কিছুতেই যেন ২০১২-র ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়। খুব সতর্ক ছিলেন রাহুল গাঁধী।
গুজরাতে ‘নবসর্জন যাত্রা’র সূচনা করেছেন মাস ছয়েক আগে। হার্দিক পটেল এবং অল্পেশ ঠাকোরের মতো দুই ঘোর পরস্পর বিরোধী নেতাকে এক ছাতার তলায় এনেছেন। জিগ্নেশ মেবাণীকে নবসর্জনে সামিল করেছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে রোজ একটু একটু করে চড়িয়েছেন সুর। কিন্তু একটাও অসতর্ক মন্তব্য করেননি।
২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গুজরাতে পা রেখে নরেন্দ্র মোদীকে ‘মওত কা সওদাগর’ বলেছিলেন সনিয়া গাঁধী। তার ফল কী হয়েছিল, কংগ্রেস তা ভোলেনি। সনিয়ার ওই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে লহমায় হাওয়া ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মোদী। মোদীকে অপমান করে আসলে গুজরাতকে অপমান করেছেন সনিয়া— গোটা গুজরাতে এমন এক ধারণা চারিয়ে দিতে বেশ সক্ষম হয়েছিলেন।
এ বার কিন্তু তেমন কোনও অস্ত্র মোদীকে হাতে পেতে দেননি রাহুল। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা করে দিলেন মণিশঙ্কর আইয়ার। নরেন্দ্র মোদীকে ‘নীচ’ বলে সম্বোধন করলেন তিনি। আর প্রথম দফার নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার মুহূর্তে সেই মন্তব্যকে লুফে নিলেন দেশের ‘গুজরাতি প্রধানমন্ত্রী’।
মণিশঙ্করের মতো এক নেতার মন্তব্যে যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন মোদী, যে ভাবে ফুঁসে উঠছে তাঁর দল, তাতে মনে হচ্ছে, ২০১৭-র বিধানসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে ২০১২-র মতোই কোনও ইস্যু খুঁজছিলেন মোদীরা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা গাঁধী পরিবার ঘনিষ্ঠ আইয়ার সে ইস্যুকে মোদীর হাতে তুলে দিয়েছেন ঠিকই। তবে মোদী কিন্তু শুধু মণিশঙ্করের ২০১৭-র মন্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকছেন না।
আরও পড়ুন
• গুজরাতের মসনদে এখনও মোদীর পাদুকাই
• গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিনি ২০১৫ সালের একটি মন্তব্যকেও টেনে এনেছেন শুক্রবার। পাকিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশনে বসে মণিশঙ্কর বলেছিলেন, ‘মোদীকে রাস্তা থেকে সরাতে হবে’— শুক্রবার বনাসকাঁঠার এক জনসভায় এমনই অভিযোগ করেছেন মোদী। ‘‘পাকিস্তানে গিয়ে মণিশঙ্কর আইয়ার বলে এসেছেন, মোদীকে রাস্তা থেকে সরান, তার পর দেখুন ভারত-পাকিস্তান শান্তি কোন পথে গড়ায়। আমাকে রাস্তা থেকে সরানোর কথা বলে তিনি কী বলতে চেয়েছেন? আমার অপরাধটাই বা কী? মানুষের আশীর্বাদ আমার সঙ্গে রয়েছে, এটাই আমার অপরাধ?’’ বনাসকাঁঠার সভা থেকে এ দিন এ ভাবেই হুঙ্কার ছেড়েছেন মোদী। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান বিদ্বেষ, গুজরাতি অস্মিতা— সব কিছু মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন এক বিন্দুতে। সফলও কিন্তু হয়েছেন কিছুটা। পাটিদার, ওবিসি, দলিত, জিএসটি, নোটবন্দি, বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্য— এই সমস্ত আলোচনা কিন্তু হঠাৎই পিছনের সারিতে। গুজরাতের প্রায় সর্বত্র এখন মণিশঙ্কর আইয়ারের মন্তব্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
পরিস্থিতি যে এমনটা হয়ে উঠতে পারে, তা রাহুল গাঁধী আগেই আঁচ করেছিলেন। তাই বৃহস্পতিবার নরেন্দ্র মোদী বিতর্কিত মন্তব্যটি তুলে ধরে গুজরাতি অস্মিতা প্ররোচিত করার চেষ্টা শুরু করতেই মণিশঙ্কর আইয়ারকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। তবে যতখানি ক্ষতি মণিশঙ্করের মন্তব্যে হয়েছে, তা মেরামত করার জন্য এই পদক্ষেপ যে যথেষ্ট নয়, সেও রাহুল জানেন। তাই দীর্ঘ দিনের কংগ্রেসি দুর্গ ছোটা উদয়পুর জেলায় সভা করতে গিয়ে শুক্রবার রাহুল নিজেই মণিশঙ্কর প্রসঙ্গ টানলেন। তিনি বললেন, ‘‘কংগ্রেস ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটাকে সম্মান করে। তাই প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কেউ অপশব্দ ব্যবহার করলে, কংগ্রেস তাঁকে সমর্থন করবে না। … এই কারণেই আমরা মণিশঙ্করজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করেছি।’’ নরেন্দ্র মোদী নিজে বার বার খারাপ ভাষায় বিরোধীদের আক্রমণ করেন এবং অসৌজন্যমূলক ভাবে কংগ্রেসের নিন্দা করেন বলে রাহুল অভিযোগ করেন জনসভার মঞ্চ থেকে। কিন্তু মোদী সৌজন্য দেখান না বলে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীর পদকে অপমান করবে, এমনটা হতে পারে না— মন্তব্য রাহুলের।
মোদীর সভায় শুক্রবার।—নিজস্ব চিত্র।
ছ’মাস ধরে একটু একটু করে কংগ্রেসের পায়ের তলায় জমি ফেরাচ্ছিলেন রাহুল। নানা ভাবে রাহুলকে আক্রমণ করেছে বিজেপি। রাহুল তথা গাঁধী পরিবারের প্রতি মোদী এবং অমিত শাহদের অনেক আক্রমণই রাজনৈতিক সৌজন্যের বিপরীত মেরুতে। গুজরাতের কংগ্রেস নেতাদের দাবি অন্তত তেমনই। তবু মেজাজ হারাননি রাহুল। ২০১২-র পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেননি। তাঁর নিজের কোনও মন্তব্যকে মোদীর হাতিয়ার হয়ে উঠতে দেননি। কিন্তু শেষরক্ষা হল কি না, তা হলফ করে আর বলা যাচ্ছে না। শনিবার প্রথম দফার ভোট। দক্ষিণ গুজরাত, সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ, কাঠিয়াবাড় ভোটে যাচ্ছে। তার আগের ৪৮ ঘণ্টা জুড়ে গুজরাতে রাজনৈতিক আলোচনার ভরকেন্দ্র শুধুমাত্র ‘মোদীর অপমান।’
ক্ষতিটা কি সামলে নিতে পারবেন রাহুল গাঁধী? এ প্রশ্নের জবাব আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছাপ ফেলতে শুরু করবে ভোটযন্ত্রের বোতামে। কাউন্টডাউন শুরু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy