার রাত পর্যন্ত ওই কামরা থেকে যাত্রীদের দেহ উদ্ধার রয়েছে। ইঞ্জিন ও গার্ডের কামরার অবশ্য কোনও ক্ষতি হয়নি।
ঘড়িতে তখন ৩.১০। আর ঘণ্টা দেড়েক পরেই পটনা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল ট্রেনটির। যাত্রীরা জানিয়েছেন, প্রচণ্ড গতিতে চলছিল ট্রেন। সকলেই ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ। প্রথমে লাইন থেকে ছিটকে যায় এস-১ কামরাটি। পেছন থেকে অন্য কামরাগুলো তীব্র গতিতে পরপর ধাক্কা মারতে থাকে একে অপরকে। ঘুমের মধ্যেই মারা যান শতাধিক। ২০১১ সালে এই কানপুরের কাছে ফতেহপুরে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল কালকা এক্সপ্রেস। সে বার মারা গিয়েছিলেন ৭০ জন।
রাতেই কানপুর থেকে ঘটনাস্থলে ৯০ জন সেনা, সেনাবাহিনীর চার জন চিকিৎসক, ২০ জন প্যারামেডিক এবং দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়। কানপুরের সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। কানপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে জখমদের।
দুর্ঘটনার প্রায় পনেরো ঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রুখতে রেলের আমলাদের অবিলম্বে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। টুইট করে দুর্ঘটনাগ্রস্তদের সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি। নিয়মিত টুইট করে ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাচ্ছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ছোট মাপের একাধিক রেল দু্র্ঘটনা ঘটলেও, আজকের এই দুর্ঘটনায় রীতিমতো অস্বস্তিতে রেল মন্ত্রক-সহ বিজেপি নেতৃত্ব। বিশেষ করে সামনে যখন উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন! দুর্ঘটনার পরেই ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করার হিড়িক পড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর তহবিল থেকে মৃতদের পরিবারের জন্য দু’লক্ষ, গুরুতর আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা এবং অল্প আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন। রেল মন্ত্রক মৃতদের পরিবারকে সাড়ে তিন লক্ষ করে দেবে। এখন পর্যন্ত ন’জন মৃতকে বিহারের বাসিন্দা হিসেবে শনাক্ত করা গিয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁদের পরিবার-পিছু দু’লক্ষ করে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানও তাঁর রাজ্যের দুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীদের জন্য একই ক্ষতিপূরণ ঘোযণা করেছেন। সবাইকে টেক্কা দিয়ে মৃতদের পরিবারের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী! অখিলেশের নির্দেশে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্থানীয় সমাজবাদী নেতৃত্ব। কিছুটা দেরিতে হলেও, ত্রাণের রাজনীতিতে নেমে পড়েছে সঙ্ঘ পরিবারও।
কী কারণে এত বড় মাপের দুর্ঘটনা? উত্তর-মধ্য রেলের জেনারেল ম্যানেজার অরুণ সাক্সেনা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে রেল-সুরক্ষা কমিশনারকে। লাইনের অবস্থা কেমন তা বুঝতে, কানপুর-ঝাঁসি রুটের পুরো লাইনের ভিডিও তোলা হয়েছে। তদন্তকারীরা প্রাথমিক ভাবে দুর্ঘটনার কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ চিহ্নিত করেছেন।
লাইনে ফাটল: রেলের একাংশ মনে করছে, রেল লাইনে চিড় থাকায় এই দুর্ঘটনা। শীতের শুরুতেই সাধারণত লাইনে সঙ্কোচন হয়। যা লাইনে চিড় ধরিয়ে দিতে পারে। বহু ক্ষেত্রেই এই সূক্ষ্ম চিড় দুর্ঘটনার কারণ হয়। পাঁচ বছর আগে কালকা মেলে দুর্ঘটনার পিছনেও ছিল লাইনে চিড়। রেল মন্ত্রকের একটি বড় অংশ মনে করছে, কালকার মতো এখানেও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি হয়েছে। শীতের শুরুতে লাইন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মমাফিক পরীক্ষা করা হয়। রেল লাইনের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষাও হয়। এই লাইনে তা করা হয়েছে কি না, এখনও জানা যায়নি।
কেন ভাঙে রেল লাইন? রেলকর্তাদের ব্যাখ্যা, এই সময় আবহাওয়ার তাপমাত্রা একটু বেশি ওঠানামা করে। শীতের শুরুতে সকালের থেকে রাতের দিকে তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে অনেকটা করে। রেল লাইনের ইস্পাতে তাপমাত্রার পরিবর্তনে প্রতিক্রিয়া হয়। তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে রেলের ইস্পাতের মধ্যেও সঙ্কোচন ও প্রসারণ হয়। লাইনের মধ্যে কোনও ভাবে বাতাসের বুদবুদ থেকে গেলে ভাঙন ধরে সেখান থেকেই। এ বার তার উপর দিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন গেলে সেই ফাটল থেকে লাইন ভেঙে আলাদা হয়ে যায়।
অনেক সময় লাইনের সঙ্কোচন-প্রসারণের ফলে ফিশপ্লেটের সঙ্গে থাকা নাটবোল্ট কেটে গিয়েও লাইনের জোড় আলগা হয়ে যায়। ওই সময় লাইন খোলা অবস্থায় তার উপর দিয়ে দ্রুতগতির ট্রেন গেলে তাতে লাইনের গেজ (দু’টি লাইনের মধ্যবর্তী দূরত্ব) বেড়ে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে তা হতে পারে।
পুলিশকে চালক জানিয়েছেন, তাঁর ধারণা, লাইনে ফাটল থাকাতেই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। চালকের ব্যাখ্যা, প্রথমে তিনি প্রচণ্ড জোরে একটি শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তারপরেই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এতেই তাঁর মনে হয়েছে, লাইনে ফাটল ছিল। তার উপর দিয়ে ট্রেন যেতেই সশব্দে লাইনটি ভেঙে যায়। আর তারপরেই ছিটকে পড়ে কামরাগুলো।
চাকা: ট্রেনের শুরুর দিকের একটি চাকাতে সমস্যা রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ওই অভিযোগ এনেছেন ট্রেনেরই এক যাত্রী— মধ্যপ্রদেশের মদসৌর জেলার বাসিন্দা প্রকাশ শর্মা। ওই ট্রেনের এস-২ কামরাতেই ইনদওর থেকে উজ্জয়িনী যাচ্ছিলেন তিনি। বহুবার ওই ট্রেনে যাতায়াত করার সুবাদে তাঁর মনে হয়েছিল, চাকার যে ধরনের আওয়াজ হওয়া উচিত তা হচ্ছে না। কোথাও গণ্ডগোল রয়েছে। টিকিট চেকার এবং পরে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন কর্তৃপক্ষকেও তিনি এ কথা জানান। কিন্তু প্রকাশের অভিযোগ, তার কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। উল্টে হেসে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনায় যে কামরাগুলো সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এস-২ কামরা। দুর্ঘটনার পর যে ভাবে ট্রেনের বগিগুলো দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে, চাকা ও ব্রেক শু-আলাদা হয়ে এ-দিক ও-দিক ছিটকে পড়েছে, তাতে প্রকাশের পর্যবেক্ষণ ঠিক ছিল কি না, তা এখন জানা অসম্ভব বলেই মনে করছে রেল।
গতি: ইনদওর-ঝাঁসি এক্সপ্রেসের মতো দূরপাল্লার ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটারের কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, চালক গাড়ি ছোটাচ্ছিলেন একশোরও বেশি গতিবেগে। এক রেলকর্তার দাবি, দু্র্ঘটনার সময়ে ট্রেনটির গতি ছিল ১১০-১২০ কিলোমিটার। প্রতিটি ট্রেনে গার্ডের কামরায় একটি যন্ত্রে ট্রেনের সর্বশেষ গতি কত তা রেকর্ড হতে থাকে। ওই রেলকর্তার দাবি, তিনি সেই রেকর্ডের ভিত্তিতে ওই দাবি করেছেন। যদিও তদন্তের স্বার্থে এখন গার্ডের কামরাটিকে সিল করে দিয়েছে রেল।
চালক: প্রশ্নের মুখে চালকের ভূমিকাও। এক্সপ্রেস ট্রেন চালানোর মতো শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতিতে তিনি ছিলেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কামরা: দুর্ঘটনার ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিয়েছে ট্রেনের কামরা। এখন অধিকাংশ রাজধানী বা শতাব্দীতে যে কামরা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো এলএইচবি (লিঙ্ক হফম্যান বুশ) ধাঁচের। জার্মান প্রযুক্তিতে বানানো ওই কামরাগুলো লাইনচ্যুত হলে একটি আরেকটির পিছনে ঢুকে যাওয়ার পরিবর্তে ঘাড়ের উপর চড়ে যায়। এতে প্রাণহানি কম হয়। কিন্তু ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেসের মতো কম গুরুত্বহীন ট্রেনে এখনও মান্ধাতার আমলের টেলিস্কোপিক কামরা ব্যবহার করা হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে যে কামরাগুলো একে অপরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ফলে প্রাণহানি বাড়ে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
সহ প্রতিবেদন: অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy