ধর্ম ও চরিত্র বিচারে বেঙ্গালুরুর কিছু জিনিস বদলেছে। কিছু বদলায়নি।
কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঢোকার রাস্তাটা যেমন। হাইওয়ের দু’পাশে তাকালে এত সবুজ আর ছিমছাম দৃশ্যপট চোখে পড়বে যে, শহরটা ভারতবর্ষেরই অন্তর্গত, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না। ঝাঁ চকচকে রাস্তা। দু’দিক ফুলগাছে সজ্জিত। কিন্তু ওই যে, সামনে! সোজাসুজি তাকালে দৃষ্টিসীমানায় গাড়ির অন্তহীন সমুদ্র ছাড়া আর কিছু চোখে পড়বে না। এটা বেঙ্গালুরুর বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম, যা আজও বদলায়নি। এয়ারপোর্ট থেকে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম পৌঁছতে লাগছে ঝাড়া দু’ঘণ্টা।
বেঙ্গালুরুর বরং পাল্টেছে আবহাওয়া। এত দিন রাহুল দ্রাবিড়ের শহর সম্পর্কে সার্বিক ধারণা ছিল যে, দাক্ষিণাত্যের এই ভূখণ্ড প্রাকৃতিক ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। চড়া রোদের ব্যাপার বিশেষ নেই, ভোরের দিকে প্রয়োজন পড়ে চাদরের। কিন্তু বর্তমান শহরের তাপমাত্রার যা অবস্থা, শিরোনামযোগ্য। গত দু’সপ্তাহ ধরে তো সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ চলছে!
বেঙ্গালুরু শহরের মতো চিন্নাস্বামীও তার পিচের চরিত্র বদলেছে। এবং আগামী পরশুর চিন্নাস্বামী যদি আচমকা ঘূর্ণির জন্য শিরোনামযোগ্য হয়ে ওঠে, আশ্চর্যের থাকবে না। এত দিন চিন্নাস্বামী উইকেট মানে ছিল বিশুদ্ধ পাটা। আইপিএলে গেইল-সংহার যে উইকেটে নির্বিঘ্নে সংগঠিত হয়। কিন্তু সোমবার দুপুরে চিন্নাস্বামীতে গিয়ে শোনা গেল, তিনটে স্ট্রিপের মধ্যে বিশ্বকাপে দু’টো ব্যবহার হচ্ছে। একটায় এ দিনের বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা হল। যেখানে দু’টো টিমেরই স্পিনাররা গোটা তিনেক করে পেলেন। দ্বিতীয়টায় শোনা গেল টার্ন আরও বেশি। বল নাকি ঘুরবে আরও বেশি।
বুধবার যেটায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নামছে ভারত।
সরকারি বক্তব্যের সিলমোহর এর উপর অবশ্যই নেই। দক্ষিণাঞ্চলের হেড কিউরেটর তো কিছুতেই স্বীকার করতে চাইলেন না চিন্নাস্বামী উইকেট তার অতীত ধর্ম থেকে সরে আসবে বলে। কিন্তু সরকারি বক্তব্য সব সময় যে সত্যি বলে না, রবিবারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচই প্রমাণ। স্যামুয়েল বদ্রী নামের ক্যারিবিয়ান স্পিনার যেখানে একা ধ্বংস করে দিয়েছেন লঙ্কাকে। কেএসসিএ কর্তাদেরও কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল পিচ যা হয়েছে, ভারতের পছন্দই হবে। নাগপুর বা ইডেনের মতো অতটা না হলেও যে ঘূর্ণির বন্দোবস্ত আছে, তাতে একটা সাকিব আল হাসান দিয়ে অশ্বিন-জাডেজাদের মহড়া নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না।
পিচ দেখতে বা প্র্যাকটিস করতে ভারত এ দিন অবশ্য মাঠে এল না। সকালের দিকে খবর ছড়িয়েছিল বটে যে, গোটা দিনটা ফাঁকা থাকায় জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির নেটে এক বার ঘুরে যেতে পারেন রোহিত-রায়নারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অজিঙ্ক রাহানে বাদে আর কাউকে দেখা যায়নি। বরং সোমবার গোটা দিন ভারতীয় দল ডুবে থাকল অদ্ভুত সব কাজকর্মে। জিম সেশন, পুল সেশন ছিল যেমন থাকে। কিন্তু সঙ্গে আরও একটা জিনিস ছিল, এর আগে যা দেখা যায়নি।
কিম্ভূতকিমাকার এক অ্যাপ। যা দিয়ে অনায়াসে লোকের মুখ পাল্টে ফেলা যাচ্ছে। রোহিত শর্মা চকিতে নিজেকে আয়রন ম্যানে রূপান্তরিত করে ফেলছেন! শিখর ধবনের শরীরে অনায়াসে বসিয়ে ফেলা যাচ্ছে হরভজন সিংহের মাথা! টিমের লজিস্টিকস ম্যানেজারকে ঢেকে ফেলা যাচ্ছে বিদঘুটে সব পোশাক-আশাকে! রাতের দিকে টুইটারে যা ছেড়ে দেওয়া হল।
টিম ইন্ডিয়া যদি ডুবে থাকে নতুন অ্যাপে, তা হলে গোটা ভারতবর্ষ এখনও মোহাচ্ছন্ন মাত্র এক জনে। তিনি বিরাট কোহালি। ইডেনে যাঁর প্রায় একা হাতে পাকিস্তান বধ এখনও দিগ্বিদিক মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
উত্তরের বিষেণ সিংহ বেদী। পশ্চিমের দিলীপ বেঙ্গসরকর। দক্ষিণের এরাপল্লী প্রসন্ন। কেউ বাদ নেই। আর নয়াদিল্লির বিকাশ কোহালির সঙ্গে কথা বলে তো মনে হল তিনি এখনও ইডেনের কর্পোরেট বক্সে বসে আছেন!
পরিচয়ে ইনি বিরাট কোহালির দাদা। যিনি সন্ধেয় ফোনে আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “ওর ব্যাটিং সামনাসামনি দেখতে চাই না। এত টেনশন হয় যে পরে হাইলাইটস দেখে নিই। ইডেনে নিজের চোখে দেখলাম। এখনও ভুলতে পারছি না। ভারত-পাকিস্তানের মতো ম্যাচের চাপ ও যে ভাবে নিয়ে নিল, ভাবা যায় না।” আর ম্যাচ জেতানোর পর বিরাট কী বললেন তাঁকে? “ওকে কনগ্র্যাচুলেট করতে গিয়েছিলাম। প্রথমেই বলল কী, মজা পেলে ইনিংসটা দেখে! আমি ঠিক করে রেখেছি ভারত ফাইনালে উঠলে আবার ইডেনে যাব। ওর হাতে কাপ দেখতে যাব।”
দিলীপ বেঙ্গসরকরের মতো দুঁদে প্রাক্তনকেও দেখা গেল বিরাট-মায়ায় নিমজ্জিত। মুম্বই থেকে ফোনে বলছিলেন, “চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা আছে বটে ছেলেটার! ওয়ার্ল্ডস বেস্ট এখন। বিরাট ঠিকই বলে। চাপ যত বাড়ে, তত দেখছি ও নিজের খেলাটা আরও উঁচুতে নিয়ে যায়।” এরাপল্লি প্রসন্ন এখন শুধু বিরাট যুগকে উপভোগ করতে চান। আর বিষেণ সিংহ বেদী? পাকিস্তান-বধের পর বিরাট কোহালি তাঁর কাছে কমব্যাট সোলজার। এক যোদ্ধা। “ওকে দেখে মনে হয় সীমান্তে লড়ছে। ক্রিকেট নয়, যুদ্ধে নেমেছে। আমার কেন, কারও সার্টিফিকেটই দরকার নেই ওর। আশা করছি, ফাইনাল পর্যন্ত বিরাট এই ব্যাটিংটা করে যাবে।”
শুনলে একটাই কথা মনে হবে। ক্রিকেটের বিশুদ্ধবাদীদের কাছে আইসিসি টুর্নামেন্টে নাগাড়ে টার্নার প্রাপ্তি আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। কিন্তু দেশের ক্রিকেট-সমাজের মন আটকে এক জনে, ঠোঁটে একটাই প্রার্থনা।
৩ এপ্রিলের ইডেন পর্যন্ত এ ভাবেই চলুক। চলুক মেহফিল-ই-কোহালি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy