বুথের কালি এ বার ব্যাঙ্কের কাউন্টারে।
এক জন যাতে একাধিক বার ভোট দিতে না পারেন, তার জন্য হাতের আঙুলে কালির দাগ দেওয়া হয়। এখন ব্যাঙ্ক থেকে একাধিক বার নোট বদলানো রুখতে তা ব্যবহার করবে কেন্দ্র। তবে ঘোষণার পর থেকেই এই ব্যবস্থা নিয়ে একগুচ্ছ সংশয় দানা বেঁধেছে আমজনতার মনে।
মঙ্গলবার অর্থ বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাসের দাবি, ওই কালি হাতে লাগালে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট পাল্টাতে একই জনের একাধিক বার লাইনে দাঁড়ানো বন্ধ হবে। কমবে মানুষের হয়রানি। তা ছাড়া অভিযোগ উঠছে যে, নোট বদলে নিয়ে আসতে টাকার বিনিময়ে কিছু জনকে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন কালো টাকার মালিকরা। তা এতে বন্ধ হবে। তবে শুধু নোট বদলেই আঙুলে কালি লাগানো হবে। অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিলে বা টাকা তুললে তা করা হবে না।
বাতিল হওয়া পুরনো নোট বদলে নিতে বা জমা দিতে হবে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে। ব্যাঙ্ক ও এটিএম মিলিয়ে ফি সপ্তাহে আপাতত তোলা যাচ্ছে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। এ ছাড়া বলা হয়েছিল, ৪,৫০০ টাকার পর্যন্ত পুরনো নোট নতুন নোটে বদলে নেওয়া যাবে। কত বারে তা শুরুতে স্পষ্ট করা হয়নি।
কিছু ব্যাঙ্ক এ দিন বলেছে, ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে নোট বদলানো যাবে একবারই। গ্রাহকদের অভিযোগ, সে ক্ষেত্রে বিষয়টি গোড়া থেকেই খোলসা করা উচিত ছিল।
এ ছাড়াও অনেকের প্রশ্ন, নিজে এক বার নোট বদলে নেওয়ার পরে কি তা হলে অন্য কারও জন্য আর সেটি করতে দেবে না কেন্দ্র? সে ক্ষেত্রে বাড়িতে অশক্ত, অসুস্থ বা বৃদ্ধ কারও নোট বদলানোর প্রয়োজন থাকলে, তার কী হবে?
যদি এই মুহূর্তে কেউ বাইরে গিয়ে থাকেন, তাঁরই বা নোট পাল্টানোর উপায় কী? শুধু তা-ই নয়, কেউ যদি ইতিমধ্যে কিছু টাকা (ধরা যাক ২,০০০) নতুন নোটে বদলে নিয়ে এসে থাকেন, তাহলে কি তিনি বাকি টাকার জন্য (২,৫০০) আর তা করতে পারবেন না?
সরাসরি এ দিন এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কেন্দ্র দেয়নি। শক্তিকান্তবাবু শুধু জানিয়েছেন যে, আঙুলে কালি লাগানোর পদ্ধতি কী হবে, ব্যাঙ্ক-কে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
সামনেই পশ্চিমবঙ্গের দু’টি বিধানসভা ও একটি লোকসভা আসনে উপ-নির্বাচন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, তার পরে কোনটি ভোটের আর কোনটি ব্যাঙ্কের কালি, তা বোঝা যাবে কী ভাবে? কারণ, নির্বাচন কমিশন কর্নাটকের মাইসোর পেন্টস বার্নিশ লিমিটেডের যে কালি ব্যবহার করে, সেই একই কালি ব্যবহার করতে চলেছে ব্যাঙ্কও।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের ব্যাখ্যা, ভোটের মেশিনের দিকে পা বাড়ানোর আগে বাঁ হাতের তর্জনীতে কালি লাগানো হবে। আর ব্যাঙ্ক কালি লাগাবে ডান হাতের আঙুলে।
কেন কালি লাগানোর এই সিদ্ধান্ত, সে প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রকজানিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে একই লোক বারবার বিভিন্ন ব্যাঙ্কে কিংবা একই ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখা থেকে পুরনো নোট বদলে নিয়ে আসছেন। তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রে ওই পথে টাকা সাদা করতে কিছু লোককে নিয়োগ করছেন কালো টাকার মালিকরা। মন্ত্রকের দাবি, ভোটের কালি আঙুলে পড়লে সেই জারিজুরি বন্ধ হবে।
তাদের দাবি, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ পুরনো নোট বদলাতে বারবার ব্যাঙ্কে যাচ্ছেন না। তার প্রয়োজনও নেই। সাধারণ বুদ্ধি বলে, বাড়িতে পড়ে থাকা সমস্ত পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট তাঁরা একবারে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবেন। অ্যাকাউন্টে তা জমা করবেন। এবং ৪,৫০০ টাকার পর্যন্ত পুরনো নোটও তাঁরা একবারেই নতুন নোটে বদলে নেবেন। কাজেই যাঁরা নিয়ম মেনে কাজ করছেন, তাঁদের অসুবিধা হবে না বলেই অর্থ মন্ত্রকের দাবি। অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ ভিরমানির দাবি, ‘‘এতে কালো টাকার কারবারিদের একটা পথ বন্ধ হবে। যদি না তাঁরা ব্যাঙ্কের অফিসারদের সঙ্গে আঁতাত করে ফেলেন।’’
আঙুলে কালি লাগানো নিয়ে মোদী সরকারকে বিঁধেছে বিরোধী দলগুলি। মমতা বলেছেন, ‘‘এই কালা কৌশলে ওদের মুখেই কালি পড়বে।’’ কংগ্রেসের অভিযোগ, এতে ভোগান্তি বাড়বে। অনেকের অ্যাকাউন্ট নেই। তাঁরা বাড়িতে নগদে টাকা রাখেন। এখন আঙুলে কালি লাগিয়ে এক বারের বেশি পুরনো নোটও না বদলাতে দিলে, সংসার চালানো দায় হবে। কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বুঝছেন না যে, খেটে খাওয়া মানুষরা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। ওঁর উচিত চশমা পাল্টানো।’’ অনেকের প্রশ্ন, ভোটের সময় কালি আবছা করার নানা পদ্ধতির দেখা মেলে। এখানেও যে তেমন হবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? আশঙ্কা, এ সব নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্তাদের ঝামেলা বাঁধতে পারে।
শক্তিকান্তবাবুর অবশ্য দাবি, আঙুলে কালি লাগানোর প্রস্তাব আগেও ছিল। গতকালের বৈঠকে বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বোঝা যায় যে, ব্যাঙ্কের সামনে দীর্ঘ লাইনের অন্যতম কারণ, একই লোকের বার বার দাঁড়ানো। অনেক ক্ষেত্রে কালো টাকার মালিকরাই তাঁদের পাঠাচ্ছেন বলে সন্দেহ। আঙুলে কালি লাগালে এই সিন্ডিকেটকে আটকানো যাবে।
দিল্লি দরবারের অনেকে বলছেন, সরকার কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে, এ কথা তুলে ধরেই সাধারণ মানুষকে পাশে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আহ্বান জানাচ্ছেন নিজেদের অসুবিধা সত্ত্বেও পাশে থাকতে। সেখানে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো আমজনতা যদি দেখেন যে, কালো টাকা সাদা করাতে কিছু লোক নোট পাল্টানোর জন্য অন্যের হয়ে বারবার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, তবে ক্ষোভ বাড়বে। তা ছাড়া, একই লোকের বার বার লাইনে দাঁড়ানো রুখলে, ভিড় কমবে। কিছুটা হলেও কমবে হয়রানি।
কালো টাকার ক্ষেত্রে যাতে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হয়, তার জন্য জন-ধন অ্যাকাউন্টগুলির উপরও নজর রাখছে কেন্দ্র। ৮ নভেম্বর নোট তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে ওই ধরনের কিছু অ্যাকাউন্টে যে লেনদেন হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে, তা আগেও বলেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সরকারের সন্দেহ, কিছু গরিব মানুষকে টাকা দিয়ে তাঁদের অ্যাকাউন্টে কালো টাকা ঢোকানো হচ্ছে। পরে তা তুলে নেওয়া হবে। আর কিছু টাকা ওই গরিব মানুষকে দেওয়া হবে অ্যাকাউন্ট ও পরিচয়পত্র ব্যবহার করতে দেওয়ার ‘ভাড়া’ হিসেবে। এ দিন শক্তিকান্তবাবু বলেন, কোথায় অস্বাভাবিক টাকা জমা পড়ছে, সে দিকে নজর রয়েছে। তাঁর আর্জি, কেউ যেন অ্যাকাউন্টের অপব্যবহার করতে না দেন।
নগদের জোগান বাড়াতে ধর্মস্থানগুলিকে প্রণামীর খুচরো টাকাও জমা দিতে বলেছে কেন্দ্র। যুক্তি, প্রণামী বাক্সে কম অঙ্কের নোটে অনেক টাকা জমা পড়ে। তা ব্যাঙ্কে এলে, খুচরো দেওয়া সহজ হবে।
কালো খুঁজতে
• পুরনো নোট বদলাতে ব্যাঙ্কে গেলেই আঙুলে কালি
• কালি দেওয়া হবে ডান হাতের আঙুলে
• অর্থসচিব বলেন, কালির নিয়ম ব্যাঙ্ককে জানানো হবে
• ব্যাঙ্কের বক্তব্য, টাকা বদলানো যাবে এক বারই
• আপাতত পুরনো নোট বদলানোর সর্বোচ্চ সীমা ৪৫০০
বাকি সব টাকা জমা দিতে হবে অ্যাকাউন্টে
• অ্যাকাউন্টে টাকা জমা বা টাকা তোলার জন্য কালি নয়
• পরিবারের অন্য কারও পুরনো নোট পাল্টাতে গেলে কী হবে, জবাব মেলেনি
• দুই বা তার বেশি বারে মোট সাড়ে চার হাজার টাকা তুলতে চাইলে কী হবে, জবাব নেই তারও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy