পাশে স্ত্রী। শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ক্লার্ক। —গেটি ইমেজেস।
শেষটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।
সোনা রোদের সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক ল্যাপ দিয়ে অন্তিম দৃশ্যটা ফ্রেমবন্দি হতে পারত। পারত, হাজার-হাজার দর্শকের দিকে হাত নাড়ানোর ছবি দিয়ে। বা একটা ফ্লাইং কিংস, যা ছুটে যেতে পারত স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো স্ত্রী কাইলির দিকে। স্বর্ণোজ্জ্বল ক্রিকেট-জীবনের সমাপ্তি ঘটতে পারত এসসিজি গেট দিয়ে অপসৃয়মান এক গর্বিত ব্যক্তিকে দিয়ে, যে ক্রিকেট-কিট তুলে রাখছে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের জন্ম দিয়ে।
একটাও হল না।
প্রাপ্তির নোটবুকে বরং থাকল নটিংহ্যামের এক পানশালা। তার কোনার দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা টেবল। বহু দিনের পুরনো এক সতীর্থ, যে এগারো বছর আগের বেঙ্গালুরুতে হাতে তুলে দিয়েছিল টেস্ট ক্যাপ। পড়ে থাকল, অবসন্ন সর্বাধিনায়কের প্রতিচ্ছবি। যাঁর মাথা নিচু, যিনি জনমত, মিডিয়া, সমালোচক, বাইশ গজ— সব প্রশ্নপত্রের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। বিধ্বস্ত।
মাইকেল ক্লার্ক ক্রিকেট ছেড়ে দিচ্ছেন। বরাবরের মতো বিদায় নিচ্ছেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট থেকে। বিদায় নিচ্ছেন, পিছনে এক ভস্মাধার ফেলে রেখে।
ভোর ছ’টায় এ দিন কোচ ডারেন লেম্যানকে ডেকে খবরটা দেন ক্লার্ক। বলে দেন, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওভালে খেলবেন, তার পর আর নয়। কিছুক্ষণ পর নির্বাচক প্রধান রডনি মার্শ, গোটা অস্ট্রেলিয়া টিম, সবাই জেনে যায়। আগাম খবরটা কাইলি ছাড়া জানতেন শুধু একজন। শুক্রবার রাতে নটিংহ্যাম পানশালায় যাঁর সঙ্গে বসেছিলেন ক্লার্ক, যিনি এগারো বছর আগে হাতে তুলে দিয়েছিলেন টেস্ট ক্যাপ, সেই শেন কিথ ওয়ার্ন জানতেন।
‘‘আমি ছেলেদের ফেলে রেখে জাহাজ থেকে এখনই লাফ মারতে চাই না। ওভালে খেলব। কিন্তু ওটাই শেষ,’’ অ্যাসেজ হারিয়ে শনিবার বলে দিয়েছেন ক্লার্ক। ‘‘আসলে গত বারো মাস ধরে আমার পারফরম্যান্স ভাল নয়। নিজেই সেটা মানতে পারছি না। আমি সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে খেলতে চেয়েছি। এই পারফরম্যান্স তাই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সবাই বড় টুর্নামেন্ট ধরে নিজেকে প্রস্তুত করে। আমিও করেছি। ওয়ান ডে-তে সেটা বিশ্বকাপ। টেস্টে অ্যাসেজ। আমি চেষ্টা করেছিলাম। ছেলেরাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দাঁড়াতেই পারলাম না।’’
চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত। অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার কাছে নয়, কিন্তু ক্লার্ক ঘনিষ্ঠদের কাছে নিঃসন্দেহে। মিডিয়া জানত, যে কোনও দিন এটা হবে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু ক্লার্ক ঘনিষ্ঠরা কিছুতেই হিসেবটা মেলাতে পারছেন না। কারণ একই লোক তো ট্রেন্টব্রিজ টেস্টের আগে বলেছিল, ছাড়ার প্রশ্নই নেই। ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধ এখনও ততটাই, যতটা এত দিন ছিল। বরং সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল পরিশ্রম দিয়ে পুরনো সিংহাসন পুনরুদ্ধারের। তা হলে আচম্বিত হল কী?
ট্র্যাজিক নায়ক কিছু বলেননি। বরং ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন তাজ কার হাতে যাওয়া উচিত। ‘‘আমার তো মনে হয় স্মিথি (স্টিভ স্মিথ) তৈরি। কিন্তু আমি এটা নিয়ে বলার কেউ নই। শুধু বলব স্মিথি অস্ট্রেলীয় গ্রীষ্মে যে সুযোগ পেয়েছিল তাতে ও প্রমাণ করেছে যে, ভাল অধিনায়কের সব মশলা ওর মধ্যে আছে। ওর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।’’
কিন্তু তাঁর ঐতিহ্য? উত্তরাধিকার পেলেও সেটা পাবেন তো স্মিথ?
অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন ক্লার্ক। ব্যাটসম্যান হিসেবে দক্ষতা প্রশ্নাতীত। প্রামাণ্য, ১১৪ টেস্টে ২৮ সেঞ্চুরি। ওয়ান ডে-তেও অপরিহার্য ছিলেন। বিশ্বকাপ থেকে বড় টুর্নামেন্ট— জিততে বাদ রাখেননি কিছু। একটা সময় তাঁকে স্টিভ ওয়ের যোগ্য উত্তরসূরি বলা হত। ২০১২ সালে যে ব্যাটিং-বিস্ফোরণ তিনি ঘটিয়েছিলেন, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহল সন্দিহান তা আর কখনও ঘটবে বলে।
গত বছর থেকে দুঃসময়ের শুরু। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের সম্মোহন শক্তি হারাতে শুরু করা। ফুটওয়ার্ক, টাইমিং— সব যাচ্ছিল একে একে। টিমের প্রয়োজনে ব্যর্থতা। আউটও হচ্ছিলেন বেনজির ভাবে। অস্ট্রেলীয় মিডিয়া বলছে, ফর্মের সঙ্গে আরও দু’টো ব্যাপার ক্লার্ক সাম্রাজ্যের পতনের নেপথ্যে কাজ করেছে। ক্রমাগত চোট আঘাত পেড়ে ফেলছিল ধীরে ধীরে। আজ পিঠ, কাল হ্যামস্ট্রিং। আর ছিলেন ফিল হিউজ। অভিন্নহদয় বন্ধুর মৃত্যু এতটাই বিপর্যস্ত করে দেয় যে, তার প্রভাব থেকে নাকি আজও বেরোতে পারেননি মাইকেল ক্লার্ক।
চলতি অ্যাসেজে দুঃসময় পাল্টে যায় ক্রিকেটজীবনের সবচেয়ে দুঃসহ অধ্যায়ে। দল নির্বাচন নিয়ে নাটক। বর্ষীয়ান ব্র্যাড হাডিনকে বাদ দেওয়া নিয়ে তুমুল বিতর্ক। অধিনায়কের প্রতি অনাস্থায় টিমে ঝামেলার ইঙ্গিত। অধিনায়কত্বের ধরন নিয়ে প্রশ্ন। শেষে সমালোচকদের দাঁতনখ। সবই শেষের শুরুর ইঙ্গিত।
ক্লার্ক নিজেও মানসিক স্থিতাবস্থায় নেই। ইংল্যান্ডের কাছে অপমানের অ্যাসেজ হারে এতটাই মূহ্যমান নাকি দেখিয়েছে তাঁকে যে, কারও কারও মনে হয়েছে লোকটাকে হাত-পা বেঁধে ইয়ারায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। অস্ফুটে ক্লার্ক বলেও দিয়েছেন, ‘‘অস্ট্রেলীয় অধিনায়ককে পারফরম্যান্সের যে মান ধরে রাখতে হয়, আমারটা তার ধারেকাছে ছিল না। ছেলেদের দোষ দেব না। আমি নিজেই তো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারিনি।’’
ভেতরে চুরচুর হয়ে যাওয়া এক ক্রিকেট-জেনারেলের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু জীবনের চরমতম যন্ত্রণার দিনে কোথাও যেন জিতেও গেলেন ক্লার্ক। অ্যাসেজে চূর্ণ, লাঞ্ছনার সমুদ্রে গলা অবধি ডুবে, তবু বিদায়ের দিন দেশের জনমানসের কাছে জিতে গেলেন ক্লার্ক। বোধহয় মিডিয়ার বিরুদ্ধেও। যে মিডিয়া এত দিন ধরে তাঁকে নিত্য শাপ-শাপান্ত করছিল, তারাই আজ বলল ক্লার্ক নিয়ে যে যা খুশি বলতে পারে। কিন্তু তিনি থেকে যাবেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা যোদ্ধা হিসেবে। বলল, ক্লার্ক ভাল লিডার না হতে পারেন, কিন্তু দুঁদে অধিনায়ক ছিলেন। কূটনীতির ধার ধারতেন না, সাফল্যের দিনেও টিমে বিভাজন থাকত। কিন্তু তার পরেও ট্রফি ক্যাবিনেট কখনও ফাঁকা দেখায়নি। অস্ট্রেলীয় ঔদ্ধত্যের স্মারক বলতে যা বোঝায়, মাইকেল ক্লার্ক ছিলেন তাই!
যার অর্থ বিদায়ের দিনে বিদ্বেষ নয়, সম্মানের একুশ তোপধ্বনি। গত দেড় বছরে ক্লার্ক কী পারেননি, ট্রেন্টব্রিজ-উত্তর পর্বে কেউ মনেই রাখছেন না। বরং মনে পড়ছে এগারো বছর আগের অভিষেককারী তেইশ বছরের ফুটফুটে এক ছেলেকে, যে সামনে জাহির খান দেখেও ভয় পায়নি। আটানব্বইয়ে দাঁড়িয়েও যে অক্লেশে হেলমেট নামিয়ে মাথায় ব্যাগি গ্রিন তুলে নিয়েছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy