Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

হাহাকারের মাস পয়লা, ভোর না হতেই লাইন দিয়ে শূন্য হাতে ফেরা

মাস পয়লা। কিন্তু পকেট শূন্য, হাত খালি! বেতন, পেনশন জমা পড়েছে ব্যাঙ্কে। কিন্তু সে টাকা তোলার জো নেই! মাথায় ঘুরছে মাসের শুরুতে মোটা খরচের ফিরিস্তি— বাড়িভাড়া, ছেলে-মেয়ের স্কুলের বেতন, পরিচারিকার মাইনে, মুদিখানার খরচ...।

দুশ্চিন্তার দুই মুখ। বৃহস্পতিবার টাকার খোঁজে ব্যাঙ্কের লাইনে পেনশনভোগীরাও। ছবি: সুমন বল্লভ।

দুশ্চিন্তার দুই মুখ। বৃহস্পতিবার টাকার খোঁজে ব্যাঙ্কের লাইনে পেনশনভোগীরাও। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩০
Share: Save:

মাস পয়লা। কিন্তু পকেট শূন্য, হাত খালি!

বেতন, পেনশন জমা পড়েছে ব্যাঙ্কে। কিন্তু সে টাকা তোলার জো নেই!

মাথায় ঘুরছে মাসের শুরুতে মোটা খরচের ফিরিস্তি— বাড়িভাড়া, ছেলে-মেয়ের স্কুলের বেতন, পরিচারিকার মাইনে, মুদিখানার খরচ...। কিন্তু এটিএমে হয় ঝুলছে ‘টাকা নেই’ নোটিস, না হয় তার সামনে অন্তত জনা পঞ্চাশের আঁকাবাঁকা লাইন। ব্যাঙ্কে কাউন্টারের অবস্থাও তথৈবচ।

অবস্থা শীঘ্র শোধরাবে এমন কোনও আশ্বাস এ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে মেলেনি। বরং উল্টো কথাই শুনিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বলেছেন, নোটের অভাবে তিন থেকে ছ’মাস কষ্ট সহ্য করতে হবে। অথচ নোট বাতিলের পরে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই বলেছিলেন, ‘‘এই কষ্ট ৫০ দিনের জন্য। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিন আমাকে।’’ বৃহস্পতিবার জেটলি অন্য কথা বলায় অনেকের প্রশ্ন, তবে কি পরিস্থিতি কতটা ঘোরালো হবে, তা আঁচই করতে পারেনি সরকার? খোদ প্রধানমন্ত্রীই কি বোঝেননি যে, কতখানি ভুগতে হবে আমজনতাকে?

আঁচ করা যাক বা না-যাক, চূড়ান্ত ভোগান্তির টুকরো-টুকরো ছবি এ দিন চোখে পড়েছে রাজ্য সমেত দেশের সর্বত্র। কোথাও ভোর ছ’টায় লাইনে দাঁড়িয়ে বেলা এগারোটায় পেনশন তুলেছেন বৃদ্ধা। কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ব্যাঙ্কে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। যাঁরা বরাত জোরে কিছু পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেরও ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড় ২০০০ টাকার নোট ভাঙানোর চিন্তায়। তা দিয়ে পাড়ার দোকানে পাঁচশো কাটাপোনা তো আর কেনা যাবে না।

মাস পয়লায় চাকরিজীবী ও পেনশনভোগীদের এই হয়রানি নিয়ে কেন্দ্রকে বিঁধছে বিরোধীরা। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘(ব্যাঙ্কে) ১০ হাজার চাইলে বলছে ৫ হাজারের বেশি পাবেন না। এটিএমে তো দু’হাজারের নোট ছাড়া কিছুই নেই। লোকে কাজকর্ম শিকেয় তুলে লাইন দিচ্ছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সংগঠিত ক্ষেত্রেই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের দশা বোঝাই যায়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, কোন রাজ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে কত টাকা আসছে, তা জানানো হোক।

সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস (হিসাব রক্ষা) কমিটিরও সিদ্ধান্ত, নোট নাকচের পরে নগদের সরবরাহ ও অর্থনীতির পরিস্থিতি জানতে ডেকে পাঠানো হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেল, অর্থসচিব অশোক লাভাসা এবং আর্থিক বিষয়ক সচিব শক্তিকান্ত দাসকে।

নোট বাতিলের ঘোষণার পরে এই প্রথম ‘মাস পয়লা’র পরীক্ষার মুখে পড়েছিল কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাদের আশ্বাস ছিল, মাসের প্রথম সাত দিনে টাকা যে অনেকটা বেশি তোলার প্রয়োজন হবে, তা তারা জানে। এবং সেইমতো তৈরিও হচ্ছে। প্রথম সপ্তাহে বাড়তি নগদ জোগানো হবে ব্যাঙ্কগুলিকে। কিন্তু দেখা গেল, প্রথম দিনেই তারা ডাহা ফেল। নর্থ ও সাউথ ব্লকের এটিএমে টাকা নেই। খাস সংসদ ভবনের এটিএমে ঢুঁ মেরে বিরস মুখে ফিরে আসছেন সাংসদেরা।

ব্যাঙ্কের অবস্থাও এক। এটিএমে দিনে আড়াই হাজার টাকার বেশি তোলা যাচ্ছে না। তাই মাসের শুরুতে মোটা খরচ সামাল দিতে মানুষ যে বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্কমুখো হবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ, এক বার ব্যাঙ্কে গিয়ে সপ্তাহে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলার দরজা খোলা আছে। কিন্তু এ দিন দেখা গিয়েছে, সেই সুযোগ রয়েছে নাম কে ওয়াস্তেই। কলকাতা-সহ দেশের অধিকাংশ শহরেই ব্যাঙ্কে গিয়ে আমজনতা শুনেছেন, পাঁচ-দশ হাজারের বেশি দেওয়া যাবে না। তার উপর কলকাতার বেশির ভাগ ব্যাঙ্কে টাকাই ফুরিয়ে গিয়েছে দুপুর আড়াইটের মধ্যে। যার জেরে হয়রান হয়েছেন পেনশন তুলতে আসা বয়স্ক মানুষ। নেতাজিনগরে সকাল থেকে লাইন দেওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী বলেন, ‘‘ডাকঘর খুলতেই শুনি টাকা নেই। পেনশন মিলবে না।’’ বেসরকারি সংস্থার কর্মী তাঁর ছেলেও টাকা তুলতে এটিএমের খোঁজে হন্যে।

নগদের জোগানের হাল কী ছিল, তা স্পষ্ট চিফ পোস্ট মাস্টার জেনারেল (ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্কেল) অরুন্ধতী ঘোষের কথাতেই। বহু মানুষ যে টাকা তুলতে পারেননি তা কবুল করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘চাহিদার তুলনায় অনেক কম টাকা পাওয়ার কারণেই এই সমস্যা। যেমন, জিপিও এবং বড়বাজার শাখায় প্রয়োজন ছিল যথাক্রমে ৭ ও ৮ কোটি টাকা। কিন্তু তারা পেয়েছে এক কোটি করে।’’ উল্লেখ্য, ডাকবিভাগে টাকার জোগান দেয় স্টেট ব্যাঙ্ক। অরুন্ধতীদেবীর মতে, টাকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় চাহিদা ৫০% বেড়েছে। অথচ জোগান সেই তুলনায় অনেক কম।

তাঁর সঙ্গে একমত ব্যাঙ্ককর্তারাও। বৌবাজারে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, ভরদুপুরেই এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় ‘নো ক্যাশ’ নোটিস। ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের কর্মীরা বোঝাচ্ছেন, ‘‘আমরাও বেতন তুলতে পারিনি।’’ বাগুইআটিতে আবার পেনশন তুলতে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়ানো বয়স্করা জলখাবার, ওষুধ খাচ্ছেন সেখানেই। কোথাও ব্যাঙ্ক নম্বর লেখা কুপন ধরিয়েও পরে বলেছে টাকা শেষ। তো কোথাও এটিএমে একশোর নোট আসার রটনাতেই লাইন পড়েছে ৮০ জনের। বেতন তুলতে গিয়ে নবান্নেই নাকানিচোবানি খেয়েছেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা। কারও নোট পেয়েও মুখ ব্যাজার তা দু’হাজারের হওয়ায়। কলকাতা হাইকোর্টের এক অফিসার ১২ হাজারের চেক দিয়ে পেয়েছেন পাঁচ হাজার। ফের লাইনের হ্যাপা ভেবে তাঁর ঘুম ওড়ার জোগাড়। হাজার টাকা তুলতে চাওয়ায় কাউকে আবার ব্যাঙ্ক ধরাতে চেয়েছে ১০০টি ১০ টাকার কয়েন!

বেতন তুলতে না পারায় এ দিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান রাজ্য সরকারি কর্মী ফেডারেশনের সমর্থকরা। ক্ষোভ যে ভাবে বাড়ছে, তাতে এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছিলেন, ‘‘গ্রাহকদের হাতে চড়থাপ্পড় খাওয়াই বাকি।’’ খিদিরপুরে এ দিন গোলমাল বেঁধেছিল। হস্তক্ষেপ করে স্থানীয় থানা। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল যে, ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরে এ দিনই প্রথম বিক্ষোভ ও গণ্ডগোলের খবর পাওয়া গিয়েছে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে। মেরঠে ব্যাঙ্ক কর্মীদের আটকে রাখা হয়েছে, লখনউ শহরে ভাঙচুর করা হয়েছে এটিএম। হরিয়ানায় অনেক জায়গায় পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছে। সঙ্গে রাস্তা অবরোধ। গণ্ডগোলের খবর মিলেছে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কেরল, কর্নাটক থেকেও। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র বারাণসীতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে বিজেপি সমর্থকদের। এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার পক্ষে সওয়াল করেছেন বিক্ষুব্ধরা।

কালিম্পং থেকে বাসে শিলিগুড়ি এসে লাইনে দাঁড়িয়ে এ দিন দু’হাজারের দু’টি নোট পেয়েছেন পূর্ণিমা গুরুঙ্গ। পাহাড়ি গ্রামে তা কী ভাবে ভাঙাবেন, জানেন না।

‘নোট নেই’ বা ‘শুধু দু’হাজার’— এই দুই লব্জে এ দিন আটকে রইল সারা দেশ। পাহাড় থেকে সমতল, সংসদ থেকে সন্দেশখালি।

নোট বাতিলের সময়ে মোদী বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে আর্থিক সাম্য তৈরি হবে। ‘হক কথা’!

অন্য বিষয়গুলি:

Cashless ATM people Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy