চার মাসও লাগল না সিন্ধুর বদলা নিতে। মানে ক্যারোলিনা মারিনকে হারিয়ে অলিম্পিক্স ফাইনাল হারের বদলা।
স্ট্রেট গেমে ম্যাচটা জিতেই সিন্ধুর আকাশের দিকে হাত ছোড়ার মুহূর্তটা শুক্রবার টিভিতে দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল এ বছরেরই উনিশে অগস্টের কথা। যে দিন ক্যারোলিনার কাছে হেরে অলিম্পিক্স সোনা জেতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছিল আমাদের মেয়েটার।
যার পাশে এ দিন দুবাইয়ের ছবিটা বড় মধুর লাগছিল। ম্যাচটা ২১-১৭, ২১-১৩ জেতার পর সিন্ধুর সঙ্গেই ভিড়ে ঠাসা হামদান স্পোর্টস কমপ্লেক্সের গোটা চত্বরটাও যেন গর্জে উঠল!
রিভেঞ্জ!
মারিনের কাছে অলিম্পিক্সের হার নিয়ে সে দিনের পর আর কখনও কথা হয়নি সিন্ধুর সঙ্গে। ওর কোচ হলেও সিন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। ওকে আমি মাঝেমধ্যে একটা স্পেশ্যাল নামে ডাকি। ক্যামেল। উট। ও উটের মতো লম্বা বলে। দুবাই থেকে ফিরলে সিন্ধুকে এ বার বলব— তোকে আর উট ডাকা যাবে না। মারিনকে হারিয়ে তুই উট থেকে এখন জিরাফ হয়ে গেছিস।
পেশাদার সার্কিটে একটা কথা খুব চালু আছে। পাস্ট ইজ পাস্ট। যা হয়েছে ভুলে যাও। সামনের দিকে তাকাও। আমরাও কোচ হিসেবে সেই কথাটাই সিন্ধুদের বলি। যাতে অতীতের কথা ভেবে কোর্টে চাপে পড়ে না যায়।
কিন্তু ওয়ার্ল্ড সুপার সিরিজ ফাইনালসের এ দিনের গ্রুপ লিগ ম্যাচটা দেখতে বসার আগে কোথাও যেন বদলার গন্ধটা, রিও ফাইনালের তারিখটা আপনাআপনিই ভেসে উঠছিল আমার মনে। দুবাইয়ে হয়তো সেটা সিন্ধুর মাথাতেও ছিল। না হলে কোর্টে নামার আগে ওকে কেন প্রচণ্ড তেতে আছে বলে মনে হচ্ছিল আমার? শুরুতে যে জন্য কয়েকটা ভুলও করে বসেছিল।
সিন্ধু-ক্যারোলিনার অলিম্পিক্সের স্কোর ২১-১৯, ১২-২১, ১৫-২১ ও দুবাইয়ের স্কোর ২১-১৭, ২১-১৩
সকালেই ভাবছিলাম ব্যাডমিন্টন ট্যুরের এত বড় টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল উঠতে ক্যারোলিনাকে হারাতেই হবে সিন্ধুকে। ওর বিরুদ্ধে সিন্ধু এমনিতেই ৩-৫ পিছিয়ে। একে এ রকম ডু আর ডাই ম্যাচ, তার উপর সামনে ক্যারোলিনার চ্যালেঞ্জ। এ রকম একটা পরিস্থিতি সামলাতে সিন্ধুর স্ট্র্যাটেজি কী হতে পারে?
ম্যাচটা দেখার পর দুটো জিনিস আমার মনে হচ্ছে। একটা সাইকোলজিক্যাল, আর একটা টেকনিক্যাল স্ট্র্যাটেজি। ক্যারোলিনার প্রতিটা পয়েন্ট নেওয়ার পর চিৎকার করে বিপক্ষের উপর চাপ বাড়িয়ে দেওয়ার সাইকোলজিক্যাল প্রেশার বন্ধ করতে পাল্টা চিৎকারের কাউন্টার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল সিন্ধু। প্রথম গেমের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাই পয়েন্ট পেলেই আগ্রাসী চিৎকার করতে দেখা যাচ্ছিল সিন্ধুকেও। সচরাচর ওর খেলায় যা দেখা যায় না। পরপর পয়েন্ট পেতে শুরু করার পর ম্যাচের পরের দিকে অবশ্য সিন্ধুর হয়ে দর্শকদের চিৎকারই কাজটা করে দিয়েছে। মারিনের স্ট্র্যাটেজি ওখানেই ফেল।
টেকনিক্যাল স্ট্র্যাটেজি ছিল অ্যাটাকিং খেলো আর মারিনকে অনবরত কোর্টে মুভ করিয়ে যাও। যাতে ও দেখেশুনে শট নিতে না পারে। মারিনের মতো চ্যাম্পিয়ন প্লেয়ারদের এক বার সুযোগ আর জায়গা দেওয়া মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা। তা ছাড়া বাঁ-হাতি প্লেয়ারদের কঠিন কঠিন সব অ্যাঙ্গল থেকে শট মারার অ্যাডভান্টেজ থাকে। সেটারও কোনও সুযোগ সিন্ধু দেয়নি মারিনকে। উল্টে যখনই মারিন একটু জায়গা থেকে সরেছে তখনই ফাইনাল শটে র্যালি শেষ করেছে আমাদের মেয়েটা।
অনেকে বলতে পারেন অলিম্পিক্সে যে মারিনকে দেখেছি, দুবাইয়ের মারিন তার তুলনায় ফর্ম, ফিটনেসে সেই জায়গায় ছিল না। প্রথম গেমের পর ব্রেকে মারিনকে বাঁ পায়ে টেপ লাগাতেও দেখলাম। তা ছাড়া গ্রুপে পরপর দুটো ম্যাচ হেরে এ দিন কিছুটা মানসিক চাপেও ছিল মারিন। সিন্ধু সেই সুযোগও নিয়েছে।
আমি কিন্তু এ রকম ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নই। মারিনকে যতই অফ ফর্মে মনে হোক না কেন, তাতে সিন্ধুর কৃতিত্ব এক ফোঁটাও কমছে না। কেননা, ‘র্যালি স্কোরিং সিস্টেম’ মানে যে সিস্টেমে এখন ব্যাডমিন্টন খেলাটা হয় সেখানে ফর্মের উপর সব কিছু নির্ভর করে না। একটা ভুল করলেই সেই পয়েন্টটা প্রতিপক্ষের হয়ে গেল। তাই এখানে আসল কথা হল নিয়ন্ত্রণ। সিন্ধু যেটা দারুণ ভাবে সামলেছে। যদি মারিন খেলার অবস্থাতেই না থাকত তা হলে তো ওয়াকওভার দেওয়ার সুযোগ ছিল। নিল না কেন?
তবে মাঝেমাঝে অবশ্য বেশি তেতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি করে বসছিল ইয়ং সিন্ধু। উত্তেজনায় যেটা হওয়া অস্বাভাবিকও কিছু নয়। তাই সাইডলাইনে বসে থাকা গোপীকে অনেক বার সিন্ধুকে ইশারায় শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করতে দেখলাম।
ফাইনালে উঠতে সিন্ধুর সামনে এ বার কোরিয়ার সুং জি হিউন। যে শুধু এ দিন বিশ্বের এক নম্বর তাই জু-কেই শুধু হারাল না। ওর গ্রুপে তিনটে ম্যাচেই জিতল। যার মানে মারিনকে হারিয়ে এ বার শেষ চারের চ্যালেঞ্জে সিন্ধু কতটা দাপটে জিততে পারে তার উপর নির্ভর করবে ওর অলিম্পিক্সের মতো আবির্ভাবেই সুপার সিরিজ ফাইনালসের ফাইনাল খেলা। তবে এটা নিশ্চিত মারিন-জয়টা ওকে প্রচুর আত্মবিশ্বাস দেবে সেমিফাইনালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy