সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যে স্থানীয় ক্রিকেট প্রশাসনের শীর্ষে এসে চমকপ্রদ কাজকর্ম করছেন তা নিয়ে বিশেষ দ্বিমত নেই। ইডেনে ভারত-পাক ম্যাচের পর তো সৌরভের প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়ে এমন ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছে যে আগামী জুলাইতে সিএবি নির্বাচন তাঁর বিরুদ্ধে যদি কেউ প্রার্থী হন, তিনি নিঃসন্দেহে কলকাতার সবচেয়ে বড় সাহসী।
কিন্তু তাঁর একটা ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত জঙ্গি সৌরভ সমর্থকেরও অসহ্য মনে হয়েছে, মুথাইয়া মুরলীধরনকে ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে আনা।
মুরলীর স্বপক্ষে বলা হয় সামান্য অঙ্গ বিকৃতির জন্য কনুইটা এত বাঁকা। যেটাই কারণ হোক ওই বিকৃতি তাঁকে যে চিরকাল অনেক সুবিধে এনে দিয়েছে এবং আদতে তিনি চাকার তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ আছে কি? যে নিজেই চাকার সে আর বাংলার ফুটফুটে বাচ্চাদের কী করে ক্লিন অ্যাকশন শেখাবে? হ্যাঁ সে সিনিয়র বাংলা টিমের সঙ্গে থেকে বড় পর্যায়ের ক্রিকেটে কী ভাবে ব্যাটসম্যানের মন পড়তে হয়, কী ভাবে নিজের ফিটনেস-স্ট্যামিনা ধরে রাখতে হয় সেটা অবশ্যই বলতে পারে। কিন্তু দোহাই উঠতিদের জন্য নয়।
এক একসময় অবাক লাগে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে শৃঙ্গে বসে রয়েছেন মুরলী। বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে আর উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের সম্ভাব্য পিন আপ বয় সুদর্শন তাসকিন আহমেদ কিনা চাকার!
আইসিসির এই চাকার ধরার পদ্ধতিটা এতটাই অস্পষ্ট যে তার ভিত্তিতে শার্লক হোমসও প্রকৃত অপরাধী বার করতে পারতেন না। তাসকিন যদি চাকার হন মালিঙ্গা তবে কী? ক্রিকেটের দেবদূত? তার পর এই যে অদ্ভুত নিয়মটা পনেরো ডিগ্রি পর্যন্ত কনুই বাঁকানো যাবে, কেন যাবে? দশ ডিগ্রিতেও তো আনায় সুবিধে।
আশির দশকে স্থানীয় কলকাতার ক্রিকেটে মোহনবাগানের এক ক্রিকেটারকে নিয়ে ক্ষোভ নিয়ত লেগে থাকত। তাঁর নাম প্রণব নন্দী। অন্য বড়় টিমগুলো নিয়মিত অভিযোগ করত। লেগ স্পিন করার সময় তিনি কনুই ভাঙেন এবং তারপর তাঁকে আর খেলা যায় না। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন প্রণব কলকাতা সার্কিটে। কিন্তু বাংলা দলে তাঁকে নেওয়া হত না স্রেফ এই ভয়ে যে, বিপক্ষ অ্যাকশন নিয়ে আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। মোহনবাগানের অধিনায়ক এবং সর্বেসর্বা তখন অরুণলাল। প্রণবের হয়ে একা লড়তেন অরুণ। এটা জেনেই যে এই তর্কে তিনি কোনওদিন জিতবেন না।
ক’দিন আগে অরুণের সঙ্গে দেখা হতে মুচকি হেসে বলেন, “ইস টুলটুল(প্রণব) এখন খেলেন না। খেললে আজ ইন্ডিয়ার এক নম্বর বোলার হত।” অরুণের কথা থেকেই বিশ্বক্রিকেটের আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসছে।
শোয়েব আখতার তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন তাঁর বলে সচিনের চোখে মুখে তিনি একবার ভয় লক্ষ্য করেছিলেন। ভারতে বিশাল তোলপাড় হয়েছিল সেই মন্তব্য ঘিরে। সচিন ভক্তরা গর্জে উঠেছিলেন সাহস কত শোয়েবের!
আমার মতে, শোয়েব সত্যি বলেছিলেন। সচিন চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়েছিলেন ফয়সলাবাদের ওই ইনিংসে। কিন্তু শোয়েব যেটা বলেননি তা হল ঠিক ওই সময় ভারতকে অল আউট করার উদগ্রতায় তিনি কাচা ছুড়ছিলেন। এমনিতেই বলের গতি ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার ছোড়াতে তা ১৬৫-১৭০ এ চলে যাচ্ছিল। মনুষ্য কী করে ম্যানেজ করবে ওই গতি? তাও তো ধোনি রুখে দাঁড়িয়ে অসাধারণ সেঞ্চুরি করেছিলেন।
সারমর্ম— চাকিং বহু বছর ধরে চলছে। হঠাৎ হঠাৎ নতুন নতুন নাম বাজারে আসে। পুরনো পাপীদের বেকসুর খালাস দিয়ে। যেমন তাসকিন। কাল রাতে টিভিতে বাংলাদেশের অনবদ্য বেঙ্গালুরুর লড়াই দেখতে দেখতে ভাবছিলাম একটা টিম তামিম ছাড়া, তাসকিন ছাড়া কী অসামান্য লড়াই দিচ্ছে। এই লড়াইটার বীজ অবশ্যই মাশরাফি। তিনি অধুনা বাংলাদেশ ক্রিকেটার মাইক ব্রেয়ারলি। প্লেইং ক্যাপ্টেন যাঁর ভূমিকা নিছক স্কোর দিয়ে বিচার হবে না। লিডারশিপটাই তো একটা পারফরমেন্স। কোনও সন্দেহ নেই শ্রীলঙ্কা যেমন নব্বইয়ের দশকে বিশ্ব ক্রিকেটে উদিত শক্তি ছিল। আগামী দশ বছর বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেই সময়!
সমস্যা হল যে, কোনও দেশের ক্রিকেট শক্তি শুধু তার ক্রিকেটারে সমৃদ্ধ নয়। একটা মাল্টিস্টোরিড বাড়ি দাঁড়াতে যেমন চুন লাগে, বালি লাগে, সিমেন্ট লাগে, ইস্পাত লাগে তেমনি দেশের ক্রিকেট সমৃদ্ধ করতে গেলে জড়ো করতে হয় ভাল ক্রিকেট টিম, শক্তিশালী ক্রিকেট মিডিয়া এবং অবশ্যই জাঁদরেল কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তা নেভি বা আর্মি চিফের মতোই দেশের ক্রিকেটের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সেই মাপের ক্রিকেট কর্তা কোথায় যাদের আইসিসি সম্মান করে। মুস্তাফা কামাল, সেই শ্রীনিবাসন অধ্যুষিত আইসিসিতেই প্রচুর আওয়াজ তুলেছিলেন কিন্তু এখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেটে তিনি ব্রাত্য। সাব্বির হোসেন চৌধুরীকে একটা সময় মনে করা হচ্ছিল বাংলাদেশের উজ্জ্বল তারা। তিনিও অধুনা নেই। নেই সৈয়দ আশরাফুল হক যাঁকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সমাজ শুধু চেনেই না যথেষ্ট সম্মান করে। এরা আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে কাজে লাগানো ক্রিকেট কর্তাদের কাজের মধ্যে পরে। সব সময় যে চাপ নিজের দেশ থেকে তৈরি হলে কাজ হবে তার কোনও মানে নেই। যে যত ভাবে নিয়ামক সংস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে সে তত তাড়াতাড়ি বিচার পাবে। এটা পৃথিবীর নিয়ম— আইসিসিরও।
বাংলাদেশের এখনকার বোর্ড,শাসকদের সম্পর্কে যা সব গল্প গাছা শুনি, তার অর্ধেকও যদি সত্যি হয় ঘোর উদ্বেগজনক। মাশরাফিরা এত দিন টানা ভাল খেলছিলেন বলে এরা সেই আলোয় আলোকিত হচ্ছিলেন। এখন তাসকিনের জন্য বিচার চাইতে যাওয়ার সময় এদের প্রকৃত মুরদ ধরা পড়ছে।
আমি গত দু’বছর বাংলাদেশে গিয়ে অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। আলাপ করেছি। বোর্ড প্রধানকে আমি বা আমরা কখনও পাইনি। তাই জানার উপায় হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা কোন স্তরে বইছে। তাসকিন নিয়ে এই সঙ্কট কেন জানি না। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘকালীন উপকার করবে।
এটা দেখাল দেশের হয়ে ক্রিকেট শুধু ক্রিকেটাররা ভাল খেললেই একটা দেশ উন্নতি করে না। তার মজবুত একটা কাঠামো চাই। তার প্রশাসনের মাথায় যোগ্য লোকজন চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy