Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

পায়ে বল আর চোখে জল নিয়ে কয়েদিদের আবেগ হারাল ফুটবলকে

ফোন করে মাকে বলেছিলেন, ম্যাচ দেখতে আসার জন্য। কিন্তু মা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, খুনি ছেলের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। ছলছল চোখে কয়েদি টিমের কিপার রবিন মল্লিক তাই বলছিলেন, “মা-ও দূরে সরে থাকল। এত বার করে বললাম, খেলা দেখতে আসার জন্য। তবু এল না।” এক সময় ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে খেলার স্বপ্ন দেখতেন যে ছেলে, তিনি আজ হাততালি কুড়োলেন কয়েদি টিমের সদস্য হয়ে জেলা লিগে নিজের স্কিল দেখিয়ে।

ম্যাচ শুরুর আগে কয়েদি একাদশের ফুটবলাররা।

ম্যাচ শুরুর আগে কয়েদি একাদশের ফুটবলাররা।

তানিয়া রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪১
Share: Save:

ফোন করে মাকে বলেছিলেন, ম্যাচ দেখতে আসার জন্য। কিন্তু মা নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, খুনি ছেলের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। ছলছল চোখে কয়েদি টিমের কিপার রবিন মল্লিক তাই বলছিলেন, “মা-ও দূরে সরে থাকল। এত বার করে বললাম, খেলা দেখতে আসার জন্য। তবু এল না।”

এক সময় ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে খেলার স্বপ্ন দেখতেন যে ছেলে, তিনি আজ হাততালি কুড়োলেন কয়েদি টিমের সদস্য হয়ে জেলা লিগে নিজের স্কিল দেখিয়ে। এরিয়ানের জুনিয়র দলে খেলা সোমনাথ মিশ্রী তাই বলছিলেন, “জীবনের কালো দিকটা যে কী ভয়ানক এখন দেখতে পাচ্ছি। যে ভুল একবার করে ফেলেছি, তার জন্য এখন অনুতাপ করেও কোনও লাভ নেই। এই ফুটবলটুকু আছে বলেই হয়তো দমবন্ধ করা গারদে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি।”

ভাইঝিকে নিয়ে জগন্নাথ নস্করের খেলা দেখতে এসেছিলেন তাঁর বৌদি দীপা নস্কর। ছোট্ট রিয়াকে দেখে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না কয়েদিদের দলের অধিনায়ক। কাছে গিয়ে ভাইঝিকে আদর করার অনুমতি পাননি। অস্থায়ী ড্রেসিংরুমের গ্রিলের ওপার থেকেই আদরের রিয়াকে রসগোল্লা খাইয়ে দিলেন জগন্নাথ। হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়।

সোমবার আগরপাড়া ক্রীড়া সংস্থার মাঠে এ রকমই মন ছুঁয়ে যাওয়া টুকরো-টুকরো দৃশ্যের কোলাজ। জেলা লিগের শুরুটা অবশ্য মোটেও ভাল হল না কয়েদিদের টিমের। আগরপাড়া ক্রীড়া সংস্থার কাছে ১-৫ হারতে হল তাদের। তবু খোলা মাঠে খেলার স্বাদ সমাজের চোখে কলঙ্কিত আসামী বলে পরিচিত সোমনাথ, জগন্নাথদের এ দিন আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। তাই ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল কারও চোখে জল। কথা বলতে গিয়ে কারও গলা বুজে আসছে। কয়েদিদের অভিনব টিমের খেলা দেখতে হাজির হয়েছিলেন হাজার দু’য়েক দর্শক। সেই ভিড়ে ছিল অনেক দূর-দূর থেকে আসা কয়েদিদের পরিবারের লোকজনও। শুধু খেলা দেখা তো নয়, বহু দিন পরে খোলা আকাশের নীচে বন্দিহীন ভাবে ঘরের ছেলেকে একবার ছুঁয়ে দেখার প্রবল ইচ্ছে নিয়েই ছুটে এসেছিল টিঙ্কু ভাইদের মতো কয়েদিদের বাড়ির লোকেরা।


পুলিশি পাহারায় চলছে ম্যাচ। সোমবার আগরপাড়ায়।

খোলা মাঠে খেলতে এসে অবশ্য কঠোর পুলিশি প্রহরাতে থাকতে হল কয়েদিদের টিমকে। গোটা মাঠ পুলিশের ব্যারিকেড ঘিরে রেখেছিল। কয়েদিদের রিজার্ভ বেঞ্চের সামনেও পাহারা দিচ্ছিলেন জনাকয়েক পুলিশ। এমনকী কয়েদি ফুটবলারদের কেউ শৌচালয়ে গেলেও, তাঁর সঙ্গে একজন করে সশস্ত্র পুলিশ যাচ্ছিলেন। আবার পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের এডিজি (কারাগার) অধীর শর্মা এ দিন নিজে মাঠে উপস্থিত থেকে কয়েদি-ফুটবলারদের উৎসাহ দেন।

এত কিছুর পরও বড় ব্যবধানে কয়েদিরা হেরে যাওয়ায় আফসোস করতে দেখা গেল পাহারাদার পুলিশদেরও। দলটার কোচ, প্রাক্তন ফুটবার মিহির দাস বললেন, “আসলে ওরা ভালই খেলছিল। কিন্তু বাড়ির লোকজন সবাই খেলা দেখতে এসেছেন, এত লোকের মাঝে প্রথম লিগের ম্যাচ খেলা--- সব মিলিয়ে ওরা বোধহয় কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। খেলার চেয়ে বেশি মন ছিল বাড়ি থেকে আসা দাদা, ভাই, বন্ধুদের দিকে।” ম্যাচ হেরে মনমরা ছিলেন সোমনাথ, সাহেব পিঁয়াদারা। সাহেব এ দিন কয়েদি টিমের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন। প্রিজন ভ্যানে উঠে আবার হাজতে দিকে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “প্রথম ম্যাচ ছিল। তাই হেরে গেলাম। পরের ম্যাচ থেকে আর হারব না।”

ছবি: উৎপল সরকার

অন্য বিষয়গুলি:

prisoner ball in leg tear in eye taniya roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE