রিখটার স্কেলে মাপতে হয় এমন মাত্রার ক্রিকেট-ভূকম্পন!
ধোনির কোচ যেমন এ দিন বলে দিলেন, ‘‘ভারতীয় ড্রেসিংরুমের ভেতরকার পরিবেশ মাহির ভাল লাগছে না।’’
বিরাট কোহলির কোচ বললেন, ‘‘কালো রোববার।’’ পড়তে হবে, ধোনির অধিনায়কত্বে কালো রোববারের আগমন।
কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত টিভিতে উত্তেজিত, ‘‘ওহে শাস্ত্রী, কথাটা একটু কম বলো তো।’’
মীরপুরের রবিবাসরীয় মাঝরাত ভারতীয় ক্রিকেটকে আতঙ্কে-ক্ষোভে-সংশয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। দু’হাজার সাত পোর্ট অব স্পেনের বাংলাদেশি দুঃস্বপ্নের পরেও বলার সুযোগ ছিল, একটা খারাপ দিন গেছে। আবার যে দিন দেখা হবে, হারাব। এ বার সেই সুযোগও নেই। পরপর দু’বার এবং ময়দানি ভাষায় দাঁড় করিয়ে হার।
ধোনিকে টিভিতে বলতে শোনা গেল মুস্তাফিজুর সম্পর্কে: রিস্ট স্পিডটা খুব ভাল। একই অ্যাকশনে যে গতির হেরফের করছে বোঝাই যায় না। তাই স্লোয়ারটা এত মারাত্মক হয়ে যায়। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল প্রথম ম্যাচে রান নিতে যাওয়া ধোনির বাঁ হাতি পেসারকে মহাবিতর্কিত বলশালী ধাক্কার চেয়েও তো এটা বেশি জোরালো পাল্টা ধাক্কা। বলছেন কী ধোনি! তিনি ব্রেট লি খেলেছেন। অ্যান্ডারসন খেলেছেন। মালিঙ্গাকে দিনের পর দিন দেখেছেন। কে এক মুস্তাফিজুর দেখে এমন আবিষ্ট হয়ে গেলেন!
ভারতীয় সহ-অধিনায়কেরও কী অবস্থা! যে কোহলি ব্যাটসম্যান হিসেবে ভারতের সর্বকালের সেরা ওয়ান ডে টিমে ঢুকে যাবেন, তিনি কিনা কাল ফ্রি হিট পেয়েও ডিফেন্স করলেন। নিউটন জন্মানোর পর এমন আজব কিছু বিশেষ ঘটেনি!
ভারতীয় ওয়ান ডে দৃষ্টিভঙ্গিতেই আসলে প্রকাশিত হয়েছে একটা অসাড়তা। ভারত যেন ধরেই নিয়েছিল তারা ঢাকায় নামবে, খেলবে, জিতবে। যেন টগবগে এবং ফিটনেস-রূপান্তরিত একটা টিমকে নিজের মাঠে ওয়ান ডে-তে হারানোটা কলকাতায় ভীমনাগের দোকান থেকে সন্দেশ কেনা! বা ঢাকায় নেমে তার বিখ্যাত রেস্তোরাঁ কস্তুরীতে চিতল মাছ অর্ডার দেওয়ার মতো সহজ!
উপমহাদেশে যে ওয়ান ডে টেকনিক, রান তাড়া করার ধরন ও বোলিং স্টাইলের সাম্প্রতিক নানা মডেল তৈরি হয়েছে। মাশরফির এই বাংলাদেশ যে সেগুলো মেনেই পাকিস্তানকে ৩-০ হারিয়েছে, মনে হয় না টিমের ভিডিও অ্যানালিস্টেরও সে সব দিকে নজর ছিল।
শ্রীনির আমলে ধোনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে একমেবদ্বিতীয়ম। টিমের জার্সির কী রং হবে থেকে শুরু করে কে মিডিয়া ম্যানেজার হবে। ডানকান ফ্লেচার থাকবেন কি না? যুবরাজকে নেওয়া হবে কি না? সব ঠিক করেছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষমতার হাই-স্পিড ইন্টারনেটে অভ্যস্ত তিনি গত পাঁচ বছর। যখন ইচ্ছে লগ-ইন করেছেন। যাকে ইচ্ছে ইনবক্সে ঢুকিয়েছেন। যাকে ইচ্ছে ডিলিট করেছেন। ক্ষমতা হ্রাসের নতুন জমানায় কি স্লো নেটওয়ার্ক পেয়ে মাথা ঠিক থাকছে না তাঁর?
নইলে সিরিজের প্রথম যে ম্যাচটা তিনশো রান তাড়ার জন্য তাঁর চার নম্বরে যাওয়া উচিত ছিল সেটায় গেলেন নীচে। আর যেটা প্রথম দিকে ব্যাটসম্যানরাই টার্গেট তৈরি করতে পারে, সেখানে রাহানেকে বাদ দিয়ে নিজে চারে। ধোনি তিনে বা চারে উন্নীত হয়ে যে টিম ইন্ডিয়াকে প্রচুর ম্যাচ জিতিয়েছেন তা নিয়ে সিসিডির কফি আড্ডাও হওয়ার উপায় নেই। ব্যাপারটা এতই অভ্রান্ত।
দু’হাজার এগারোর বিশ্বকাপ ফাইনাল তো থেকেই যাবে সবচেয়ে বড় মণিহার হয়ে! অথচ মোহনদাস মেননের মতো জাঁদরেল স্ট্যাটিস্টিশিয়ানরা জানিয়ে দেবেন, গত তিন বছর সেই ধোনি একটা ম্যাচেও নিজেকে ওপরে তোলেননি। সেটা ছিল আনুগত্যের ফ্লেচার-জমানা। কোচের সাহসই ছিল না ধোনিকে বলার, তুমি উপরে যাও। শাস্ত্রী আসার পরেও শুরুর দিকে বদলায়নি। নইলে ভারতীয় ক্রিকেটের অলিন্দে এই আলোচনাটা আজও চলত না যে, সিডনির বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ধোনি আগে নামলে ভারতের অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সুযোগ ছিল।
আলোচনাটা কানে যাওয়া রবি শাস্ত্রী সে দিন বলছিলেন, ‘‘বোগাস। ওয়াংখেড়ে আর এসসিজি এক নাকি? পরিস্থিতি, পরিবেশ, প্রতিপক্ষ সব আলাদা।’’ শাস্ত্রী যা-ই বলুন, আলোচনাটা যে অদৃশ্য হয়ে যায়নি, দ্বিতীয় ওয়ান ডে-র ব্যাটিং অর্ডার দেখেই বোঝা গেল। যেটা বোঝা গেল না, ধোনির তা হলে নিজেকে নিয়ে ব্যাটিং স্ট্র্যাটেজিটা কী? এ তো চিন্তার কোনও ধারাবাহিকতাই থাকছে না।
একটা খারাপ সময়ের আবর্তে পড়া টিমের যা যা বৈশিষ্ট্য, গত চার দিনে পদ্মাপারের ভারতের মধ্যে মোটামুটি তার সব ক’টা ডিশ আছে। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের দিনের মতোই তার ক্রিকেটমহলে চিরস্মরণীয় থাকা উচিত জুনের এই একুশে! যা উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে গোলিয়াথ-সদৃশ ভারতকে ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও এমন প্রশ্ন, আতঙ্ক আর কোন্দলজীর্ণ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।
অবাক লাগল ‘মওকা মওকা’ বলে বিদ্রুপের চেয়ে বাংলাদেশি সমর্থকেরা আরও নুনের ছিটে দেওয়া প্ল্যাকার্ড কেন ব্যবহার করলেন না, মাহমুদউল্লাহ— আমাদের সেরা ওয়ান ডে ব্যাট ছাড়াই তোদের বুড়িগঙ্গায় ফেললাম রে।
দেশজ ক্রিকেটমহলে ললিত মোদীকে ভুলে গিয়ে সোমবার দিন জুড়ে চলল এই জল্পনা যে, ধোনিকে কি আর অধিনায়ক রাখা উচিত? অবাক প্রশ্ন— এক্ষুণি ধোনি সরবেন কেন? এই তো সে দিন বিশ্বকাপে ন’টায় আটটা ম্যাচ জিতেছে তাঁর টিম ইন্ডিয়া। শাস্ত্রীকেও সময় দেওয়া উচিত বাংলাদেশের পরেই হঠাৎ বিদায় না দিয়ে। তা বলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ওয়েবসাইট কী করে লেখে, ধোনি ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অবধি অধিনায়ক থাকছেনই। এর মধ্যে কঠিন শ্রীলঙ্কা সফর আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা আছে। পাকিস্তান আছে খুব সম্ভবত। এই একটা মীরপুর বিপর্যয়েই যা হাল, আর একটা বড় সিরিজ বিপর্যয়ে ধোনির অধিনায়ক ভাগ্য কাঠমাণ্ডুর সেই বাড়িগুলোর মতো দেখাতে পারে।
মুশকিল হল কে রিখটার স্কেলে কত মাত্রায় পড়বে, কে সেটা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে হাইওয়ে ধরে চলবে, সেটা মাপবে কে? বোর্ড বলেছিল তিন সদস্যের অ্যাডভাইজরি কমিটি হবে সর্বক্ষমতাসম্পন্ন। সচিন-সৌরভ-লক্ষ্মণই নাকি ঠিক করবেন সব কিছু। টিমের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান। প্রতিশ্রুতির তিন সপ্তাহের মধ্যেই এটা আপাতত রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনী ভাঁওতাবাজির পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
কমিটির সদস্যরা ঢাকা-বিপর্যয় বিশ্লেষণ করতে হলে বোর্ডের তো ইতিমধ্যে তৎপর হওয়া উচিত। একটা উটকো কাগজে ভুল বার হলে দ্রুত বোর্ড প্রেসিডেন্টের আলিপুরের বাড়ি থেকে বিজ্ঞপ্তি আসে। ইদানীং তাঁর এটাই স্টাইল। মুখে বলেন না, বিজ্ঞপ্তি দেন। তা এত বড় হারের পর বিজ্ঞপ্তি কোথায়? উপদেষ্টা কমিটিকেও তো কিছু জানানো হয়নি। সোমবার খোঁজ নিয়ে জানলাম, এর মধ্যে সচিন ইউরোপে। জানিয়ে দিয়েছেন, বছরে দু’সপ্তাহের বেশি কমিটির জন্য সময় দিতে পারবেন না। লক্ষ্মণ— তিনি হায়দরাবাদে। ফোন বেজে গেল। সৌরভ? সকালে ট্রেডমিলে ওঠার আগে জানালেন, তাঁকে কেউ কিছু বলেনি। নিজেদের টার্মস অব রেফারেন্সও জানেন না যে ক্ষমতার আওতা কতটা।
ভারত যে ওয়ান ডে বিবর্তনে পিছিয়ে গিয়েছে, তার যে আগামী মাসে সঙ্গকারার দেশে যাওয়ার আগে স্মার্ট কিছু সংস্কার দরকার, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু উপদেষ্টা কমিটি সেটা নিয়ে বসবে কী করে যদি তাদের স্রেফ সোনার দোকানের শো-কেস করে রেখে দেওয়া হয়!
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবশ্য এই বিপর্যয়ে সামান্য স্বস্তির নীল মেঘ দেখা উচিত। তিনি টিম ডিরেক্টর হিসেবে বাংলাদেশ গেলে আজকের আলোচনাটা কোথায় দাঁড়াত, সবাই জানে। এই যে সৌরভ ঢুকল...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy