মুম্বইয়ে কৃষকদের সমাবেশ। ছবি: এএফপি।
এ যেন বিশাল এক লাফ। লাঙল হাতে যাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার কথা, সেই কৃষকদের মিছিলে যেন ভেসে গেল বাণিজ্য নগরী মুম্বই। আন্দোলনেরর নতুন জমিতে কৃষকদের দেখে অনেকেই হয়তো বিস্মিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ আবার মন্তব্য ভাসিয়ে দিয়ে বলছেন— এ সব হচ্ছেটা কী?
কিন্তু, সাম্প্রতিক আতীতের ঘটনাপ্রবাহ বলে দিচ্ছে, ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলো তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। মহারাষ্ট্রে কৃষকদের আন্দোলন সেই আগুনেরই স্ফুলিঙ্গ মাত্র।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে দাবিগুলোকে সামনে রেখে সিপিএমের কৃষকসভা মহারাষ্ট্রের হাজার-হাজার মানুষকে এককাট্টা করে ফেলল, সেই দাবিগুলো কিন্তু নতুন নয়। বরং দীর্ঘ দিনের পুরনো। কৃষিঋণ মকুব, কৃষিপণ্যের ন্যায্য সহায়ক মূল্যের দাবি তুলে ২০১৬ সালেও কৃষকরা বিক্ষোভের ঝড় তুলেছিলেন দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। ২০১৭ সালে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর কৃষকরা জমায়েত হয়েছিলেন দিল্লিতে। সেই একই বছরে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে কৃষকরা রাস্তায় দুধ ঢেলে, ফসল ছড়িয়ে বিক্ষোভ দেখান। কিন্তু তাতেও ফল না হওয়ায় ‘বৃহত্তর আন্দোলন’ ছাড়া রাস্তা খোলা ছিল না বলে কৃষক নেতারা জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, সরকার আসে-যায়। কিন্তু, কৃষকদের কুঁড়ে ঘরে অন্ধকার কাটে না।
ভারতে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যে হেতু কৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাই কৃষির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করার জন্য অধ্যাপক স্বামীনাথনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশন ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে পাঁচ ধাপে রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে ভূমি সংস্কারের কথা যেমন বলা হয়েছিল। সে রকমই ছিল, কৃষিঋণে সুদের হার চার শতাংশ কমানোর কথা। বলা হয়েছিল, কৃষকদের আত্মহত্যা কমানোর জন্য বিমা চালু করতে হবে। এর পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু, সমস্যা থেকে গিয়েছে সেই তিমিরেই।
আরও পড়ুন, হাতে খাবার, জলের প্যাকেট, মুম্বইয়ে বিপুল অভ্যর্থনা কৃষকদের
ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, দেনার জালে জড়িয়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০১৪-২০১৭ সালের মধ্যে দেশে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেছেন গড়ে ১২ হাজার কৃষক। কৃষক আত্মহত্যায় মহারাষ্ট্রের স্থান উপরের দিকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মহারাষ্ট্রে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২৪১৪।
আরও পড়ুন: রক্তাক্ত পায়ের ভারতের পাশে ইন্ডিয়া
বিশেষজ্ঞদের মতে, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা সব সময় ভয়ঙ্কর। ক্ষমতায় আশার পর কৃষকদের আরও বেশি করে ফসল ফলানোর কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, কথা মতো কাজ করেও মহারাষ্ট্রের কৃষকদের ন্যায্য দাম মেলেনি। শেষ ধাক্কাটা দিয়ে গিয়েছে নোটবন্দি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গ্রামীণ অর্থনীতির যেটুকু স্থিতাবস্থা অবশিষ্ট ছিল, তাও নোটবন্দির প্রভাবে টলে গিয়েছে। রাজকোষে নগদ অর্থের অভাবে মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডণবীস সরকার কৃষি পণ্য মজুত করার জন্য গুদাম পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। চলতি আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, কৃষকদের উৎপাদন মূল্যের উপর ৫০ শতাংশ সহায়ক মূল্য দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রতিও পূরণ করা হয়নি।
আরও পড়ুন: দাবির সঙ্গে মনও জিতল লাল মিছিল
অনেকেই বলছেন, কৃযকদের সমস্ত দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে ফডণবিস সরকার মহারাষ্ট্রের কৃষকদের আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরিয়ে আনল ঠিকই। কিন্তু তুষের আগুনটা নিভল না। প্রতিশ্রতি পূরণ না হলে যদি তারা ফের আন্দোলনে নামেন, যদি তুষের আগুন দাবানলের চেহারা নেয়, তবে কিন্তু অবাক হওয়ার কিচ্ছু থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy