ছবি: শাটারস্টক ডট কম
ভারতীয় অর্থনীতি একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি অনুমান, চলতি আর্থিক বছরে বৃদ্ধির হার শেষ পর্যন্ত দাঁড়াবে ৬.৫ শতাংশে। গত চার বছরের হিসেবে সবচেয়ে কম। সরকার স্বভাবতই বিব্রত, চিন্তিত। বাজেটের আগে প্রধানমন্ত্রী চল্লিশ জনেরও বেশি অর্থনীতিবিদের সঙ্গে মুখোমুখি বসেছিলেন সমস্যাটা বুঝতে ও সমাধান-সূত্র খুঁজতে। যোজনা কমিশন ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অস্তিত্ব না থাকায়, বার্ষিক বাজেটের গুরুত্ব যে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি-হারের এতটা কমে যাওয়া সত্যিই খুব চিন্তার। কিন্তু সমস্যাটা বোধহয় আরও একটু গভীরে। অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ হলেই যে সাধারণ মানুষের হাতে কাজ আসবে, আয় বাড়বে- এমন গ্যারাণ্টি নেই। হতেও পারে, না-ও হতে পারে। বৃদ্ধির চরিত্র এখানে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। অর্থাৎ, বৃদ্ধি কোথায় হল, শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রে না উচ্চমার্গের উৎপাদনকে ঘিরে, সেটাই মূল প্রশ্ন। আর ঠিক এখানেই লুকিয়ে আছে আরও বড় একটা সমস্যা– যা হয়ত অনেকের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে ইপিডব্লিউ (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি)-তে এই উদ্বেগজনক জায়গাতেই আলোকপাত করেছেন ভিনোজ আব্রাহাম। দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার আগেও কমেছে, কিন্তু এ বার কর্মসংস্থানই কমছে।
হ্যাঁ, ভারতীয় অর্থনীতি গত কয়েক বছরে এমনই একটা দুর্ঘটনার সাক্ষী। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬, এই তিনটে আর্থিক বছরে দেশে কর্মসংস্থান তো বাড়েইনি, বরং তা কমে গিয়েছে ৫৩ লাখ! অভূতপূর্ব দুর্ঘটনাই বটে। এমনটা বোধহয় স্বাধীনতার পর আর কখনও ঘটেনি। নির্মাণশিল্প, শিল্পোৎপাদন, তথ্য-প্রযুক্তি, বিপিও এই সব ক্ষেত্র– যারা নাকি সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে, তাদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ!
দুঃখের বিষয় হল, এটা দুর্ঘটনা ঠিকই, কিন্তু হঠাৎ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। এর জমি তৈরি হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। আমরা হয়ত অবজ্ঞা করেছিলাম এই বাস্তবতাটাকেই। ‘তত্ত্ব’ আর ‘পরিকল্পনা’র চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে বড্ডই ব্যস্ত ছিলাম। কিংবা ভাবছিলাম, শেষ-সময়ে সরকার ঠিক সামলে নেবে, ২০১৯-এর নির্বাচনের আগেই। অথবা স্বচ্ছ-ভারত, গোরক্ষা, তিন-তালাক, নোটবন্দি, মেক ইন ইন্ডিয়া, মিনিমাম গভর্নমেন্ট বাট ম্যাক্সিমাম গভার্ন্যান্স, সবকা সাথ সবকা বিকাশ— ইত্যাদি ইত্যাদিতে ভুলে গিয়েছিলাম মানুষের আর্থিক ভাবে ভাল থাকার এই ন্যূনতম শর্তটাকে। কিন্তু কত দিন আর ভুলে থাকা যায়? কাজের অভাব, আর্থিক সচ্ছলতার অভাব, আত্মসম্মানের অভাব, এ সব কি আর দীর্ঘ দিন ধরে ভুলে থাকা সম্ভব!
তাই কর্মসংস্থান কেমন ভাবে, কোথায়, কতটা কমেছে, তা জানার ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৪-০৫, এই সময়ে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ২%। ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৯-১০ তা কমে হয়েছিল মাত্র ০.৭%। ২০১১-১২তে তা আরও কমে হল ০.৪%। তার পর তো এই বৃদ্ধিই আর রইল না। কাজ তো বাড়লই না, বরং কমে গেল! ‘সবকা সাথ/ সবকা বিকাশ’-এর এ এক রকম পরিহাসই বলা যায়।
কর্মসংস্থানের এই কমে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শহরের পুরুষ ও মহিলাদের। গ্রামের মহিলারাও নিস্তার পাননি। যদিও, গ্রামীণ পুরুষরা ক্ষুদ্র শিল্প ও পরিষেবা বিশেষত খুচরো ব্যবসা, ১০০ দিনের কাজ এবং কয়েকটা সরকারি ক্ষেত্র যেমন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক সুরক্ষা— এ সবের কল্যাণে খানিকটা পার পেয়ে গিয়েছেন। অবস্থাটা আরও একটু বুঝতে, একটু দীর্ঘ হলেও, নীচের সারণীটা দেখা দরকার।
এই ছবি ২০১৫-১৬ পর্যন্ত। এর পরই কিন্তু লাগু হয়েছে নোটবন্দি ও জিএসটি। মনে করা হচ্ছে, প্রায় সবাই মনে করছেন, এগুলোর প্রভাবে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভাবতে ভয় হচ্ছে। এখন তথ্যের জন্য অপেক্ষা।
উপরের সারণীটার দিকে তাকালে কতকগুলো অদ্ভুত তথ্য নজরে আসবে।
প্রথমত, শিল্পক্ষেত্রে বিপজ্জনক অবস্থা। বিপজ্জনক, কারণ এই সময়ে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বেড়েছে অনেকটাই। অথচ, কাজ কমে গিয়েছে। কাজ-বিহীন বৃদ্ধির সমস্যা, যা আধুনিক, পুঁজি-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার একটা অঙ্গ।
দ্বিতীয়ত, কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রগুলো থেকে উচ্ছিন্ন লক্ষ লক্ষ মানুষের শেষ ভরসা নির্মাণ-শিল্প। অথচ, সেখানেও হতাশা। ১০০ দিনের কাজের সুবাদে গ্রামে কিছু কাজ জুটলেও, শহরের অবস্থা খুবই খারাপ।
তৃতীয়ত, শহরের মধ্যবিত্তের কাজের একটা বড় সহায় তথ্য ও সম্প্রচার, বিপিও, বিমা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য— এই সব ক্ষেত্র। কিন্তু শহরে সেই সুযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছে। সম্ভবত সরকারি সহায়তার কারণেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিমা, সামাজিক সুরক্ষা এই সব ক্ষেত্রে গ্রামের অবস্থা কিছুটা ভাল হয়েছে।
চতুর্থত, বিপুলভাবে কমেছে কৃষির কর্মসংস্থান। কৃষি-সংকট কিংবা নগরায়ন-শিল্পায়ন-পরিকাঠামো বিস্তারের ঠেলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উচ্ছিন্ন কৃষক ও কৃষিশ্রমিকেরা অনেকটাই জড়ো হয়েছেন গ্রাম-শহরের খুচরো ব্যবসায়, পারিবারিক উৎপাদনে, শহরের গৃহ-পরিচারিকা হিসাবে কিংবা গ্রামীণ বিচিত্র পরিবহণ ব্যবস্থায় (টোটো, লাদেন, ভ্যানো এমন আরও কত কী)। কিন্তু এ সব তো চূড়ান্ত ভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্র। না আছে ঠিকঠাক আয়, কাজের সময় বা স্থিরতা বলেও কিছু নেই, না আছে কোনও রকম সুরক্ষা-কবচ।
সবচেয়ে বিপজ্জনক অথচ জ্বলন্ত তথ্যটা হল, শহরে প্রায় সবকটা ক্ষেত্রে কর্মসঙ্কোচন। গ্রাম থেকে লাখে লাখে মানুষ গিয়েছিলেন শহরে, ভাগ্যের খোঁজে। কাজও পেয়েছিলেন হয়ত কিছু– সরকারি/বেসরকারি, ছোট/বড়, সংগঠিত/অসংগঠিত, শিল্প/পরিষেবায়। তারা আরও একবার উচ্ছিন্ন হলেন। কাজ হারিয়ে তাই ভিড় করেছেন খুচরো ব্যবসায়, পারিবারিক ক্ষেত্রগুলোতে (গৃহ-শ্রম, গৃহ-পরিচারিকা, নাইট-গার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি), কিংবা দু’হাত অন্তর দোকান খুলেছেন- ‘রিপেয়ারিং শপ’। বেঁচে থাকতে খড়কুটো আঁকড়ে ধরা।
গ্রামের কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বেড়েছে (যার ৪০%-ই খুচরো ব্যবসায়, সরকারি ক্ষেত্রেও বেড়েছে কিছুটা), কিন্তু শহরে (খুচরো ব্যবসা ও রিপেয়ারিং ছাড়া) প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মসঙ্কোচন। এটা শুধুই একটা তথ্য নয়। মূলধারার তত্ত্বের প্রতি এক রকম পরিহাসও।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সব আর্থিক সমস্যারই সমাধান করতে পারে– শুধু সময়ের অপেক্ষা, এমন ধারণাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আর এই সম্প্রসারণকে সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যেতে দরকার বিপুল বিনিয়োগ– মূলত বেসরকারি। তাই, বেসরকারি সংস্থার উপর থেকে যতটা সম্ভব বাধা-নিষেধ সরিয়ে নেওয়া চাই। ‘মুক্ত বাজার ব্যবস্থায়’ বেসরকারি পুঁজি মুনাফার তাগিদে ক্রমাগত বিনিয়োগ করবে। সেখান থেকেই আসবে আর্থিক বৃদ্ধি আর তার সাথে কর্মসংস্থান, সাধারণের আয় বৃদ্ধি, বাজারের আরও বিস্তার ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাই মূলধারার একটা মূল কথা।
আমরা সেই পথেই তো হাঁটলাম বেশ কয়েকটা দশক। গ্রোথ এল ঠিকই। কিন্তু এ কেমন এগিয়ে চলা? কোনও স্থিরতা নেই, প্রায় কোনও নিশ্চয়তা নেই— আর সবচেয়ে বড় কথা, এই সম্প্রসারণের সাথে কাজের, আপামর জনগনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়ের, তেমন একটা সামঞ্জস্য নেই। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একটা অংশের লাভ হল ঠিকই, কিন্তু জনসংখ্যার সিংহ ভাগ তেমন কিছু পেলেন কই? অসাম্য তো বেড়েই চলল। আর মানুষের হাতে যদি ন্যূনতম কাজটুকুই না থাকে, তবে এই ‘প্রগতি’ কীসের জন্য?
এই দুঃসময়ে, অন্য রকম সম্প্রসারণ কি ভাবা যায়? অন্য রকম অর্থনীতির ভাবনা– যেখানে কর্মসংস্থান থাকবে সব হিসেবের কেন্দ্রে। একে ঘিরে থাকবে অর্থনীতির অন্য লক্ষ্যগুলো। তেমনই একটা চেষ্টা কি আমরা দেখব চলতি সরকারের শেষ পূর্ণ বাজেটে? অর্থনীতির অভিমুখ কি একটু ঘুরবে সাধারণ মানুষের দিকে? এ বার বাজেটে এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy