ইডেনে কুম্বলের সান্ত্বনা কেদার যাদবকে। ছবি:উৎপল সরকার
ইংল্যান্ড ৩২১-৮ (৫০ ওভার)
ভারত ৩১৬-৯ (৫০ ওভার)
একশো একান্নটা ব্যাপারে মতভেদ থাকতে পারে রবি শাস্ত্রী আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে! রোববার বিকেলে কিন্তু দু’জনে আশ্চর্য একমত হয়ে যাচ্ছেন, ৩২২ এই পিচে দুঃসাধ্য।
এঁদের ঠিক প্রমাণ করে গোটা ভারতের হৃদপিণ্ড বিরাট কোহালি আউট হয়ে গেলেন সওয়া সাতটায়। যুবরাজ সাতটা ছত্রিশে। পরের পঁচিশ মিনিটে ধোনি। ছাপ্পান্ন হাজারের ইডেন থেকে বেশ কিছু মুখকে যে হালকা হয়ে যেতে দেখলাম, তার মধ্যে এতটুকু অস্বাভাবিকত্ব নেই। জেতার জন্য ১৪৯ যে ১১০ বলে চাই। হাতে মাত্র পাঁচ উইকেট।
কে জানত, শেষ ওভার যখন শুরু হবে, ইডেনের সঙ্গে গোটা ভারত রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্স নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। টি-টোয়েন্টিতে যার নামকরণ হয়েছে সরবিট্রেট সিচুয়েশন। শেষ ওভারে টিম ইন্ডিয়ার জেতার জন্য চাই ১৬ রান। স্ট্রাইকার কেদার যাদব। ও দিকে ভুবনেশ্বর কুমার।
হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে যখন ক্রিস ওকস দৌড় শুরু করলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বেন স্টোকসের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। ঠিক ন’মাস আগে এই প্রান্ত থেকে হাতে ১৯ রান নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিতে পারেননি। সে দিনের কার্লোস ব্রেথওয়েট কি আজ হয়ে দাঁড়াবেন কেদার যাদব?
প্রথম দুটো বলের একটা ছয়। একটা চার। কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম ইডেনে তা হলে ইংল্যান্ডের বড় হারের হ্যাটট্রিক হচ্ছে। মাইক গ্যাটিংয়ের সাতাশি সালের রিভার্স সুইপ থেকে আজকের ওয়ান ডে হার। ভারতের জেতা তখন মাত্র চার বলের অপেক্ষা। করতে হবে ৬ রান। এলেবেলে টার্গেট বললেও কম বলা হয়। এ বার দুটো বল অফস্টাম্পের বাইরে চমত্কার ইয়র্কার। ডট হয়ে গেল। ৭৫ বলে বিধ্বংসী ৯০ রানে বাস করা কেদার ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেন না। থাকল বাকি দুই। ধোনি-কোহালি সহ গোটা ভারতীয় টিম তখন বেরিয়ে এসেছে ড্রেসিংরুমের বাইরে। ক্যাপ্টেন হিসেবে যাঁর চোখেমুখে কখনও উত্কণ্ঠা দেখা যায়নি, সেই ধোনিকে অবধি দেখে মনে হচ্ছে নার্ভাস।
কপিলের বাহবা। রবিবার ইডেনে কেদার যাদব। ছবি:উৎপল সরকার
ঠিক এই সময় ইডেনে চূড়ান্ত অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স তৈরি করে কেদার আউটফিল্ডে আউট হয়ে গেলেন। নতুন প্রশ্ন, ভুবনেশ্বর কুমার কি শারজার জাভেদ মিয়াঁদাদ হতে পারবেন? চাই তো একটা ছক্কা। এখনকার ক্রিকেটে সেটা আর এমন কী? গড়িয়াহাট বাজারের নববর্ষের সেলের মতো স্বাভাবিক। অথচ শেষ বলটাও ছোঁয়ানো গেল না। সেই অফস্টাম্পের বাইরে চমত্কার ইয়র্কার লেংথ।
ভুবনেশ্বরদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দুর্দান্ত ভাবে কেদার-হার্দিক ৭০ বলে ১০৪ রানের পার্টনারশিপটায় চোনা ফেলে দিলেন রবীন্দ্র জাডেজা। ওই সময় কেদারকে তিনি স্ট্রাইক দিয়ে গেলে ম্যাচ বেরিয়ে যায়। জাডেজার উইকেটটাই টার্নিং পয়েন্ট।
এমনিতে সিরিজ ফয়সালা মহানদীর ধারেই গত বিষ্যুদবার হয়ে গিয়েছিল। গঙ্গাপারের লড়াই ছিল নিছক মর্যাদাযুদ্ধ। তবু অঙ্কের বিচারে সেই নিয়মরক্ষার কারবারে মরিয়া ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কিছু থেকে যায়।
আর সেটা ইংরেজদের এ মাঠে প্রথম ওয়ান ডে জেতা। বা কোহালির অধিনায়ক হিসেবে ভারতের মাঠে প্রথম হারা নয়। প্রেক্ষিতটা হল পাঁচ বছর আগে ইডেন মাঠে ইংরেজদের কাছে সমর্পিত হয় ঘরের মাঠে ভারতের অনন্য টেস্ট সিরিজ রেকর্ড। সিরিজ এখানে ১-২ হয়ে যায়। ক্রিকেটীয় নিক্তিতে কলকাতা থেকে ১৮১ কিলোমিটার দূরের প্রান্তরে ঐতিহাসিক হারের মতো। সিরাজদৌল্লার সূর্যাস্তের মতো বিসর্জিত হয় দেশের মাঠে এত বছর রাজ করার কোহিনুর।
ব্যাটসম্যান কোহালি কত ইতিহাস তৈরি করছেন, কোনও ঠিকানা নেই। কিন্তু ক্যাপ্টেন কোহালি টেস্টে ৪-০-র পর ওয়ান ডে-তেও সাহেবদের ৩-০ গুঁড়িয়ে সর্বাত্মক ব্রাউনওয়াশের সুযোগ হারালেন।
ভারতের আর সব স্টেডিয়ামে চিত্কার হয় ‘বি-রা-ট, বি-রা-ট’। ইডেন সকাল সাড়ে এগারোটায় ভারত অধিনায়ক মাঠে পা দেওয়া থেকে ব্যাতিক্রমী চেঁচিয়ে গেল ‘কো-হা-লি, কো-হা-লি’। ব্যাটসম্যানশিপে তিনি সচিন তেন্ডুলকরকে ছুঁয়েছেন কি না, সময় বলবে। ভবিষ্যৎ বলবে। জনপ্রিয়তায় যে এখনই সমকক্ষ, প্রায় ভরা ইডেনের হার্টবিট বারবার তা উপুড় করে দেখাল। খুশিতে ভিজিয়ে দেওয়া সেই প্রাথমিক অভ্যর্থনার কিছু পরে কোহালি টস জিতলেন এবং ফিল্ডিং নিলেন।
দুটো যুক্তি ধরে নেওয়া যায় সেই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। এক, রান চেজে নিজের অরণ্যদেবোচিত ভাবমূর্তি। দুই, ইডেনের শিশির। কটকে সদ্য-সদ্য শিশিরস্নাত বল এমন ভুগিয়েছিল যে, ৩৮১ হাতে নিয়েও ভারতীয় ড্রেসিংরুম নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি।
টিমে কেউ বোঝেনি মহানদী আর গঙ্গার পাড় যে প্রকৃতিগত ভাবে এত আলাদা! ভুবনেশ্বর কুমারের মতো অকৃত্রিম নিরামিষাশী পেসারের প্রথম ওভারেই বল এত লাফাচ্ছিল যে, ধোনি প্রায় আঠারো গজ পেছনে চলে গেলেন। কোহালি ব্যাট করতে এসে দেখলেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে দুই স্লিপ ও গালি। আসলে প্রথম ওভারেই ইংল্যান্ড বুঝে গিয়েছিল, আজ তিনশোর ওপর রান তুললে ব্রেথওয়েটের দুঃখ ভোলা যাবে।
তখনও কেদার যাদব নামে কেউ ম্যাচের ওপর ছায়া ফেলবেন, কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। কোহালি এবং একমাত্র কোহালিই ভরসা। রান চেজে যাঁর গড় এখন ৬০। এমন অবস্থা যে, গুগলে গিয়ে রান চেজ টাইপ করলে কোহালি নামটা চলে আসছে।
ব্যাটসম্যান কোহালির জন্য ভাগ্য সুযোগও খোলা রেখেছিল। প্রথম তিন ব্যাটসম্যান রান না পেয়ে তাঁকে ধারাবাহিক ভুগিয়ে যাচ্ছেন। অজিঙ্ক রাহানে সিরিজে প্রথম সুযোগ পেয়ে যে ফুটওয়ার্ক দেখালেন, তা মনে করিয়ে দিল ধোনি-সৌরভের আজকের করমর্দন-শৈত্য। যেখানে হাত কোনও রকমে কাছে। পা বেশ দূরে। যাক গে যাক। কোহালি সবে খেলাটা ধরেছেন। জনতার অ্যাড্রিনালিন টপ গিয়ারে পৌঁছচ্ছে। ঠিক এই সময় নবঘোষিত চারটে ব্লকের মধ্যে পঙ্কজ রায় স্ট্যান্ডের সামনে জেক বল দু’হাতে ধরে তাঁর মিসটাইমড পুল ফেলে দিলেন। ভারত অধিনায়ক তখন ৩৭। দ্রুত মনে পড়ে গেল বঙ্গসন্তানের একমাত্র ক্যাপ্টেন্সি করা লর্ডস টেস্টে এমনই গপ্পা ক্যাচ ফেলার জন্য পলি উমরিগড়কে সারা জীবন ক্ষমা করেননি পঙ্কজ। তাঁর মনে হয়েছিল কেন ব্যারিংটনের ক্যাচটা ইচ্ছাকৃত ফেলা হয়েছিল। যাতে অধিনায়ক পঙ্কজ সফল না হন।
তার ফায়দা তুলতে না পেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই কোহালি আউট হয়ে গেলেন অফস্টাম্পের অনেক বাইরে এমন একটা ডেলিভারিতে, যেটা পঙ্কজের ভাষায় ফালটুস। ৬৩ বলে ৫৫-র পর ম্যাচের তখনই সমাধি ঘোষণার কথা। লোকে তবু ভাবছিল ধোনি-যুবরাজ আছেন। লড়াইও আছে।
লড়াইটা যে হার্দিক-কেদার দেবেন, সেটা কারও মাথায় এসেছিল বলে মনে হয় না। ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন সবচেয়ে বেশি স্কোরিং শট হয়ে দাঁড়িয়েছে পুল। আগে ভারতীয় ক্রিকেটে বিজয় মঞ্জরেকরের মতো দু’একজন ছাড়া কেউ পুলই মারতে পারতেন না। এমনকী গাওস্করেরও স্কোরিং শট ছিল না। ভারতের ব্যাটিং ব্যাকরণ ঠিক করত মুম্বই। যেখানে পুলের প্রয়োজন হত না। ব্যাটসম্যান রান করত ড্রাইভ, কাট বা ফ্লিকে। প্রয়োজন হলে হুক।
টি-টোয়েন্টি জেনারেশন সর্বস্তরে শুধু পুল আনেনি। সেগুলো খেলা হচ্ছে অফস্টাম্পের দু’গজ বাইরে পিচ করা ডেলিভারিতে। একত্রিশ বছরের কেদার আজ হয়তো জেতাতে পারলেন না। কিন্তু ফিনিশার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত যে তাঁর ওপর ভরসা করতে পারবে, সেই হাই-স্পিড ওয়াই-ফাই সিগন্যাল দিয়ে গেলেন।
ম্যাচ শেষে সৌরভের হাত থেকে সিরিজ জয়ের ট্রফি নিলেন কোহালি। ফটোগ্রাফারদের সামনে পোজও দিল গোটা টিম। কিন্তু তারই মধ্যে দৃশ্যমান ভারী বিষণ্ণতার ছোঁয়া।
কোথায় ব্রাউনওয়াশ হবে। মর্যাদার ইতিহাস দেখবে ইডেন। তা নয়, ইতিহাস যে তাকে একুশ বছর আগের অভিশপ্ত সন্ধ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দিল। সেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও তো টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। আজকেরটা নকআউট ছিল না। উল্টে সিরিজ জয়ে শেষ হল। কিন্তু কোহালি জানেন, হার তো হারই। বিজিতকে পৃথিবী মনে রাখে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy