১৮৬০০০০০০০০০০ টাকা!
কথায় লিখলে, ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। কয়লা বণ্টন কেলেঙ্কারিতে সরকারি কোষাগারের এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল, ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যে ২১৮টি কয়লাখনি বণ্টন হয়েছে, তার সবটাই বেআইনি। কারণ, নিলাম না করে সরকারি কমিটির পছন্দমতো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে কয়লাখনি পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি কয়লাখনিও এই তালিকায় রয়েছে।
কয়লাখনি বণ্টনের দুর্নীতির তদন্ত করছে সিবিআই। সরকারি কর্তাদের ঘুষ দিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলি কয়লা খনি আদায় করেছিল কি না, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, বহু শিল্প সংস্থা কয়লাখনি পেয়েও কোনও উৎপাদন বা কারখানার কাজ শুরু করেনি। দেশের প্রথম সারির বেশ কিছু সংস্থার পাশাপাশি শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধেও মামলা শুরু করেছিল সিবিআই। সেই এফআইআরে অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন কয়লাসচিব প্রকাশ পরাখও। কোনও তথ্যপ্রমাণ না মেলায় আজ বিড়লা ও পরাখের বিরুদ্ধে মামলা বন্ধ করার কথা আদালতকে জানিয়েছে সিবিআই।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের এই রায় যাঁর ভাবমূর্তিতে নতুন করে কালি ছেটালো, তাঁর নাম মনমোহন সিংহ। ১৯৯৩ থেকে ২০১০ এই দীর্ঘ সময়ে কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, এনডিএ এবং ইউপিএ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল। এই সময়কালে মোট ২১৮টি কয়লাখনি বণ্টন হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে ১৫৫টি খনি বণ্টন হয়েছে মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রীর গদিতে থাকাকালীন। এর মধ্যে আবার সিংহভাগ খনি বণ্টন হয়েছে যখন মনমোহন নিজে কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে কিছু খনির বরাত বাতিল করে কেন্দ্র। ফলে, সংস্থাগুলির হাতে এখন ১৯৬টি খনি রয়েছে। ১ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকার ক্ষতির অভিযোগ তুলেছিলেন প্রাক্তন কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বিনোদ রাই। শীঘ্রই প্রকাশিত হবে তাঁর স্মৃতিকথা। তার আগেই তিনি দাবি করেছেন, সিএজি রিপোর্টে কিছু ব্যক্তির নাম না রাখার জন্য রাজনীতিকরা তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন। আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই বিনোদ রাইকে দেখা গিয়েছে তিনমূর্তি ভবনে, একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে। কিন্তু আদালতের রায় নিয়ে মুখ খুলতে চাননি তিনি। কংগ্রেস অবশ্য বিজেপিকে পাল্টা হামলা করে কিছুটা স্বস্তি পেতে চেয়েছে। দলের বক্তব্য, “১৯৯৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কয়েক বছর কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার ছিল। সেই জমানায় কয়লাখনি বণ্টনের নীতিই ইউপিএ সরকার অনুসরণ করেছে।”
মনমোহন সরকারের বিরুদ্ধে কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআইয়ের তদন্তেও নাক গলানোর অভিযোগ উঠেছিল। সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা নিজেই জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমারের চাপে তাঁকে রিপোর্ট বদলাতে হয়। সিবিআইয়ের এই অবস্থা দেখে সুপ্রিম কোর্ট তাকে ‘খাঁচার তোতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। যার জেরে অশ্বিনীকে পদত্যাগ করতে হয়।
শুধু মনমোহনের ভাবমূর্তি নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত দেশের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কারণ বেসরকারি সংস্থাকে শিল্পের প্রয়োজনে নিজস্ব বিদ্যুৎ তৈরির জন্যই এই সব কয়লাখনি বিলি করা হয়েছিল। ১২টি বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের জন্যও ১২টি কয়লাখনি বণ্টন হয়। এখন ১৯৯৩-২০১০ সালের মধ্যে সব খনি বণ্টনই বেআইনি হয়ে গেলে, এই শিল্প ও বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য আজ ওই কয়লাখনি বণ্টনকে বেআইনি আখ্যা দিলেও সেগুলি বাতিল করে দেয়নি। বহু খনি থেকে ইতিমধ্যেই উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে, যাঁরা কয়লাখনি পেয়েছেন, তাঁদের জরিমানা দিতে হবে কি না এ সব নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুনানি শুরু হবে। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ও অন্য সব পক্ষের বক্তব্য শোনা হবে।
যদি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে এখন জরিমানা দিতে হয়, তার ধাক্কায় বিদ্যুতের দাম বাড়বে। সব কয়লাখনি বণ্টন বাতিল হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি কোথা থেকে কয়লা পাবে, সেই প্রশ্ন উঠবে। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই তৈরি হয় কয়লা থেকে। প্রাক্তন কয়লাসচিব পি সি পরাখ বলেন, “একটা কয়লাখনিতে উৎপাদন শুরু করতে ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। এমনিতেই কয়লার অভাব। সব কয়লাখনি বণ্টন বাতিল হয়ে গেলে আমরা আরও ৫ বছর পিছিয়ে যাব।”
তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে আজ স্বাগত জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। তাঁর বক্তব্য, “কয়লা ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা চলছিল, এ বার তার নিষ্পত্তি হবে। আইনের স্বচ্ছতা এবং স্পষ্ট নীতি হল ভাল অর্থনীতির চিহ্ন।” প্রায় একই সুরে বণিকসভা সিআইআই বলেছে, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনে স্বচ্ছতা আসবে। খনিগুলির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সময়ে যে সব ক্ষেত্রে লগ্নি বা উৎপাদন শুরু হয়েছে সেগুলির কথা কোর্ট মাথায় রাখবে বলেই আমরা আশা করি।”
কয়লাখনি নিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎমন্ত্রী। সরকারি সূত্র বলছে, খনি বণ্টনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে মোদী সরকার কী অবস্থান নেবে, তা ঠিক করতেই এই বৈঠক। কারণ, ভবিষ্যতে কয়লাখনি বণ্টনের ক্ষেত্রে যাতে স্পষ্ট নীতি তৈরি হয়, তারই চেষ্টা করবেন মোদী। গত পাঁচ বছরে কয়লা ক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার জন্যই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি কয়লার অভাবে ধুঁকছে। অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়েছে। মোদী এই অবস্থার পরিবর্তন চাইছেন।
টুজি স্পেকট্রাম বণ্টন, কয়লাখনি বণ্টন এবং কমনওয়েল্থ গেমস এই তিন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে মনমোহন সরকারকে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। সুপ্রিম কোর্ট এর আগে টুজি স্পেকট্রামের ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছিল। শিল্প মহল মনে করছে, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ কয়লাখনিগুলির ভবিষ্যৎ চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকবে। আজ যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে শেয়ার বাজারে। কয়লা নিয়ে যাদের কারবার, সেই বিদ্যুৎ, সিমেন্ট ও ইস্পাত নির্মাণকারী শিল্প সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম পড়েছে। যে সব ব্যাঙ্ক বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে ঋণ দিয়েছিল, তাদের ঋণ শোধ নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
১৯৯৩ সাল থেকে শিল্প সংস্থাগুলিকে নিজস্ব প্রয়োজনের বিদ্যুৎ তৈরি করে নেওয়ার জন্য কয়লাখনি বণ্টন করা শুরু হয়। নিলামের বদলে একটি স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে তা বণ্টন হত। যে কমিটিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রতিনিধিরাও থাকতেন। রাজ্য সরকারও বিনিয়োগে উৎসাহী শিল্প সংস্থাকে কয়লা খনি পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই কমিটিতে দরবার করত। প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ আজ রায় দিয়েছে, এ ভাবে খনি বণ্টন বেআইনি। ১৬৩ পৃষ্ঠার রায়ে বেঞ্চ জানিয়েছে, স্ক্রিনিং কমিটির মোট ৩৬টি বৈঠক হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম মেনে খনি বণ্টন হয়নি। স্বচ্ছতা বা নিরপেক্ষতা বলে কিছু ছিল না। কয়লার মতো জাতীয় সম্পদ বেআইনি ভাবে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্ক্রিনিং কমিটির বাইরে, সরকারি সংস্থা বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে তৈরি প্রকল্পের জন্য যে সব কয়লা খনি বণ্টন হয়েছে, তাকেও বেআইনি বলে আখ্যা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
বণিক মহলের পুরনো প্রবাদ, শিল্পের রাজা হল কয়লা। আজ রায়ে তা-ও উল্লেখ করেছে তিন বিচারপতির বেঞ্চ। এখন সেই রাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy