Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
অস্ট্রেলিয়াকে বিরাশি সিক্কা

দরবার নিয়ে মুম্বই চললেন বিরাট রাজা

টি-টোয়েন্টি হিসেবের খেলা। অঙ্কের খেলা। কিন্তু অঙ্কে অঙ্কে তো এই মাঝরাত্তিরে প্লাবিত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রেসবক্স স্কোরার এত রাত করে থাকেন না। অথচ আজ অনর্গল পরের পর স্ট্যাটস দিয়েই চলেছেন।

জয়ের নায়ক। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠার পর বিরাট। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

জয়ের নায়ক। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠার পর বিরাট। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

গৌতম ভট্টাচার্য
মোহালি শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩০
Share: Save:

অস্ট্রেলিয়া: ১৬০-৬ (২০ ওভার)ভারত: ১৬১-৪ (১৯.১ ওভার)

টি-টোয়েন্টি হিসেবের খেলা। অঙ্কের খেলা। কিন্তু অঙ্কে অঙ্কে তো এই মাঝরাত্তিরে প্লাবিত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রেসবক্স স্কোরার এত রাত করে থাকেন না। অথচ আজ অনর্গল পরের পর স্ট্যাটস দিয়েই চলেছেন।

অঙ্ক জানাচ্ছে শেষ চার ওভারে রান তাড়ার মত্ততায় ৫৯ তুলেছেন কোহালিরা! বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের মতো প্রেশার কুকারে সেদ্ধ হওয়ার ম্যাচে ওভার পিছু ১৫। কেউ কখনও শুনেছে? নাকি দেখেছে? ধোনি-কোহালি অপরাজিত পার্টনারশিপে যোগ ৩১ বলে ৬৭ রান! অমানুষিক বললে কম বলা হয়। এঁদের পার্টনারশিপের ভরা সময়েও বিশ্বকাপ থেকে আয়োজক দেশের অবধারিত ছুটি হয়ে গেল ধরে নিয়ে ম্যাচ রিপোর্ট লিখে ফেলেছিলাম।

তিন বার সেটা কী না বদলে ওল্টাতে-পাল্টাতে হল। এখনও অবিশ্বাস দূর হচ্ছে না। ম্যাচ সত্যি বার করা গিয়েছে? এমনও মনে হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষণজন্মা ব্যাটসম্যান অনেক এসেছে। এই অবস্থা থেকে এই সব ম্যাচ কে কবে বার করেছে?

একটা কথা সাফ-সাফ বলে নেওয়া উচিত। স্টার স্পোর্টসের স্কোরবোর্ড পুরো ভুল দেখাচ্ছে। কাল কাগজে-টাগজেও নির্ঘাত একই জিনিস লেখা হবে— অস্ট্রেলিয়াকে ছয় উইকেটে হারিয়ে ভারত ওয়াংখেড়ের সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল। কোথায় ভারত? কীসের ভারত?

এটা বিরাট কোহালি এবং তাঁর দশ সঙ্গীর দল! ধোনি জয়সূচক চার লং অনের উপর উড়িয়ে দিতে কোহালি সেলিব্রেট করবেন কী, মাঝ পিচে বসে পড়লেন অবসন্নের মতো।

এই অস্ট্রেলিয়াই না তাঁকে কাঁদিয়ে সিডনি থেকে বান্ধবী অনুষ্কা-সহ ফেরত পাঠিয়েছিল! সিডনির সেমিফাইনালে করেছিলেন মাত্র ১। বীরুষ্কা গোটা দেশজুড়ে তীব্র অভিযুক্ত হয়েছিলেন সেই বিশ্বকাপ বিদায়ের পর। কোহালি যেন আজ তার ঐতিহাসিক কারেকশন সেরে নিলেন। ছাব্বিশ বছর আগে ঠিক এক দিনে বিশ্ব ক্রিকেটে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর! অকল্যান্ডে সে দিনই ওয়ান ডে ওপেনার হিসেবে প্রথম উন্নীত হন। করেছিলেন ৪৯ বলে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ৮২। কোহালি করলেন ৫১ বলে ৮২। সচিনের ইনিংসটা থাকবে ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে। কোহালিরটা আর একধাপ এগিয়ে— ক্রিকেট লোকগাথা হিসেবে।

ব্যাটিং থেকে অনিশ্চয়তা ফ্যাক্টরটাই যেন উধাও করে দিয়েছেন বিরাট। বাকি ব্যাটিং লাইন আপ নিয়মিত ডুবিয়ে চলেছে। আজ ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছে বিপক্ষ, হারের খাদ ওই দড়িটা পেরোলেই। বিশ্বকাপ স্বপ্নের সলিল সমাধি। দেশজুড়ে ফের হতাশা আর আর্তনাদ। কিন্তু বিরাট-রাজের যেন হেলদোলই নেই। কোনও চাপও না। পঞ্জাবের মাঠে রোববার রাতে অস্ট্রেলিয়াকে এমন কোণঠাসা অবস্থা থেকে হারানো ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালীন গৌরবগাথায় ঢুকে গেল। বিরাটেরটা অবশ্য ঠাঁই পেল মহাজাগতিক কোনও আর্কাইভে। যত দিন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থাকবে— সোনার ইনিংসটাও থাকবে!

ম্যাচের প্রথম বল পড়ার আগেই বিকেল-বিকেল উত্তেজনা। আইসিসি-র মুখপাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন কোনও কোনও কাগজের লেখায়, যে ভারত চাপ দিয়ে ডিজাইনার ট্র্যাক বানিয়ে নিয়েছে। পরে দেখা গেল, সত্যি তাই। মিডিয়ার রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছিল। হয় ভারতকে চেষ্টা করতে দেওয়া হয়নি। বা তাদের টার্নার বানানোর চেষ্টায় কাজ হয়নি। কারণ এমন কিছু তো বল ঘুরছে না। সামান্য নিচু হচ্ছে আর আস্তে আসছে। টিপিক্যাল মার্চের ভারতীয় ট্র্যাক। তবে পরে ব্যাট করলে ১৬০/১৭০-এর সামনে অসুবিধে হতেই পারে।

শোয়েব আখতার সকালে বলছিলেন, জিতবে ভারত। কিন্তু কোহালির কাছে আজও রান চাওয়াটা মারাত্মক বাড়াবাড়ি। বললেন, ‘‘আজ যেন ধোনি টস জেতে আর দুই ওপেনার অবশেষে রান করেন।’’

ঠিক দু’টোই হয়নি। তিন নম্বর দুঃস্বপ্ন হিসেবে রবিচন্দ্রন অশ্বিন হাজির হন। যাঁর প্রথম ওভারে কোনও উইকেট না নিয়ে গচ্চা যায় ২২ রান। অস্ট্রেলিয়া দ্রুত চার ওভারে ৫৩ তুলে ফেলল। অ্যারন ফিঞ্চ তখন এত মারছেন যে সিডনির সেই অভিশপ্ত দুপুর মনে পড়ে যাচ্ছে। তিনি আর স্টিভ স্মিথ মিলেই না এসসিজি-তে শেষ করে দিয়েছিলেন ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান। বল হাতে নেহরা ছুটে আসছেন দেখে আবার মনে পড়ে যাচ্ছিল জোহানেসবার্গের আরও একটা দুঃসহ দুপুর। সে দিনও তো অস্ট্রেলীয় ওপেনাররা এ ভাবেই খেলা শেষ করে দিয়েছিলেন বিনা উইকেটে ১০৫ তুলে। নেহরা বেধড়ক মার খেয়েছিলেন। দশ ওভারে দেন ৫৭ রান। অস্ট্রেলীয়রা তো তাই করে। প্রথমেই বিপক্ষকে রিং থেকে বার করে দেয়। তার পর আর বেচারিরা ফিরে আসে না।

কিছু পরে দেখা গেল ব্রায়ান লারা হিসেব দিচ্ছেন প্রথম ৩০ বলে ভারত দিয়েছে ৫৩। ওভারপিছু ১০.৬। পরের ৯০ বলে ১০৭ রান। গড় ৭.১৩।

লারা বলতে চান, ভারত দারুণ ভাবে ম্যাচে ফিরেছে। ফিরেছে কিন্তু আবার শেষ ওভারে হারিয়েও গিয়েছে ১৫ রান দিয়ে। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে পরে ব্যাট করে ১৬১? আদৌ হবে? ইনিংস শেষে ফেরা ধোনির শরীরি ভাষা লক্ষ্য করলাম। ঠিক তেমনই ক্লান্ত হাল ছেড়ে দেওয়া পদক্ষেপ যেন, যা তেরো বছর আগে বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ৩৫৯ করে ফেলার পর সাবেকি ভারত অধিনায়কের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম।

তার মানে আজও গেল? অস্ট্রেলিয়াকে নিজের দেশে ৩-০ হারিয়ে আসার পরেও গেল? কোহালি নামার পর প্রচণ্ড চিৎকার হচ্ছে চার দিকে। সেই লোকে ডাকছে ‘কো-হা-লি কো-হা-লি’ বলে! ভারতীয় ক্রিকেটে তো এক জনের জন্যই এমন সমুদ্রগর্জন ঘটত। তিনি এ সব দিনে মোটেও একা ধারাবাহিক টানতে পারতেন না। হয় নাকি? গোটা টিম তাকিয়ে আছে। গোটা দেশ তাকিয়ে আছে। বিপক্ষ শুধু তাঁকেই মাপছে। বেশ কিছু দিন জিতিয়েছেন। বার বার হয় নাকি? শোয়েব তো সকালে ঠিক বলেছেন। মানুষ তো রে বাবা বিরাট। ক’দিন টানা জেতাবে?

উনিশতম ওভার যখন শুরু হচ্ছে তখনও সমবেত ধারণা, তীরে এসে তরী ডোবার চিরকালীন ভারতীয় অভ্যেস বহাল থাকবে। যতই উল্টো দিকে ধোনি থাকুন, ওভারপিছু দশ কি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফাজলামো নাকি? তা ছাড়া অন্য টিম হলে দশ। অস্ট্রেলিয়া মানে প্রকারান্তরে ওভারপিছু কুড়ি।

তা কুড়িতম ওভারে ধোনি এসে দেখলেন তাঁর জন্য মোটে ৪ রান পড়ে রয়েছে। বিরাট ১৬ রান তুলে দিয়েছেন নিখুঁত সব ক্রিকেটীয় শটে। প্রমথ চৌধুরীর সেই লাঠিয়ালের গল্পের মতো অদৃশ্য মন্ত্রশক্তি যেন আজ ভর করেছিল বিরাটের ব্যাটে। নইলে প্রকাণ্ডতাও এত ব্যাকরণ সম্মত হয় না। কোথাও তার একটা প্রগলভতা থেকেই যায়।

জাদুকরি এহেন ইনিংসের পর টাটকা প্রতিক্রিয়াগুলো দেখছিলাম। সুনীল গাওস্কর বলেছেন, চাপের মুখে এত গুছোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যান তিনি আর দেখেননি। ক্রিকেটের আধুনিক পীঠস্থান থেকে আসা ডিন জোন্স বলছেন, কোহালিকে জিজ্ঞেস করা উচিত রান তাড়া করার সময় ও কী করে মেন্টালি নিজেকে গুছোয়? ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার মাইক সেলভি লিখছেন, ‘কিঙ্গ কোহালি তুমি জিনিয়াস।’ মনে রাখতে হবে সেলভি বহু বার আদত কিঙ্গকে বল করেছেন যিনি সত্তর-আশির দশকে সমারসেট ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলতেন। চির রক্ষণশীল এবং খুঁতখুঁতে বলে পরিচিত সঞ্জয় মঞ্জরেকর টুইট করেছেন, ‘আমি যথেষ্ট ক্রিকেট দেখেছি। কিন্তু আজ যা দেখলাম এখনও তাতে আবিষ্ট হয়ে রয়েছি।’

সঞ্জয়েরটাই সব চেয়ে মনের কাছাকাছি মনে হচ্ছে। যা দেখলাম তা কি সত্যি দেখলাম? রক মিউজিকের কনসার্টে কেউ সেতার বাজিয়ে জিততে পারে নাকি? এ তো ফিকশন। নাকি কোনও কোনও পবিত্র দিনে গল্পের তারারা নেমে এসে বাস্তবের সঙ্গে মাখামাখি করে! নাকি মন্ত্রশক্তিটাই ঠিক তুলনা?

এই রে আবার ভুল লিখলাম। স্টার স্পোর্টসের মতোই। মন্ত্রশক্তি এ বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নীল জার্সিতে রোজ দেখা যাচ্ছে।

এটা না বিরাট-রাজের দরবার। যা নিয়ে তিনি মুম্বই চললেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ঠ্যাঙাতে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর: অস্ট্রেলিয়া ২০ ওভারে ১৬০-৬ (ফিঞ্চ ৪৩, হার্দিক ২-৩৬), ভারত ১৯.১ ওভারে ১৬১-৪ (কোহালি ৮২ ন.আ., ওয়াটসন ২-২৩)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy