তোড়জোড়: উদ্বোধনের আগে সর্দার সরোবর বাঁধ।— নিজস্ব চিত্র।
প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য এখন ‘উপহার’-এর আশায় বুঁদ হয়ে আছে!
আগামী রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। আর তাকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহের বেশি দিন ধরে রাজ্যভর উন্নয়নের এক খয়রাত-মঞ্চ তৈরি হয়ে গিয়েছে। অমদাবাদ ছেড়েই দিন, জাপানি বুলেট ট্রেনের বাঁশি বাজতে দেখছি সুরাতের রাস্তাঘাটেও। সুরাত বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আট নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে একশো কিলোমিটার উজিয়ে ভারুচ জেলা। আরও ত্রিশ কিলোমিটার গেলে নর্মদা জেলা। এমন কোনও চৌরাহা-চক, কসবা, বস্তি এমনকী ভুট্টা ক্ষেতও চোখে পড়ল না, যার মুখ ঢাকেনি উন্নয়নের বিজ্ঞাপনে! ফেস্টুন, গ্লো-সাইন, প্লাস্টিক বোর্ডে বড়-মেজ ও ছোট মুখ (আকার অনুযায়ী) যথাক্রমে মোদী-অমিত শাহ ও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি। জাপানি উন্নয়ন পর্ব সদ্য শেষ হয়েছে। চিত্রনাট্যের পরবর্তী থিম সর্দার সরোবর প্রকল্প এবং বিশ্বের দীর্ঘতম মূর্তি বল্লভভাই পটেলের ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ প্রকল্প।
জন্মদিনে সূর্যোদয়ের কিছু পরেই সর্দার সরোবর বাঁধের উপরে নর্মদা দেবীর আরাধনা করবেন মোদী। তার পরে লাল কার্পেটে মোড়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে বোতাম টিপে নদীর অবরুদ্ধ ৫৮০ কোটি কিউবিক মিটার জল উৎসর্গ করবেন দেশবাসীকে। এর পর দাভোইয়ের কাছে গুজরাতের জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন নর্মদা বাঁধের সুফল নিয়ে। কারণ নর্মদার উপরে এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দেশের মাটিতে মেধা পাটকর-সহ পরিবেশবিদদের অনশন-আন্দোলন তো হয়েছেই, বিদেশেও তুমুল সমালোচনা হয়েছে এই প্রকল্পের। তার পরেও বাঁধ নির্মাণের সাফল্য ভোটমুখী গুজরাতে ছেড়ে দেবেন মোদী? মোটেই না! আর সে কারণেই রবিবার সত্ত্বেও মোদীর জন্মদিনের উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হতে স্কুলে আসতে বলা হয়েছে পড়ুয়াদের!
আরও পড়ুন: রাম রহিমের বিরুদ্ধে জোড়া খুনের মামলার শুনানি আজ, সেই পঞ্চকুলায়
অথচ এই উন্নয়নের জলে তলিয়েছে গুজরাতের ৪০ হাজার হেক্টর জমি। তিনটি গ্রামের সলিল সমাধি হয়েছে। সরকারি হিসেব আরও বলছে, ১৮টি গ্রামের মাথাটুকু শুধু উজিয়ে ছিল জলের উপর। রবিবারের ‘মেগা মোদী শো’-র তদারকিতে নাজেহাল সর্দার সরোবর বাঁধের সুপারিন্টেন্ড্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার আর জে কানুনগো বলছেন, মধ্যপ্রদেশে হয়তো পুনর্বাসনে কোনও সমস্যা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এখানে আমরা ডুবে যাওয়া জমির বদলে নতুন জমি দিয়েছি। যার যত হেক্টর জমি গিয়েছে, তার চেয়ে বেশি জমিই দিয়েছি।’’
সরকারি বড়কর্তা বলছেন বটে। কিন্তু এই নর্মদা জেলার বিন্ধ্যাঞ্চল ও সাতপুরা রেঞ্জের আশপাশের গ্রামে বাসোয়াবা এবং তার্মি উপজাতিদের গুঞ্জন সরকারে বহু চেষ্টাতেও ধামাচাপা পড়ছে না। যে গুঞ্জনের নির্যাস— ‘এই পাহাড়-নদী, পাথর-অরণ্য আমাদের দেবতা। আমাদের রক্ষক ও ধাত্রী। বুলডোজার আর কংক্রিট দিয়ে একে ধ্বংস করার দাম ভবিষ্যতে দিতেই হবে।’ গুজরাতের রাজনৈতিক শিবিরের একটি অংশের মতে আপনি বাঁচলে পরিবেশের নাম! আর কয়েক মাসের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আর তার পর লোকসভা। বিধানসভা ভোটের আগে বাজি যদি হয় সর্দার সরোবর বাঁধ, তা হলে ২০১৯-এর দিকে তাকিয়ে অন্য একটি প্রকল্প। সাতপুরা রেঞ্জের সাধু পাহাড় ভেঙে ১৮২ মিটারের এক অতিকায় বল্লভভাই পটেলের মূর্তি। বিশ্বের উচ্চতম স্ট্যাচু। যদিও প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেন এই মূর্তি নির্মাণ, তার কোনও ব্যাখ্যা সাদা চোখে মিলছে না। তবে প্রকল্পের কর্তারা বলছেন, মূর্তির উচ্চতা ১৮২ মিটার কারণ রাজ্যে ১৮২টি বিধানসভা আসন রয়েছে। আর আশপাশের সব গ্রামে বলা হয়েছে, একটু করে মাটি আর লোহা দিন। তৈরি হবে দেশের গৌরব। সমালোচকরা বলছেন, এই মাটি-লোহার মাধ্যমে গ্রামের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগের কাজে লাগলেও এই মূর্তি তৈরির কাঁচামাল কিন্তু আসছে চিন থেকে!
উপহারের আশ্বাসেও তাই ক্ষোভের গুঞ্জন কিন্তু থামছে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy