প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কালো টাকার কারবারিদের বিরুদ্ধে সত্যিই কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নোট বাতিলের জেরে ভুক্তভোগীরা। আর তার জবাব দিতেই এ বার সক্রিয় হল সরকার। অন্য লোকের জনধন অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করে নিজেদের কালো টাকা ঘুরপথে সাদা করার কৌশল নিয়েছিলেন যাঁরা, গত কালই তাঁদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পরেই আজ আয়কর বিভাগ জানিয়ে দিল, প্রাথমিক ভাবে দেশের একাধিক জনধন অ্যাকাউন্টে জমা পড়া প্রায় ১ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকার উপরে নজর পড়েছে তাদের।
নোট বাতিলের ঘোষণা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, গরিবদের স্বার্থেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত। গরিবরা কিছু দিন কষ্ট সহ্য করলে কালো টাকার কারবারিদের সাজা তো দেবেনই, ওই টাকা উদ্ধার করে গরিব-কল্যাণে তা খরচও করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণার সরাসরি ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। বহু শিল্পেই নাভিশ্বাস উঠেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। নগদের সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন গরিব, মধ্যবিত্ত। তবু মোদীর আশ্বাসে ভরসা রেখেই সব দুর্ভোগ কার্যত মুখ বুজে সহ্য করছেন আম জনতা। কিন্তু তার ফাঁকেই তুলছেন প্রশ্নটা— কালো টাকার কারবারিদের বিরুদ্ধে সত্যিই কি কিছু করছে সরকার? যদি করে থাকে, তা চোখে পড়ছে না কেন? নাকি দুর্ভোগই সার? কারণ তথাকথিত কালো টাকার কারবারিদের তো এটিএম বা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না!
সেই সমালোচনার জবাবটাই কার্যত দেওয়া শুরু হল। গরিব মানুষের জনধন অ্যাকাউন্ট বেআইনি ভাবে ব্যবহারকারীদের গত কাল মোদী হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেই আজ আয়কর বিভাগ জানিয়ে দিল, একাধিক জায়গায় জনধন অ্যাকাউন্টে রহস্যজনক লেনদেনের খোঁজ পেয়েছেন তাঁরা। তদন্তের প্রথম পর্বে আয়কর দফতরের খাতায় দেশের একাধিক জায়গার সঙ্গে নাম উঠেছে কলকাতা এবং মেদিনীপুরের!
শনিবার এক সভায় আম জনতার উদ্দেশে মোদী বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের জনধন অ্যাকাউন্টে যদি অন্য কেউ টাকা রেখে থাকেন, তা হলে তাঁদের সেই টাকা ফেরত দেবেন না।’’ প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন কথার নৈতিকতা নিয়ে ওঠা প্রশ্নের মধ্যেই আজ আয়কর দফতর জানিয়েছে, কলকাতা, মেদিনীপুরের পাশাপাশি বিহারের আরা, কেরলের কোচি এবং উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জনধন অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করে কালো টাকা সাদা করার কৌশল চোখে পড়েছে। বিহারের এমন একটি অ্যাকাউন্টেই জমা পড়েছে ৪০ লক্ষ!
আয়কর বিভাগের বক্তব্য, এই অ্যাকাউন্টগুলির মালিকরা কখনও রিটার্ন দাখিল করেননি। কেন না, তাঁদের রোজগার আয়করের আওতায় পড়ে না। কিন্তু নোট বাতিলের ঘোষণার পরে তাঁরা কী ভাবে এত টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করলেন, সে প্রশ্ন তাই উঠছেই। আয়কর দফতর এখন অ্যাকাউন্টগুলির আয়ের উৎস তদন্ত করে দেখবে। আয়কর আইন অনুযায়ী, ওই জমা টাকা যদি কালো বলে ধরা পড়ে, তা হলে তার উপরে কর তো দিতেই হবে। তদন্তে কী উঠে আসে, তা দেখে পরবর্তী শাস্তির কথাও ভাববে আয়কর দফতর।
শুধু জনধন অ্যাকাউন্ট নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্বেচ্ছা আয় ঘোষণা প্রকল্প’ নিয়েও একই সঙ্গে সক্রিয় হয়েছে আয়কর দফতর। চলতি বছর এই প্রকল্প ঘোষণা করে সরকার জানিয়েছিল, এই প্রকল্প মেনে কালো ও হিসেব বহির্ভূত টাকার কথা জানালে মোট ঘোষিত অর্থের ৪৫% শতাংশ কর, জরিমানা এবং সারচার্জ বাবদ কেটে নেবে সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই বাকি টাকা সাদা হয়ে যাবে। এ বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পে হিসেব বহির্ভূত টাকার কথা জানিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের অনেকের বক্তব্যে নানা অসঙ্গতি পেয়েছে আয়কর দফতর। এদের বিরুদ্ধে নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা।
আয়কর দফতরের বক্তব্য, ‘স্বেচ্ছা আয় ঘোষণা প্রকল্প’ মেনে দেশের ৭১ হাজার ৭২৬ জন তাঁদের কালো টাকা থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। এবং এই প্রকল্পে ৬৭ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে।
উদ্ধারের পরিমাণটা আরও অনেক বেশি হতেই পারত। কিন্তু দু’টি ঘোষণা আয়কর দফতরের কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে। একটিতে, মুম্বইয়ের একটি পরিবার ২ লক্ষ কোটি কালো টাকার কথা ঘোষণা করেছিল। অন্যটিতে আমদাবাদের এক ব্যবসায়ী তাঁর কাছে ১৩ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা থাকার কথা জানিয়েছিলেন। প্রাথমিক তদন্তের পরে দু’টি ঘোষণাকেই বাতিল করে দিয়েছে আয়কর দফতর। কী উদ্দেশ্যে তাঁরা ওই ঘোষণা করেছেন, তা এখন খতিয়ে দেখছে আয়কর দফতর।
আয়কর দফতর জানিয়েছে, এ বছর সেপ্টেম্বরে মুম্বইয়ের বান্দ্রার চার সদস্যের একটি পরিবার দু’লক্ষ কোটি কালো টাকা থাকার কথা ঘোষণা করে। আয়কর দফতর তদন্তে নেমে জানতে পারে, আব্দুল রেজ্জাক মহম্মদ সইদের পরিবারের তিন জনের প্যান কার্ড অজমের-এর। পরিবারটি এ বছরই সেপ্টেম্বরে অজমের থেকে মুম্বইয়ে চলে আসে এবং মুম্বই থেকেই তারা ওই কালো টাকার কথা সরকারি প্রকল্পে ঘোষণা করে। আয়কর দফতরের বক্তব্য, এই ঘোষণার পিছনে নির্দিষ্ট কোনও উদ্দেশ্য আছে। যাঁরা এই ঘোষণা করেছেন, তাঁদের কাজকর্ম নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আয়কর বিভাগের।
সন্দেহজনক দ্বিতীয় চরিত্রটি আমদাবাদের। ব্যবসায়ী মহেশ কুমার চম্পকলা শাহ তাঁর কাছে ১৩ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা থাকার কথা জানিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা নিয়েও আয়কর দফতর তদন্ত শুরু করে এবং অসঙ্গতি খুঁজে পায়। ওই ব্যবসায়ীকে ইতিমধ্যেই জেরা করেছে আয়কর বিভাগ। দফতর সূত্রের খবর, জেরায় মহেশ কুমার জানিয়েছেন, যে টাকার কথা তিনি ঘোষণা করেছেন, তা তাঁর নিজের নয়! এই টাকার প্রকৃত মালিক একাধিক রাজনীতিক, আমলা ও নির্মাণ ব্যবসায়ী! তাঁর এই স্বীকারোক্তি ঘিরে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। আগামিকাল মহেশ কুমারকে ফের জেরা করবেন আয়কর অফিসারেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy