এন সি দেববর্মা এবং সুনীল দেওধর।— ফাইল চিত্র।
নতুন মুখ্যমন্ত্রীর নাম এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা হয়নি, চূড়ান্ত হয়নি শপথগ্রহণের দিনক্ষণ। ফল ঘোষণার পরে এখনও ৪৮ ঘণ্টাও কাটেনি। তার মধ্যেই নতুন করে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলল বিজেপির নির্বাচনী সহযোগী ইন্ডিজেনাস পিপল’স ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (আইপিএফটি)।
তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে অবিলম্বে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করতে হবে। সব দিক খতিয়ে দেখে সেই কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। সোমবার আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আইপিএফটি-র সভাপতি নরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা সোজাসুজিই এই দাবির কথা জানালেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, ত্রিপুরা বিধানসভার নির্বাচনী প্রচার পর্বে বিজেপি আগাগোড়া বলে গিয়েছে, তারা রাজ্য ভাগের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ থেকে শুরু করে দলীয় নেতৃত্ব প্রচারে কখনও উপজাতীয়দের এই দাবিকে মান্যতা দেননি।
বিদায়ী শাসক দল সিপিএম বরাবরই অভিযোগ করে এসেছে, বিজেপি রাজ্যভাগে মদত দিচ্ছে। আইপিএফটি-র মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে জোট করে তারা রাজ্য ভাগের চক্রান্ত করছে। এর ফলে বাঙালিদের সঙ্গে জনজাতির বিরোধ বাঁধবে।
যে দাবি আইপিএফটি এখন তুলছে, সেই দাবি তারা প্রচার চলাকালীন তোলেনি কেন? নরেন্দ্র চন্দ্র (এন সি) দেববর্মা বলছেন, ‘‘নির্বাচনের আগে এ ব্যাপারে কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। জোটের শর্ত মেনেই এই দাবি প্রচারে তোলা হয়নি।’’ পাশাপাশি, তাঁর বক্তব্য, ‘‘২০০৯ থেকে আমরা দাবি তুলি, সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী এখানে স্বশাসিত জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও জনজাতি তাদের আর্থ-সামাজিক, সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি থেকে এখনও ৯০ শতাংশ বঞ্চিত থেকে গিয়েছে। সে জন্যই তাদের হাতে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা অর্পণের প্রয়োজন। তা করতে গেলে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্পণ করতে হবে। এই অর্পণ তখনই সম্ভব যখন পূর্ণাঙ্গ এক ভৌগোলিক এলাকাতে ওই জনসমষ্টির জন্য পূর্ণাঙ্গ একটা রাজ্য করে দেওয়া হয়।’’ এন সি দেববর্মার সাফ কথা: ‘‘ষষ্ঠ তফসিল এলাকার থেকে উন্নীত করে ‘টিপ্রাল্যান্ড’ হোক— এই দাবি আমরা করছি।’’
আরও পড়ুন, শক্ত ঘাঁটি উপজাতীয় এলাকাও দূরে ঠেলল সিপিএমকে
তাঁরা যে এ রকম একটা দাবি তুলছেন তা কি বিজেপি নেতৃত্বের আগে থেকে জানা ছিল? তাঁরা কি এই দাবির সঙ্গে সহমত হয়েছেন? এন সি দেববর্মার দাবি, এ কথা তাঁরাও জানতেন। যদিও ত্রিপুরার ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সুনীল দেওধর এ দিনই আনন্দবাজারের কাছে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘‘উনি যদি আলাদা রাজ্যের দাবি করেন করবেন। কিন্তু আমাদের যে পরিকল্পনা আছে, যে ইচ্ছা আছে তা হল ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’। আমরা এই দাবির সঙ্গে সহমত নই।’’ তবে, এরই পাশাপাশি সুনীল বলেন, ‘‘আমি এটা খতিয়ে দেখব যে আলাদা রাজ্য চাওয়ার কারণটা কী? আসলে, সিপিএম ২৫ বছর ধরে এখানে ছিল। তারা জনজাতিকে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রেখেছিল। আমরা জনজাতিদের সম্মান রক্ষা করব।’’
কিন্তু এটা কি ভোটারদের বিভ্রান্ত করা নয়? যেখানে বিজেপি বরাবরই বলে এসেছে ‘ওয়ান ত্রিপুরা’। প্রচারেও তো তারা এবং আইপিএফটি এমন কিছু বলেনি? আগরতলা শহরের কর্নেল চৌমোহনীর কাছে নিজের বাড়িতে বসে এন সি দেববর্মা বললেন, ‘‘এই দাবি নির্বাচনোত্তর নয়। হঠাৎ করেও আমরা এই দাবি তুলিনি। ২০০৯ সাল থেকেই লাগাতার এই দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছি।’’
আইপিএফটি প্রধান অবশ্য অকপটেই বলেছেন, নির্বাচনের আগে সোচ্চারে পৃথক রাজ্যের দাবি না তোলাটা একটা ‘স্ট্র্যাটেজি’ ছিল। তা হলে এ বার কী হবে? এত দিন বামফ্রন্ট দাবি করে এসেছে, ত্রিপুরায় বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক আছে। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। টাকারজলা সংরক্ষিত কেন্দ্রে এ বার সিপিএম প্রার্থীর থেকে ১২ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী এন সি দেববর্মা বলছেন, ‘‘বাঙালি-উপজাতি আগে যেমন পাশাপাশি ছিল, এখনও তেমনই থাকবে। এর সঙ্গে আলাদা রাজ্য গঠনের কোনও সম্পর্ক নেই। এ সব কথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বলা হচ্ছে।’’
আরও পড়ুন, বামের ধস, রামের উত্থান, কেন এত চমকে দিল ত্রিপুরা
এই নির্বাচনে ন’টি আসনে প্রার্থী দিয়ে আটটিতেই জয়লাভ করেছে আইপিএফটি। রাজ্যের উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত যে ১৯টি আসনে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে বিজেপি-আইপিএফটি জোট জয়ী হয়েছে ১৭টিতেই। এ ছাড়া পশ্চিম ত্রিপুরার চড়িলাম (সংরক্ষিত) আসনের সিপিএম প্রার্থী রমেন্দ্র নারায়ণ দেববর্মার মৃত্যু হওয়ায় ওই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়ে গিয়েছে। এই সাফল্যের জন্যই সুর আরও একটু চড়িয়ে এন সি দেববর্মা দাবি করেছেন, জনজাতিদের মধ্য থেকেই মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে।
২৫ বছরের সরকারকে গদিচ্যুত করে সদ্য ক্ষমতায় আসা জোটের এক সঙ্গীর এ হেন সুর মধুচন্দ্রিমার তাল কেটে দেবে না তো? এই আশঙ্কা কিন্তু এখন দানা বাঁধছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy