ইডেনে আমেরের মেজাজ। -শঙ্কর নাগ দাস
ক্লাবহাউসের পাশের ব্লকে হুইলচেয়ারে বসা ওই ব্যক্তিটি কে? গায়ে বাংলাদেশ জার্সি, নিবিড় মনোযোগ মাশরাফি-সাকিব-তামিমদের দিকে।
ওপার বাংলার এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, উনি তাঁদের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের মাঝারি এক কর্তা। সেই ধর্মশালা থেকে দলের সঙ্গে ঘুরছেন। পাহাড়ি পিছল রাস্তায় পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙেছেন। তাই বলে ইডেনে ছাব্বিশ বছর পরে তাঁর দেশ নামছে, আর তিনি থাকবেন না? ভাঙা পা নিয়েই তাই হুইলচেয়ার জোগাড় করে ধর্মশালা থেকে পাড়ি দিয়েছেন কলকাতায়।
সিএবির অফিস, ইডেন গ্যালারি আর প্রেসবক্স মিলিয়ে হাজারপাঁচেক লাল-সবুজ জার্সি, কয়েকশো লাল-সবুজ পতাকা। এঁরা কেউ বাংলাদেশ বোর্ডের মেজ-সেজ-ছোট কর্তা। কেউ ক্রিকেট পর্যটক। কেউ সাংবাদিক। এঁরা সবাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের তীব্র সমর্থক। ছাব্বিশ বছর পর ‘সোনার বাংলা’ ইডেনে নামছে— এঁরা সবাই সেই স্বপ্নপূরণের অংশীদার, এঁরা সবাই স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী। এবং শুধু এঁরা নন, দিনের শেষে গোটা ইডেন সাক্ষী এমন এক ঘটনার, যাকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বললে বোধহয় খুব ভুল বলা হবে না।
ইডেনের গ্যালারিতে উড়ছে কয়েক টুকরো সবুজ কাপড়। একটা কোণ সাদা, মাঝে অর্ধচন্দ্র-তারা।
ইডেনের গ্যালারিতে উড়ছে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা!
শুধু ইডেন কেন, ভারতের যে কোনও মাঠে পাক সমর্থনের এহেন গর্জন প্রায় নজিরবিহীন। ওয়াঘা পেরিয়ে মোহালিতে আসেন শাহিদ আফ্রিদির দেশের মানুষ। কিন্তু এমন চিৎকার, এমন দৃপ্ত পতাকা প্রদর্শন, ‘দিল দিল পাকিস্তান’ টিম থিমের সঙ্গে এ ভাবে গলা মেলানো, জায়েন্ট স্ক্রিনে শাহিদ আফ্রিদির মুখ ভেসে ওঠায় এমন উল্লাস— এ সব শেষ কবে দেখেছে ভারতের কোনও মাঠ? আদৌ দেখেছে কি?
পাকিস্তানের এই ক্রিকেট— এটাও তো সাম্প্রতিকে নজিরবিহীন। এশিয়া কাপে চূড়ান্ত ব্যর্থতা শুধু নয়। তার আগে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১-২ সিরিজ বিপর্যয়। তারও আগে ইংল্যান্ডের হাতে ০-২ হার। বোলিং টেনে দিচ্ছে কিন্তু বারবার ব্যাটিং ধস নামলে আর কত টানতে পারবে— প্রাক্ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তো এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল টিম আফ্রিদির নির্যাস। তার উপর মহম্মদ আমের বাদে দলের একমাত্র ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, অধিনায়ক স্বয়ং ছিলেন এমন ফর্মে, যাকে দুঃস্বপ্ন বললেও কম বলা হয়। মাঠের বাইরে বড়-ছোট বিতর্ক, সে তো টিমের প্রায় নিত্যসঙ্গী।
এই প্রেক্ষিতে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ৫৫ রানের মতো বড় ব্যবধানে জয় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে একটা টিমের আত্মায়? শুধু তো জয় নয়। বিপক্ষকে ম্যাচের কক্ষপথ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জয়। যে জয়ে উল্লেখ্য মহম্মদ হাফিজের হাফসেঞ্চুরি। আহমেদ শেহজাদের ৩৯ বলে ৫২। এই দুইয়ের ৬৮ বলে প্রায় সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ। মহম্মদ আমেরের বিধ্বংসী প্রথম স্পেল। এবং সর্বোপরি, অধিনায়ক শাহিদ আফ্রিদির ফের শাহিদ আফ্রিদি হয়ে ওঠা।
দিনকয়েক আগে ইডেনকে বলে গিয়েছিলেন, টিমের দরকারে নিজে উপরে নামবেন। এ দিন চারে নামলেন পাক ক্যাপ্টেন। টিমের খুব দরকার ছিল বলা যাবে না, কারণ পাকিস্তান তখন ১৬৩-৩। তিন ওভার হাতে, দুশো প্রায় নিশ্চিত। না কি টিমের দরকার ছিল? দরকার ছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই তার অধিনায়কের ব্যাটে এই আতসবাজি? দরকার ছিল অধিনায়কের সঙ্গে তাঁর আত্মবিশ্বাসের পুনর্মিলন?
বুধবারের ইডেনের আগে শেষ দশ ইনিংসে তাঁর মিলিত রান ছিল ৯৭। শেষ বার তিরিশের গণ্ডি পেরিয়েছেন ২০১৫-র অগস্টে। আর আজ নেমে দ্বিতীয় বলেই মাশরাফি মর্তুজাকে পরপর দুটো চার, তৃতীয়টা স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে ছক্কা। ১৯ বলে ৪৯ রানের ইনিংসে চারটে চার, চারটে ছয়। স্ট্রাইকরেট ২৫৭.৮৯। শাহিদ আফ্রিদির নিজেরও বোধহয় এই ইনিংসটা খুব দরকার ছিল। দরকার ছিল এ রকম একটা জয়। না হলে কেন সাত সকালে গোটা টিমকে ব্রেকফাস্ট টেবলে ডেকে বলে দেবেন, ‘হার-জিত নিয়ে তোমাদের বক্তৃতা দিতে ডাকিনি। শুধু বলব আমার পরিচিতি, আমার সম্মান সব ক্রিকেট। তোমরা সেই সম্মানটা রেখো।’ না হলে কেন টসের আগে ড্রেসিংরুমে কোরানের অংশবিশেষ পড়ে শুনিয়ে তাতাবেন তাঁর টিমকে? কেন ম্যাচের পর ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করে লিখবেন, ‘এটা আমার প্রিয় ভক্তদের জন্য, আমার সমর্থকদের জন্য, আমার শুভানুধ্যায়ীদের জন্য। আর তার চেয়েও বেশি, এটা আমার সমালোচকদের জন্য’?
শাহিদ আফ্রিদির, শাহিদ আফ্রিদির টিমের আজকের এই জয়টা সত্যিই খুব দরকার ছিল। ভারতের বিরুদ্ধে টস করতে নামার বাহাত্তর ঘণ্টা আগে ইডেনের এমন সমর্থন, অপ্রত্যাশিত বোনাস। প্রাপ্তির এই বুধ-সন্ধের পর কী চাইতে পারে টিম পাকিস্তান? জয়ের উৎসব? টিম পার্টি? ক্রিকেট থেকে এক দিনের বিশ্রাম?
নাহ। ও সব কিছু নয়। এই ম্যাচ জিতে উঠে পাকিস্তান যা চেয়েছে, শুনে অবাক হয়ে গিয়েছেন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এই ম্যাচ জিতে উঠে পাকিস্তান চেয়েছে এক দিনের বাড়তি প্র্যাকটিস!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: পাকিস্তান ২০১-৫ (হাফিজ ৬৪, শেহজাদ ৫২, আফ্রিদি ৪৯, তাসকিন ২-৩২), বাংলাদেশ ১৪৬-৬ (সাকিব ৫০ নট আউট, আফ্রিদি ২-২৭, আমের ২-২৭)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy