Advertisement
১৫ মে ২০২৪
National News

মোদী-শাহের দূরদর্শিতার অভাবেই কি এমন অগ্নিগর্ভ বিক্ষোভ? উঠছে প্রশ্ন

বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের একাংশও মেনে নিচ্ছেন এ কথা।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:০৪
Share: Save:

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে যে দেশজোড়া এমন আন্দোলন হতে পারে, তা কি আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব? সংসদে বিল পাশ হওয়ার দু’সপ্তাহ পরেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে ভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে, তাতে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দলের অন্দরে এবং বিশেষজ্ঞ মহলে। প্রশ্নের মুখে পড়ছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দূরদর্শিতাও।

বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের একাংশও মেনে নিচ্ছেন সে কথা। আর সে কারণেই ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর গত সাড়ে পাঁচ বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে দলকে। ড্যামেজ কন্ট্রোল কী ভাবে করা সম্ভব, তা নিয়ে দলের ‘মাস্টারমাইন্ড’রা ছক কষতে শুরু করে দিয়েছেন বলেও বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব সূত্রে খবর। একই সঙ্গে অবশ্য দলের নেতাদের একাংশ এটাও মেনে নিচ্ছেন যে, ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এই আইনের ফলে কার্যত সংখ্যালঘু-বিরোধী তকমা সেঁটে গিয়েছে দলের গায়ে। সেটা পুনরুদ্ধারের কাজটা সহজ হবে না।

দেশবাসীর ‘নাড়ির স্পন্দন’ অনুভব করার আশ্চর্য ক্ষমতাধর তিনি। এমনটাই বলা হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তা ছাড়া অদ্ভুত বাচনকৌশলে জনতার মন জয়ের ক্ষমতাও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বলে মনে করেন অনেকে। আবার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিস্কের জন্য সুনাম রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের। মূলত তাঁর কৌশলেই আগে থেকে কাশ্মীরকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে তার পর ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা হয়েছে। এবং সেই রদের পরেও দীর্ঘ দিন ধরে নিয়ন্ত্রণ জারি রেখে প্রায় রক্তপাত-হিংসাহীন পরিস্থিতি তৈরি করা গিয়েছে। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কিত মামলার রায়ের আগে যে ভাবে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, তাতেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন অমিত শাহ।

তা হলে সিএএ-এনআরসির ক্ষেত্রে তেমনটা হল না কেন? কারণ হিসেবে দলের নেতা-মন্ত্রীরা কেউ বলছেন, দূরদর্শিতার অভাব, কারও মতে অতি আত্মবিশ্বাসই ডুবিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জীব বলিয়ান সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি আন্দোলন এই রকম চেহারা নিতে পারে। শুধু আমি কেন, অন্য নেতা-মন্ত্রীরাও এই রকম হিংসাত্মক আন্দোলনের আগাম আঁচ করতে পারেননি।’’

সঞ্জীব বলিয়ান সরাসরি বললেও নাম প্রকাশ করতে চাননি অনেকেই। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি মনে করি বিল পাশ করার আগে এর রাজনৈতিক সমীকরণ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি।’’ এক সাংসদের কথায়, ‘‘মনে করা হয়েছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দু’একটা ছোটখাটো বিক্ষোভের আশঙ্কা থাকবে। কিন্তু সেটা যে কার্যত গণ প্রতিরোধের চেহারা নেবে, তা আন্দাজ করাই যায়নি।’’ তিনি মনে করেন, শীর্ষ নেতৃত্ব ধরে নিয়েছিলেন যে, সেই সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে কোনও অসুবিধা হবে না। অর্থাৎ তাঁর ইঙ্গিত সেই অতি-আত্মবিশ্বাসের দিকে।

বিজেপির মতাদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) অবশ্য বিরোধীদের দিকেই তির ছুড়ছে। সংগঠনের বর্ষীয়ান নেতা মনমোহন বৈদ্য বলেন, ‘‘হিংসাত্মক প্রতিবাদ এই কারণে নয় যে, সাধারণ মানুষকে বোঝানো যায়নি। বরং কারণ এটা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ইচ্ছে করে কায়েমী স্বার্থের জন্য তাঁদের ভুল বোঝানো হয়েছে।’’

কিন্তু শুধুই কি একটা আইনের জন্য দেশ জুড়ে এমন এককাট্টা জোটবদ্ধ প্রতিবাদ হতে পারে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, তা নয়। এটা আসলে মোদী জমানার সাড়ে পাঁচ বছরে একাধিক ইস্যুতে জমে থাকা ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। ইনস্টিটিউট অব সেন্টার ফর স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর ডিরেক্টর সঞ্জয় কুমারের মতে, ‘‘এটা ঠিক যে, এই আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মানুষ। কিন্তু তার সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের স্টাইলে মোদীর সরকার চালানোর বিরুদ্ধেও এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ।’’

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল মোদী সরকার। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর সঙ্গে ছিল বিপুল কর্মসংস্থান-সহ সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সাড়ে পাঁচ বছরের জমানায় নোট বাতিল, জিএসটির মতো একাধিক ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। বর্তমান আর্থিক মন্দাও এই সবের ফলশ্রুতি বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তার উপর মোদী জমানায় মুসলিম-দ্বেষী হিংসা, গণপিটুনির মতো ঘটনা বেড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করেন, এই সব বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তার বহিপ্রকাশের মতো কোনও ইস্যু হাতে ছিল না। সিএএ-এনআরসি সেই বারুদে অগ্নি সংযোগ করেছে।

তা হলে এখন উপায়? বিজেপির অভ্যন্তরের খবর, আপাতত ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক নেতা-নেত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে জনসংযোগ বাড়ানোর একান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার প্রচেষ্টাও জারি রয়েছে। মূলত কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক কিছু দলের উস্কানিতেই যে বিক্ষোভ এমন আকার নিয়েছে, তা ধরে নিয়ে পাল্টা আক্রমণের রাস্তাও নেওয়া হয়েছে।

কংগ্রেস অবশ্য প্রকাশ্যে বিজেপির ঔদ্ধত্য সাম্প্রদায়িক তথা মেরুকরণের রাজনীতিকেই দায়ী করছে। তাঁদের উস্কানিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে, এ কথা মানতে নারাজ তারা। দলের নেতাদের বক্তব্য, এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ স্বতস্ফূর্ত। এতে কংগ্রেস কেন, কার্যত কোনও রাজনৈতিক দলেরই ইন্ধন নেই। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান বলেছেন, ‘‘ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও আইন তৈরি হয়েছে, যা ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি। শাসক দলের হিন্দুত্বের রাজনীতিই আত্মঘাতী হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CAA NRC BJP Amit Shah Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE