অপরাজিত। পাক গোলা সামলে জয় এনে দিলেন বিরাট। শনিবার ইডেনে। উৎপল সরকার।
পাকিস্তান: ১১৮-৫ (১৮ ওভার)
ভারত: ১১৯-৪ (১৫.৫ ওভার)
ভারত ব্যাট করতে নামব নামব। অথচ ইনিংস শুরুর আগেই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তীব্র আশঙ্কা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন সুনীল গাওস্কর।
‘‘উইকেটটা এত খারাপ হল কী করে?’’ সৌরভ ভেবে পাচ্ছেন না। উইকেটের পেছনে তিনিও তো প্রচুর খেটেছেন। জল দিতে বলেছেন। নিয়মিত রোল করতে বলেছেন। তার পরেও বল এত ঘোরে কী করে?
আঠারো ওভারে ১১৯ এমনিতে কোনও রানই নয়। কিন্তু এই পিচ তো দেখা যাচ্ছে নাগপুরের যমজ ভাই। এমন রঙিন প্রাক ম্যাচ অনুষ্ঠান করে শেষমেশ ম্যাচ-উত্তর রেফারি ক্রিস ব্রডের খপ্পরে পড়বেন না তো সৌরভ? যে পিচে সেকেন্ড ওভার থেকে এমন বাঁইবাঁই করে বল ঘুরছে, তাকে যদি আইসিসি কালো তালিকায় ফেলে দেয়! তখন তো বাহারি সব রং মুছে কুচকুচে বাঁদুরে রংই ভেসে বেড়াবে।
আশঙ্কা সত্যি করে ভারতীয় ইনিংসে এ বার পরপর দুর্ঘটনা। রোহিত শর্মার ইডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণ-তুল্য ভাবমূর্তি। তিনি দ্রুত আউট হয়ে গেলেন আমেরকে ঠিক মতো টাইম করতে না পেরে। কিছু পরে ধবন আউট। বল তখন শুধু ঘুরছেই না, গড়াচ্ছে। ক্লাব হাউসের দিকের উইকেটে এক ওভারে জোড়া বিপর্যয়। টিম ইন্ডিয়া ২৩-৩। মনে হল সীমিত ওভারের ম্যাচে ইডেন সেই প্রাচীন অরণ্যপ্রবাদ সত্যি করে আবার ভারতকে হারাবে। কুড়ি বছর যা চলে আসতে আসতে এই মাঠের রীতিমতো দস্তুর হয়ে গিয়েছে। ভারত শুরু করবে ভাল, কিন্তু শেষে গিয়ে হারবে।
কুড়ি বছর ধরে চলতে থাকা পুরনো সেই বাঁদুরে রং। যা ম্যাচের শেষ দিকে অকস্মাৎ এসে মুছে দেবে এত ভাল সব কোলাজকে। ইমরানের এক লাইনের দেশাত্মবোধক বক্তৃতা। অমিতাভের জাতীয় সঙ্গীত। স্টিভের একান্তে বক্সে ডাকা ভিভিএস লক্ষ্মণকে। সৌরভের সংগঠনে দাদাগিরি।
ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম কুড়ি বছর আগের শোষিত মানুষটিকে তাঁর মুম্বইয়ের বাড়িতে। তিনি
নিশ্চয়ই ম্যাচ দেখছেন আর গুমরে মরছেন। কুড়ি বছর আগের ইডেন তাঁকে, মানে অজিত ওয়াড়েকরের কোচিংপুষ্ট ভারতকে উপহার দিয়েছিল অনন্ত লজ্জা।
এ দিন ধোনি যেমন প্রথমে ফিল্ডিং নিয়ে পতনের মুখে, সে দিনও তা-ই হয়েছিল। আজহারউদ্দিন টসে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তে হেরে গিয়েছিলেন।
এ দিন ধোনি যেমন অধিনায়কত্বে নানান ভুল করেছেন। অশ্বিনের কোটা শেষ করাননি এমন স্পিনিং পিচে। যুবরাজকে বল না করিয়ে হার্দিক পাণ্ড্যকে দিয়ে অনর্থক ঝুঁকি নিয়েছেন। সে দিনের আজহারও না এই ভাবে মরেছিলেন। টস জিতে ফিল্ড করতে বারণ করেছিলেন ওয়াড়েকর। কিন্তু পুত্রসম আজহার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেও তাঁর কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি। পরে ব্যাট করতে গিয়ে স্বখাত সলিলে ডুবেছিল ভারত। শনিবার দর্শকাসনে বসা সচিন সে দিন লড়েছিলেন একা। যেমন এখানে কোহালি লড়ছেন। কিন্তু একা তিনি কত করবেন?
ওয়াড়েকরের ফোন বন্ধ। পেলাম না। কিছু পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বললেন, ও মনে হয় টিভি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনিতেই হার্ট ভাল নয়। তার ওপর পুরনো খোঁচাখুঁচি কে শখ করে চায়!
এ বার মনে হতে লাগল জগমোহন ডালমিয়ার কথা। কুড়ি বছর আগে তিনি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী স্তোত্র পাঠ করাতে চেয়েছিলেন অমিতাভকে দিয়ে। অমর সিংহ সেই সময় বচ্চনের ঘনিষ্ঠতম। কিন্তু তাঁর মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়েও ব্যাপারটা করা যায়নি। সৌরভ সেটা উত্তরসূরি হিসেবে পেরেছেন।
কিন্তু ভারত এই ভাবে হতচ্ছাড়া হারলে কার মনে পড়বে সে সব কথা? যাবতীয় রং তো ঢেকে যাবে এ দিনই ভারতের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি থেকে মোটামুটি বিদায় নেওয়ার অলক্ষুনে খবরে। সৌরভ নিজে কাতর ভাবে বলেও ফেললেন, ‘‘আমি আর কী করতে পারি। টিমকে জেতানো তো আমার হাতে নেই।’’
রায়না কেন টিমে? কেন অজিঙ্ক রাহানে নন, এই প্রশ্ন এমন বিষণ্ণতার আবহে তোলার অবকাশ নেই। এক বলে রায়না আউট মানে তো ভারত হারের পদতলে দাঁড়িয়ে। গ্যালারি তখন চিৎকার শুরু করেছে— ‘সাচিন সাচিন’। যেন দেশ বিপন্ন, তুমি এসো উদ্ধার করো হে সচিন।
কোহালি তত ক্ষণে স্থির করে ফেলেছেন, এই ডাকটার এ বার নতুন যুগে নতুন নামকরণের সময় হয়েছে। বিশ্বক্রিকেটের এত সব কুলীন ক্যাপ্টেন এখানে বসা। ইমরান, স্টিভ, নাসের, আক্রম। প্রথম দু’জন তো ক্রিকেট মাঠে আর আসেনই না। তাঁদের সামনে বিরাট ক্রমশ তাঁর ক্রিকেটীয় ডালপালা বিস্তার শুরু করলেন। নামেই এটা টি-টোয়েন্টি ইনিংস। অনায়াসে টেস্ট বা ওয়ান ডে-ও হতে পারত। এই পিচে ক্রমাগত এত মিড ব্যাট দিয়ে খেলা। অচঞ্চল থেকে টিমকে জেতার দিকে নিয়ে যাওয়া এবং কোনও কিছুতে বিচলিত না হওয়ার নার্ভ দেখানো।
এ দিনের পর সচিনে আবিষ্ট প্রজন্মের মানার সময় হয়েছে, ম্যাচ জেতানোর এই ধারাবাহিকতা এমনকী তেন্ডুলকরের ক্রিকেটজীবনেও নেই। পাকিস্তান ছয় উইকেটে ভারতের কাছে হেরেছে, এটা শুধু স্কোরবোর্ডে লেখা থাকল। যাঁরা মাঠে ছিলেন
তাঁরা জানেন, ভারতের জায়গায় আসলে কোহালি।
ইডেনে পাকিস্তান হেরে ফেরে না— এই ধারণা যখন ছায়া বিস্তার করে বিষণ্ণতার কম্বলে মাঠ ঢেকে দিচ্ছে, কোহালি আর যুবরাজ জুড়লেন ৪৪ বলে ৬১। কলকাতা দর্শক এ বার জয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে আদরের উদ্দীপ্ত ডাক শুরু করেছে, ‘যুবি যুবি’। সেই বক্স অফিসেই মজে গিয়ে যুবরাজ আউট হয়ে গেলেন। পুল করার জন্য ওই বলটা মোটেও আদর্শ ছিল না। কিন্তু গ্যালারির ওই তাতানিতে নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন।
অম্বানীদের বক্সে তার অনেক আগেই অমিতাভ পেছনে চলে গিয়েছেন। ভারতের খেলা মাঠে বসে কখনও দেখেন না এই কুসংস্কারে যে, তিনি মাঠে গেলে ইন্ডিয়া হারে। এ দিনও কি তা-ই হবে? যুবরাজের আউটটাই হয়ে যাবে ম্যাচের চূড়ান্ত মোড় ঘোরানো বন্দোবস্ত?
উল্টো দিকে ধোনি। কিন্তু এটা তো তাঁর উইকেট নয়। ঠিক এই সময় বিরাট যেন আরও জুড়ে বসলেন এই ম্যাচের ওপর। ভাবাই যায় না কী আশ্চর্য রূপান্তর এই ক’বছরে তিনি নিয়ে এসেছেন ব্যাটিংয়ে। যত কঠিন চ্যালেঞ্জ, তত যেন নিজেকে উদ্দীপ্ত করেন। ইমরান শুক্রবার বলছিলেন, শুরুতে বিরাটের বাহাদুরি দেখে আমার ভয় হতো, এ লরেন্স রো হয়ে যাবে না তো? পরে বুঝলাম হবে না।
বিশ্বক্রিকেট অবশ্য দেখল, ধুমধাড়াক্কার ওয়ান ডে ক্রিকেটেও সনাতনী ব্যাটিং ভাবনা কী ভাবে জয়যুক্ত থাকতে পারে। এ তো টেস্ট টেকনিকের সামান্য অদলবদল করে টি-টোয়েন্টি যুদ্ধ জেতা। মনে করতে পারছি না ইডেনে এই পরিমাণ চাপের মুখে তাঁর এ দিনের ৩৭ বলে অপরাজিত ৫৫ রানের চেয়ে আর ভাল টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলা হয়েছে বলে!
ঢাকার এশিয়া কাপের ইনিংসটা আরও অসহায় অবস্থায় আরও ছুটন্ত পিচে। কিন্তু সে দিন এই চাপ ছিল না। হেরে গেলে টুর্নামেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দত্যি-দানোগুলো পাশে ঘুরছিল না। আফ্রিদি অনেক চেষ্টা করলেন নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে আগে এনে। সাধ্যমতো বল করে। কিন্তু একে তাঁর সেই দরের স্পিনার নেই। আর পেস বোলিং চিরে ফেলার জন্য তো কোহালি একাই যথেষ্ট।
ধোনি ছয় মেরে জেতার অভ্যেস পরিত্যাগ করে এ দিন সিঙ্গলসে উইনিং স্ট্রোক মারলেন। নিয়মের ব্যতিক্রম। সর্বঅর্থেই ব্যতিক্রম। ম্যাচ শেষে কী অসাধারণ মুহূর্ত, যখন মুকেশ অম্বানীর বক্সে জাতীয় পতাকা পাশাপাশি দোলাচ্ছিলেন অমিতাভ আর সচিন।
কিন্তু ওই পতাকাটা আসলে লাগানো ছিল কোহালির ব্যাটে। যা রংমশালের মতো ছড়িয়ে ইডেনকে তার সর্বকালের এক স্মরণীয় জয় উপহার দিয়ে গেল। আর হ্যাঁ, সেই অরণ্যপ্রবাদটাও অটুট রেখে দিল— আইসিসি টুর্নামেন্টে দেখা মানে ভারত জিতবে। পাকিস্তান হারবে। হারবেই। ইডেনেরটা মুছতে কুড়ি বছর গেল। পাকিস্তান রানিং চব্বিশ।
সৌরভের রেকর্ডটাও কি অক্ষুণ্ণ থাকল? তাঁর ক্রিকেটীয় জীবনের মতোই তো! প্রথমে হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে খেলা না হওয়ার আশঙ্কা। তার পর ভারতের ম্যাচে বিপর্যয়ের ভয়। এর পর অসামান্য কামব্যাক।
কোহালির একটা ছোট ব্যাট ইতিহাসের কত কিছুই যে মিটিয়ে দিয়ে গেল। কত কিছুকে যে ফেরত আনল!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: পাকিস্তান ১৮ ওভারে ১১৮-৫ (শোয়েব ২৬, নেহরা ১-২০), ভারত ১৫.৫ ওভারে ১১৯-৪ (কোহালি ৫৫ ন.আ, সামি ২-১৭)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy